আলোকপাত

আমদানির সিদ্ধান্তে চালের বাজারে স্বস্তি ফিরবে কি

মো. আবদুল লতিফ মন্ডল

ছবি : বণিক বার্তা

বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে বেসরকারি খাতকে চাল আমদানির অনুমতি দিয়েছে সরকার। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, বেসরকারি খাতের ৩০টি প্রতিষ্ঠান সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ ভাঙা দানাবিশিষ্ট ৮৩ হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি পেয়েছে। চাহিদার তুলনায় অভ্যন্তরীণ উৎপাদন কম হওয়ায় অভিজ্ঞজনরা চাল আমদানির জন্য যথাসময়ে পরামর্শ দেয়। সরকারের দেরিতে চাল আমদানির সিদ্ধান্তের খেসারত দিতে হয় সাধারণ জনগণকে। তারা এরই মধ্যে উচ্চ মূল্যে চাল কিনে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নতুন বোরো ধান উঠতে প্রায় দেড় মাস সময় লাগবে। মাথাপিছু দৈনিক চালের চাহিদার হিসাবে এ সময়ে ৪০-৪৫ লাখ টন চাল দরকার হবে। বর্তমানে (২৪ মার্চ) সরকারি গুদামে চাল ও ধানের পরিমাণ যথাক্রমে ১২ লাখ টন ও ১১ হাজার টন। চালকল মালিক, চাল ব্যবসায়ী, মজুদদার, বড় গৃহস্থের কাছে কী পরিমাণ চাল এ মুহূর্তে জমা আছে তার সঠিক হিসাব সরকারের আছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ থাকা অমূলক নয়। তাই স্বল্প পরিমাণ চাল আমদানির সিদ্ধান্তে চালের বাজারে কিছুটা স্বস্তি নিয়ে আসতে পারে কিনা তা আলোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।

দেশ চাল উৎপাদনে প্রশংসনীয় অগ্রগতি সাধন করলেও এখন পর্যন্ত স্বনির্ভরতা অর্জন করতে পারেনি। প্রায় প্রতি বছর চাল আমদানি করতে হয়। গত (২০২২-২৩) ও আগের অর্থবছর (২০২১-২২) আমদানীকৃত চালের পরিমাণ দাঁড়ায় যথাক্রমে ১০ লাখ ৫৬ হাজার ও ৯ হাজার ৮৮ হাজার টন। তারও আগের অর্থবছর চাল আমদানির পরিমাণ ছিল ১৩ লাখ ৫৯ হাজার টন। বর্তমানে চাল আমদানিতে বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে বাংলাদেশ, শীর্ষ অবস্থানটি চীনের দখলে। গত মৌসুমে বোরোর আশানুরূপ উৎপাদন এবং ফেব্রুয়ারিতে সমাপ্ত আমন মৌসুমে ভালো উৎপাদনের আশায় সরকার এ পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারি খাতে কোনো চাল আমদানির অনুমতি দেয়নি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) আশা করে, এবার আমন উৎপাদন দাঁড়াবে ১ কোটি ৭১ লাখ ৭৮ হাজার টনে, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আট লাখ টনেরও বেশি। অন্যদিকে মার্কিন কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) পূর্বাভাসে বলা হয়, এবার মৌসুমের শুরুতে প্রয়োজনীয় বৃষ্টির অভাবে একদিকে যেমন আমন রোপা কার্যক্রম দেরিতে শুরু হয়, অন্যদিকে আমন চাষের জমির পরিমাণ ২ দশমিক ৫৪ শতাংশ কমে ৫৭ দশমিক ৫০ লাখ হেক্টরে দাঁড়ায়। তাছাড়া নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে ঘূর্ণিঝড় মিধিলির কারণে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় জেলাগুলোর দণ্ডায়মান ধান ফসলের ৫-১০ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব কারণে ইউএসডিএ বাংলাদেশে এ বছর আমন উৎপাদন আগের প্রাক্কলন থেকে এক লাখ টন কমিয়ে ১ কোটি ৩৯ লাখ টনে নির্ধারণ করেছে। দেশে খাদ্যশস্য, বিশেষত চাল উৎপাদনে ডিএইর হিসাবের সঙ্গে ইউএসডিএর হিসাবের গরমিল নতুন নয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) চূড়ান্ত হিসাবে জানা যাবে এ বছর আমন উৎপাদনের প্রকৃত পরিমাণ। তবে অতীতের উদাহরণ থেকে অনেকটা জোর দিয়ে বলা যায়, ডিএইর হিসাবের সঙ্গে বিবিএসের হিসাবের তারতম্য ঘটবে অর্থাৎ বিবিএসের হিসাবে আমনের উৎপাদন হ্রাস পাবে। প্রকৃতপক্ষে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষি খাতের (শস্য উপখাত, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপখাত এবং বন উপখাত নিয়ে কৃষি খাত গঠিত) প্রবৃদ্ধি হ্রাস খাতটির সবচেয়ে বড় উপখাত শস্য খাতের প্রধান ফসল ধানের প্রবৃদ্ধি হ্রাসে প্রভাব ফেলেছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে কৃষি খাতের ৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেয়ে পরবর্তী এক দশকে গড়ে ৩ দশমিক ৭ শতাংশে দাঁড়ায় (অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা ২০১৯-২০)। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২৩-এ বলা হয়েছে, ‘২০২০-২১ অর্থবছরে কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ দশমিক ১৭ শতাংশ, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশে। সাময়িক হিসাব অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি দাঁড়াবে ২ দশমিক ৬১ শতাংশে।’ এর প্রভাব পড়ে চালের প্রবৃদ্ধি হারে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য মোতাবেক ২০১৯-২০ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত চাল উৎপাদনের গড় প্রবৃদ্ধি হার ছিল ১ শতাংশ। এদিকে ২০২০ ও ২০২১ সালে দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ১ দশমিক ৩৭ ও ১ দশমিক ৩ শতাংশ (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২২ ও ২০২৩)। এর অর্থ দাঁড়ায়, চাল উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের চেয়ে কম। এতে চাহিদার তুলনায় চালের ঘাটতি একটি স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে চাল আমদানি না হওয়ায় আমনের ভরা মৌসুমেই বাড়তে থাকে চালের দাম। ১০ জানুয়ারি বণিক বার্তার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ডিসেম্বরে বাজারে শুরু হওয়া আমনের সরবরাহ পুরাদমে চালু থাকলেও মিল, পাইকারি ও খুচরা সব পর্যায়ে চালের দাম বাড়ছে। শুধু পাইকারিতেই গত এক সপ্তাহে চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ৪-৬ টাকা। ১২ জানুয়ারি প্রতিদিনের বাংলাদেশের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আমন ধান কাটা-মাড়াই চলাকালে বাজারে পাইকারি থেকে খুচরা সব পর্যায়েই চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ৪ থেকে ১০ টাকা। এ বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বরাত দিয়ে বণিক বার্তায় ৩০ জানুয়ারির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি মোটা চাল ৫০-৫৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর মাঝারি ও সরু চাল প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে যথাক্রমে ৫০-৫৫ ও ৬২-৭৫ টাকায়। এক মাস আগের তুলনায় মোটা, মাঝারি ও সরু চালের দাম বেড়েছে যথাক্রমে ৬ দশমিক ১২, ২ দশমিক ৮৬ ও শূন্য দশমিক ৮৬ শতাংশ। ১৫ মার্চ যুগান্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত সাতদিনে গরিবের মোটা চাল এবং মাঝারি ও সরু চালের দাম বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) ১০০-২০০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। ফলে পাইকারি ও খুচরা বাজারেও হু হু করে বাড়ছে দাম। এমন পরিস্থিতিতে ‘দিন আনে দিন খায়’ এমন খেটে খাওয়া মানুষের এক কেজি মোটা চাল কিনতে ৫২-৫৪ টাকা খরচ করতে হচ্ছে। এতে সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়েছে স্বল্প আয়ের মানুষ। উল্লেখ্য, বিবিএসের এক হিসাবে জাতীয় পর্যায়ে একটি পরিবারের মাসিক মোট খরচের ৫৪ দশমিক ৮১ শতাংশ খরচ হয় খাদ্যে। আবার মাসিক মোট ব্যয়ের ৩৫ দশমিক ৯৬ শতাংশ ব্যয় হয় চাল কেনায়। চালের মূল্যবৃদ্ধির ক্ষতিকর প্রভাব নিম্নবিত্তের ওপর সবচেয়ে বেশি পড়লেও নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তরাও এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। চালের মূল্যস্ফীতিতে তাদের মাছ, মাংস, ডিমসহ আমিষজাতীয় খাবার কেনা কমিয়ে দিতে হচ্ছে। এতে তাদের পরিবারে, বিশেষ করে শিশু ও নারীদের পুষ্টির অভাব ঘটছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) সম্প্রতি জানিয়েছে, পণ্যের উচ্চ মূল্যের কারণে দেশের ১২ কোটি ৫২ লাখ মানুষ প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করতে পারছে না। এমনিতেই দেশের জনগণের পুষ্টিমান আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের অনেক নিচে। এতে অবস্থার আরো অবনতি ঘটবে। 

এখন দেখা যাক, চাল আমদানির সিদ্ধান্তে বাজারে স্বস্তি আসবে কিনা। সরকার বেসরকারি খাতের মাধ্যমে ৮৩ হাজার টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকার এ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে দেশে বর্তমানে মোট ধান-চালের পরিমাণ নির্ধারণে কোনো জরিপ চালিয়েছে কিনা জানা নেই। উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে পরিচালিত এক অনুসন্ধান রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৯ সালের জুনে ধানের মজুদে বড় ও মাঝারি কৃষকের অংশ ছিল ১৯ দশমিক ৮ শতাংশ। বাকি ৮০ শতাংশের মধ্যে ৬০ শতাংশের কিছুটা বেশি মজুদ ছিল চালকল মালিকদের কাছে। অবশিষ্ট কমবেশি ২০ শতাংশ মজুদ ছিল চাল ব্যবসায়ীদের কাছে। সরকার তাৎক্ষণিক জরিপের মাধ্যমে দেশে বর্তমানে চালের লভ্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে এত স্বল্প পরিমাণ চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকলে তা চালের সরবরাহ বৃদ্ধির মাধ্যমে চালের বাজারে স্বস্তি বয়ে আনবে না। দ্বিতীয়ত, বিবিএসের ২০১৬ সালের খানা আয় ও ব্যয় জরিপ অনুযায়ী, জাতীয় পর্যায়ে মাথাপিছু দৈনিক চালের ব্যবহার ৩৬৭ দশমিক ২ গ্রাম। সে হিসাবে দেশে দৈনিক চালের ব্যবহার কমবেশি এক লাখ টন। আমদানিতব্য ৮৩ হাজার টন চাল দেশের একদিনের খাবারের চাহিদা মেটাতে পারবে। এতে এপ্রিলে চাল সংকট সৃষ্টির আশঙ্কা থেকেই যাবে, যা পণ্যটির দামে আরো বৃদ্ধি ঘটাবে। এতে সাধারণ মানুষের জীবনে আরো দুর্ভোগ নেমে আসবে। তাই দেশব্যাপী চালের লভ্যতা বিবেচনায় নিয়ে চাল আমদানির ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ সরকারের জন্য সমীচীন হবে। 

মো. আবদুল লতিফ মন্ডল: সাবেক খাদ্য সচিব 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন