নিষেধাজ্ঞার সময়েও বরিশালে বন্ধ হয়নি জাটকা ধরা

এম মিরাজ হোসাইন I বরিশাল

বরিশালের বাজারে বিক্রি হচ্ছে জাটকা ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

প্রজননের জন্য মিঠাপানির সন্ধানে দক্ষিণের পাঁচটি মোহনা দিয়ে মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীতে প্রবেশ করে ইলিশ। তিন মাস পর্যন্ত মা-ইলিশের সঙ্গে নদীতেই থাকে জাটকা। এ সময়ে ইলিশের বেড়ে ওঠা নিরাপদ করতে ১ নভেম্বর থেকে ৩০ জুন জাটকা নিধন নিষিদ্ধ করেছে মৎস্য অধিদপ্তর। এছাড়া ছয় জেলার পাঁচটি অভয়াশ্রমে ১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল ইলিশসহ সব ধরনের মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এর মাঝেও বরিশালে বন্ধ হয়নি জাটকা নিধন।

মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, এবার ইলিশের উৎপাদন বেশি। তাই জাটকা নিধনও বেশি হচ্ছে। এসব বন্ধে মৎস্য অধিদপ্তরের জনবল সংকটসহ নানা সীমাবদ্ধতাকে দায়ী করেন তারা।

চাঁদপুর ইলিশ গবেষণা কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী, প্রজনন নিরাপদ করতে আশ্বিনের পূর্ণিমার আগে-পরে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞায় মা-ইলিশের ডিম ছাড়ার পরিমাণ প্রতি বছর বাড়ছে। ২০১৮ সালে ৪৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ, ২০১৯ সালে ৪৮ দশমিক ৯২, ২০২০ সালে ৫১ দশমিক ২, ২০২১ সালে ৫১ দশমিক ৭ এবং ২০২২ সালে ৫২ শতাংশ ইলিশ ডিম ছেড়েছে। এ কারণে প্রতি বছরই ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে।

মৎস্যবিশেষজ্ঞদের তথ্যানুযায়ী, জাটকার বিচরণের প্রধান ক্ষেত্র হচ্ছে চাঁদপুর, বরিশাল, ভোলা ও শরীয়তপুরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত মেঘনা, তেঁতুলিয়া, আড়িয়াল খাঁ ও কালাবদর নদী। এছাড়া দক্ষিণের সাগরের মোহনাসংলগ্ন আগুনমুখা, আন্ধারমানিক ও বলেশ্বরে জাটকার বিচরণ রয়েছে। জানুয়ারি-এপ্রিল পর্যন্ত বৃহত্তর বরিশাল, চাঁদপুর ও শরীয়তপুরের নদী-নদীতে জাল ফেললেই জাটকা ধরা পড়ে। পরে তা মোকামগুলোয় বিক্রি হয়।

সম্প্রতি বরিশাল পোর্টরোড মৎস্য আড়তে কমপক্ষে ২০ মণ জাটকা ডাকে বিক্রি করতে দেখা যায়। বিষয়টি মুঠোফোনে মৎস্য কর্মকর্তা ড. বিমল চন্দ্রকে জানানো হলে তিনি বলেন, ‘এখুনি অভিযান চালাতে আমাদের প্রস্তুতি নেই।’ আমরা পৌঁছানোর আগে মাছ সরিয়ে ফেলবে বলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান। তবে তিনি দাবি করেন, তারা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছেন। এর ফাঁক দিয়েই জাটকা বিক্রি হয়।

এ ব্যাপারে মৎস্য অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় উপপরিচালক নৃপেন্দ্রনাথ বিশ্বাস বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এবার ইলিশের উৎপাদন বেশি হয়েছে। তাই জাটকা নিধনও বেশি হচ্ছে।’ তবে এসব বন্ধে তিনি মৎস্য অধিদপ্তরের অন্য কর্মকর্তাদের মতোই জনবল সংকটসহ নানা সীমাবদ্ধতার অজুহাত দেখান। জাটকা জব্দের পর মূল মালিককে খোঁজার চেষ্টা তারা করেন না। শুধু পরিবহনকারী শ্রমিকদেরই জেলজরিমানা করা হয় বলেও স্বীকার করেন তিনি।

বরগুনার পাথরঘাটা এবং পটুয়াখালীর আলীপুর-মহিপুর এবং গলাচিপা উপজেলার লঞ্চঘাট এলাকায়ও একই অবস্থা দেখা গেছে। প্রতিটি উপজেলায় মৎস্য কর্মকর্তা, কোস্ট গার্ড ও নৌ-পুলিশ আছে। তার পরও নির্বিঘ্নে জাটকা সরবরাহ করা হচ্ছে।

জাতীয় মৎস্যজীবী সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ইকবাল হোসেন মাতুব্বর বলেন, ‘নদীতীরের প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধি প্রায় সবাই ইলিশ ব্যবসায়ী। তাদের সহযোগিতায় জেলেরা জাটকা নিধন ও বিক্রি করেন। সবার আগে তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। যেসব উপজেলায় জাটকা নিধন হয়, সেসব উপজেলার জেলেদের খাদ্যসহায়তাসহ সব সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেয়া প্রয়োজন। জাটকা নিধনকারী ট্রলার ও পরিবহনকারী যানবাহন স্থায়ী জব্দের আইন করা হলে পরিত্যক্ত জাটকা উদ্ধার বাণিজ্য বন্ধ হবে।’

মেঘনা নদীর ২২ কিলোমিটার বয়ে গেছে বরিশালের হিজলা, মেহেন্দীগঞ্জ, শরীয়তপুরের ঘোষেরহাট ও মাদারীপুরের কালকিনী, লক্ষ্মীপুরের রায়পুর এবং চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলার কোলঘেঁষে। ভোলার চারপাশে মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীতীরে টংঘরে গড়ে উঠেছে শত শত মাছ ঘাট। মেঘনায় নিধন করা জাটকা বিক্রির বড় মোকাম মাদারীপুর উপজেলার কালকিনী উপজেলার মিয়ারহাট। এছাড়া শরীয়তপুরের ঘোষেরহাট উপজেলার রেহানউদ্দিনের মাছঘাট, পট্টিবাজার, বরিশাল ও শরীয়তপুরের সীমানায় খোকা বেপারীর। মেঘনা, তেঁতুলিয়াসহ অন্যান্য শাখা নদীতে আহরিত জাটকা ট্রলারে এনে এসব মোকামে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে সড়ক ও নৌপথে সারা দেশে বাজারজাত হচ্ছে।

এছাড়া পটুয়াখালীর তেঁতুলিয়া, আগুনমুখা নদীসহ মোহনায় নিধন করা জাটকা বিক্রি হয় গলাচিপার পানপট্টি লঞ্চঘাটসহ কমপক্ষে ১০টি পয়েন্টে। বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র ছাড়াও চরদোয়ানী মৎস্য উপকেন্দ্র, পদ্মা স্লুইসঘাট, বাদুরতলা, রুইতা, তালতলী উপজেলার একাধিক পয়েন্টে এবং কলাপাড়া উপজেলার আলীপুর-মহিপুর মোকামে জাটকা বিক্রি হচ্ছে। বরিশাল নগরীর পোর্ট রোড মোকাম এবং তালতলী বাজার ও লাহারহাট ছাড়া বাবুগঞ্জ উপজেলার মোল্লারহাট, আগরপুর নতুন চর, জাহাপুর ইটবাটা, রমজানকাঠি ট্রলারঘাট, ভূতেরদিয়া খেয়াঘাট, রাজগুরু নতুনচরসহ বিভিন্ন পয়েন্টে জাটকা বিক্রি হয়। পটুয়াখালী, বরগুনা ও বরিশালের জাটকা পাচার হয় সড়ক পথে।

ইলিশ গবেষক ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য বিভাগের অধ্যাপক ড. ইয়ামিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের জিডিপির ১ শতাংশ আসছে ইলিশ থেকে। মাত্র একটি ইলিশ থেকে বছরে ৮ কোটি টাকা আয় সম্ভব।’

এর ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘ইলিশ একবারে গড়ে ১২-১৫ লাখ ডিম ছাড়ে। এর মধ্যে ১০ শতাংশ ডিম টিকে থাকে। সে হিসাবে প্রতি লাখে ১০ হাজার ইলিশের জন্ম হয়।’

গবেষণায় দেখা গেছে, এক মৌসুমে ইলিশের গড় ওজন পদ্মায় ৪০০ গ্রাম, মেঘনায় ৪৬০ এবং মোহনায় ৫০০ গ্রাম হয়। তাই জাটকা রক্ষা করতে পারলে ইলিশ খাত থেকে জিডিপি ২৫ শতাংশ পর্যন্ত উন্নীত করা সম্ভব। তবে জাটকা সংরক্ষণ করতে না পারলে মা-ইলিশ রক্ষার উদ্যোগগুলো অর্থহীন বলেও মনে করেন অধ্যাপক ড. ইয়ামিন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন