প্রকৃত যোদ্ধার মতোই অবদান রেখেছিলেন পণ্ডিত বারীণ মজুমদার

স্ত্রী ইলা মজুমদার, পুত্র পার্থ মজুমদার ও হারিয়ে যাওয়া কন্যার সঙ্গে বারীণ মজুমদার

উপমহাদেশের অন্যতম সংগীত শিক্ষক, রাগসংগীত বিশারদ ও উচ্চাঙ্গ সংগীতশিল্পী পণ্ডিত বারীণ মজুমদার। ছোটবেলা থেকেই সংগীতের প্রতি ভাব ভালোবাসায় নিজেকে আগ্রা ও রঙ্গিলা ঘরানার যোগ্য উত্তরসাধক হিসেবে তৈরি করেছিলেন। পাশাপাশি সংগীত শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের উন্মেষ পর্বে বারীণ মজুমদার নিজেকে যুক্ত করেছিলেন নানা ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে। তার পরিবার শিকার হয়েছে নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হারিয়েছেন নিজের কন্যাসন্তানকে। তার ছেলে সংগীত পরিচালক পার্থ মজুমদার-এর স্মৃতিতে মুক্তিযুদ্ধপূর্ব ও মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বাবা পণ্ডিত বারীণ মজুমদার এবং পুরো পরিবারের আত্মত্যাগের সে ইতিহাস বণিক বার্তার কাছে তুলে ধরেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সুমন দে

আলাপের শুরুতেই আপনাদের পরিবারের সংগীতের ইতিহাস নিয়ে জানতে চাই।

পাবনা জেলার রাধানগর মজুমদারপাড়ায় প্রখ্যাত জমিদার বংশ মজুমদার পরিবারে ১৯১৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি জন্ম নেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত শিল্পী ওস্তাদ বারীণ মজুমদার। জমিদার বাবা নীশেন্দ্রনাথ মজুমদার শাস্ত্রীয় সংগীতের ভক্ত ছিলেন, মাতা মণিমালা মজুমদার ভালো সেতার বাজাতেন। বাবা ১৯৩৮ সালে কলকাতায় ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছে প্রথম রীতি অনুযায়ী সংগীতের তালিম নিতে শুরু করেন। এরপর ১৯৩৯ সালে লক্ষ্ণৌর মরিস ‘কলেজ অব মিউজিক’-এ সরাসরি তৃতীয় বর্ষে ভর্তি হন তিনি। ১৯৪৩ সালে সে কলেজ থেকেই ’সংগীতবিশারদ’ ডিগ্রি পান। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর বাবা চলে আসেন পাবনায়। কিন্তু ১৯৫২ সালে বসতভিটাসহ পৈতৃক সম্পত্তি সরকারি দখলে চলে যায়। নিঃসম্বল হয়ে পরিবারসহ বাবা ১৯৫৭ সালে ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকা বেতার ও টেলিভিশনে বাবা নিয়মিত রাগসংগীত পরিবেশন করতেন। তার প্রচেষ্টায়ই ১৯৬৩ সালে ঢাকার সেগুনবাগিচায় প্রতিষ্ঠা হয় দেশের প্রথম সংগীত মহাবিদ্যালয়। ১৯৬৮ সালে সংগীত মহাবিদ্যালয়কে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজে পরিণত করেন।

মুক্তিযুদ্ধপূর্ব প্রেক্ষাপটে আপনার বাবার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড কেমন ছিল?

বৈরী পরিস্থিতি ও পরিবেশে সংগীত সাধনা এবং দেশে সংগীতের কাঠামোগত শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করায় ১৯৬৩ সালে বাবার সংগীত মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ছিল মুক্তিযুদ্ধের সাংস্কৃতিক সংগ্রামের উজ্জ্বল উদাহরণ। সংগীত মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর চক্ষুশূল হতে হয়েছে। খোদ পাকিস্তান সরকারেরও রায় ছিল না এতে এবং তৎকালীন শাসক মোনেম খাঁর মন্তব্য ছিল নেতিবাচক।

মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে ১৯৭০ সালের নভেম্বরে পূর্ব পাকিস্তানের উপকূল এলাকায় এক প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ১০ লক্ষ লোক মারা গিয়েছিল। সে সময় বাবা সারা পশ্চিম পাকিস্তানে ঘুরে ঘুরে চাঁদা তুলতে বেরিয়েছিলেন। তিনি তার ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে একটা ডান্স ড্রামা তৈরি করে ফান্ড কালেকশনের জন্য বের হন। দেশে এসে সে টাকা দিয়ে বাবা অনেক মানুষকে সহায়তা করতেন। এই যে কর্মযজ্ঞটি তিনি করেছিলেন, এর ফলেও তিনি পশ্চিম পাকিস্তানিদের চোখে পড়ে যান। 

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আপনাদের পরিবার কী ধরনের আক্রমণের শিকার হয়েছিল?

সেগুনবাগিচার সংগীত মহাবিদ্যালয়ের কোয়ার্টারে আমরা থাকতাম। বাবার জীবন সংগীতময় ছিল আর তাই পাকিস্তানিদের নীলনকশায় তার নামও ছিল। ২৫ মার্চ রাতে আমাদের ওই পুরো বিল্ডিংটা ট্যাংক দিয়ে ঘেরাও করে ফেলে পাকিস্তানি আর্মিরা। এরপর ফায়ার করা শুরু করে। বাবা তখন ওই বিল্ডিংয়ের সিঁড়ির নিচের একটা জায়গায় তিনিসহ আমাদের ঢুকিয়ে একটা আলমারি টেনে দেন। ওখানে আমরা ২৫ মার্চ রাত থেকে ২৭ মার্চ পর্যন্ত ছিলাম। আমরা দুই ভাই-বোন আর বাবা-মা। ২৭ মার্চ সকাল আটটা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল করা হলে সেদিন আমরা এক কাপড়ে বেড়িয়ে গেলাম। রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী জাহিদুর রহিম আমাদের তার বাসায় (সেগুনবাগিচা কোয়ার্টারের কাছেই) রেখেছিলেন। সে বাড়িতেও অ্যাটাকের সম্ভাবনা হলে তিনি আমাদের আবার পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। 

তাৎক্ষণিকভাবে রিকশা নিয়ে আমরা গ্যান্ডারিয়া ব্রিজ পার হয়ে নদীর কিনারায় গেলাম। নদী পার হওয়ার পরই পেছন থেকে ফায়ারিং শুরু হয়ে গেল। অন্যদের সঙ্গে আমরা ছুটছিলাম। কে কোথায় যাবে জানি না। কিছুদুর এগোতেই সামনে অনেক বড় একটা খাদ পড়ল। আমার মা দিদিকে নিয়ে পাড় হতে পারছিল না। তখন পেছন থেকে বাবার একজন পরিচিত ছাত্র দৌঁড়ে এল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে ছাত্র মাকে বলল, আপনি ওকে নিয়ে এ খাদ পার হতে পারবেন না। এই বলে মার হাত থেকে হেঁচকা টান দিয়ে দিদিকে নিজের কাঁধে করে নিয়ে দৌড় দিলেন। সেই যে দৌড় দিয়ে দিদিকে নিয়ে কোথায় চলে গেলেন, পরে দিদিকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

নানা ঘটনার পর বিক্রমপুরের হাসারায় একটা গ্রামে গিয়ে নিলু ডাক্তার নামে এক ডাক্তারের বাড়িতে আমরা আশ্রয় নিলাম। সেখানে মাসখানেক ছিলাম। আর এ ১ মাসের মধ্যে প্রতিদিন বাবা সকাল বেলা বেরিয়ে যেতেন আমার বোনকে খোঁজার জন্য আর ফিরতেন গভীর রাতে। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর সে ছাত্রকে খুঁজে বের করা হয়েছিল। তিনি কখনো বলেছেন, আমার বোন নৌকা ডুবিতে মারা গেছে। আসলে আমার দিদির ভাগ্যে কী ঘটেছিল—তা আমাদের পরিবারের কাছে এখনো অজানাই রয়ে গেছে। 

যাই হোক, এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে ছুটতে ছুটতে আগস্ট মাসের শুরুর দিকে আমরা মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলায় (বর্তমান উপজেলা মুজিবনগর) গ্রামে উপস্থিত হই। মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বাবাকে দেখে চিনতে পেরে বুকে জড়িয়ে ধরেন। তিনি আমাদের তিনজনকে আগরতলা থেকে কলকাতা যাওয়ার বিমানের টিকিটের ব্যবস্থা করে দেন। কলকাতা পৌঁছানোর পর বাবা সেখান থেকেই সৃজন-সংগ্রামের নানা কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ত্র হাতে তিনি যুদ্ধ না করলেও প্রকৃত যোদ্ধার মতোই অবদান রেখেছিলেন। 

মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে আপনাদের পরিবারকে নতুন বাস্তবতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল? 

৭১ সালে আমাদের সবকিছু হারিয়ে গেল, সবকিছু শেষ হয়ে গিয়েছিল। স্বাধীনতার পর বাপ্পার জন্ম হয়। বাপ্পাকে বাবা খুবই ভালোবাসতেন এবং সবসময় নিজের বুকের মধ্যে আগলে রাখতেন। বাপ্পার জন্মের পর আমার বাবা-মায়ের মধ্যে কন্যাকে হারানোর কষ্ট কিছুটা লাঘব হয়। 

যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর সংগীত মহাবিদ্যালয়কে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করার কাজে মনোনিবেশ করেন বাবা। নিজের জমি একটু একটু করে বিক্রি করে তিনি সংগীত মহাবিদ্যালয়ের পরিচালনার কাজ করতেন। কিন্তু বাবাকে থামিয়ে দেয়ার জন্য নতুন করে আবারো ষড়যন্ত্র শুরু হয়। আমাদের পরিবারের ওপর নতুন করে আবারো আঘাত নেমে আসে। ১৯৭৮ সালে বাবার প্রতিষ্ঠিত সংগীত মহাবিদ্যালয়ের গ্রান্ট তসরুপ করার দায়ে মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয় বাবার বিরুদ্ধে। এ মামলায় ১৮ দিন বাবাকে হাজত বাস করতে হয়ছিল। আমরা তখন মগবাজারের যে ভাড়া বাড়িতে থাকতাম, সে বাড়িটিও কেড়ে নেয়া হয় এবং এক কাপড়ে আমাদের বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়। নিঃস্ব, রিক্ত হয়ে আমরা চারজন তখন সংগীত মহাবিদ্যালয়েরই এক ছাত্রীর ফ্ল্যাটে গিয়ে উঠি। আর এখান থেকে আমাদের নতুন সংসারের সূচনা হয়। এরপর মায়ের ঐকান্তিক চেষ্টায় সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে দিনশেষে বারীণ মজুমদারেরই জয় হয়েছে। আজ রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নিজস্ব জায়গায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সংগীত মহাবিদ্যালয়। 

আপনাদের পরিবারের সংগীতের যে ঐতিহ্য ও অবদান, এর ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে কি? 

আমার বাবার জীবনে পার্থিব সম্পদের অভাব ছিল না। তিনি ছিলেন বিশাল জমিদার পরিবারের সন্তান। কিন্তু সংগীতের পারিবারিক যে পরিবেশ তাকে ঋদ্ধ করেছিল, তার ডাকে তিনি সর্বস্ব ত্যাগ করেছেন। বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ একদিকে যেমন ছিল গণসংগ্রামের ধারাবাহিকতা, তেমনি সাংস্কৃতিক সংগ্রামের প্রতিফল। দেশের ভেতরে শ্বাসরুদ্ধকর ভয়ংকর পরিবেশে বিচ্ছিন্ন ও মৃত্যুতাড়িতভাবে দিন কাটাতে হয়েছে। দেশান্তরি জীবনের নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও মুক্তিযুদ্ধের সংস্কৃতি তথা শিল্পের আয়ুধ শাণিত করে লড়ার প্রত্যয় তিনি হারাননি। সংগীতে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার বাবাকে ১৯৮৩ সালে একুশে পদক ও ২০০১ সালে সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার স্বাধীনতা পদক (মরণোত্তর) প্রদান করে। এছাড়া বাবা তার জীবদ্দশায় বরেন্দ্র একাডেমির সংবর্ধনা, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি থেকে গুণীজন সম্মাননা, জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ থেকে রবীন্দ্র পদক, বেতার টেলিভিশন শিল্পী সংসদ থেকে শিল্পী শ্রেষ্ঠ খেতাবসহ নানা সম্মাননা পেয়েছেন।

বর্তমানে আমি ও আমার ছোট ভাই বাপ্পা মজুমদার সক্রিয়ভাবে সংগীতের সঙ্গে যুক্ত রয়েছি। বাবার নির্দেশনা অনুযায়ী ‘‌সুরের সংগীতটাই’ দুজন ধারণ করে চলেছি। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন