খসরুর যাপনচিত্র

মইনুদ্দীন খালেদ

কলাকেন্দ্রের গ্যালারিতে ভিডিও ইনস্টলেশনে মুহম্মদ খসরু

কলাকেন্দ্রের গ্যালারির পাঁচটি কক্ষের দেয়ালজুড়ে ভাসছে একটি মানুষের যাপনের চিত্র। কোনোটা চিত্রস্থির, কোনোটা চলমান। ভিডিও ইনস্টলেশনে যে মানুষটিকে অজস্র ইমেজে উপস্থাপন করা হয়েছে, তার নাম মুহম্মদ খসরু। কে এই খসরু? এ প্রশ্ন নতুন প্রজন্মের কেউ না কেউ করতেই পারেন। তবে বয়স্ক প্রজন্মের অনেকেই এ প্রশ্ন করেছিলেন যখন তার মরদেহটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন প্রাঙ্গণে রাখা হয়েছিল। কফিন ঘিরে কাঁদছিলেন তার ভক্তরা। খসরু লোকান্তরিত হয়েছেন ২০১৯-এর ১৯ ফেব্রুয়ারি। বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। যখন কানাঘুষায় উৎসুক মানুষের অনেকে জানতে পারল খসরু চলচ্চিত্র অঙ্গনের লোক, তখন প্রশ্ন শুরু তিনি কী কী ছবি বানিয়েছেন, কোন কোন ছবিতে অভিনয় করেছেন। এ প্রশ্ন শুধু সাধারণজনেরা নয়, অনেক সাংবাদিকও করেছিলেন। না, না, তিনি ছবি বানাননি, অভিনয়ও করেননি, তবু তিনি চলচ্চিত্রের সাধক। তিনি সৎ চলচ্চিত্র পঠন-পাঠনের মাধ্যমে এ দেশের মানুষকে শিল্পসচেতন, সমাজসচেতন এবং শিল্পের যে একটি প্রতিবাদী অঙ্গীকার আছে তা বোঝাতে চেয়েছেন। ভিড় বাড়ে, আবার আমরা প্রশ্নের সম্মুখীন হই এবং উত্তর দিই। কোনো সাংবাদিক খুব আকুতিমিনতি করে বলেন যে বিষয়টা যদি একটু বিস্তারিত করে বলি। অশ্রুসিক্ত মুখে বাকরুদ্ধ গলায় আমরা জানাই, এ দেশে ১৯৬৩ সালে পাকিস্তান ফিল্ম সোসাইটি বলে একটা প্রতিষ্ঠান হয়। স্বাধীনতার পর এ প্রতিষ্ঠানের নাম হয় বাংলাদেশ ফিল্ম সোসাইটি (বিএফএস), বাংলায় বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ। ষাটের দশকে জন্মলগ্ন থেকেই মুহম্মদ খসরু এ চলচ্চিত্র সংসদে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। তার সঙ্গে ছিলেন দেশের অনেক গুণীজন। কিন্তু সার্বিক কর্মযজ্ঞ তাকেই পালন করতে হয়েছে। বাধ্য হয়ে নয়, চলচ্চিত্রের প্রতি আসক্তির কারণে। ষাটের দশকের শেষে চলচ্চিত্র সংসদের দায়দায়িত্ব ও অন্বিষ্ট কী, তা বোঝানোর জন্য সংসদের সুবিখ্যাত জার্নাল ‘ধ্রুপদী’র প্রথম সংখ্যায় খসরু একটি প্রবন্ধ লেখেন। এটিই এ দেশে চলচ্চিত্র সংসদবিষয়ক প্রথম লেখা। ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ’ এ দেশের প্রথম চলচ্চিত্র সংসদ, যা সিনেমা ক্লাব বলেও একে নামকরণ করেছে পৃথিবীর অনেকটা দেশে। এ চলচ্চিত্র সংগঠনের প্রধান দায়িত্ব সৎ চলচ্চিত্র বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করে তোলা। 

চলচ্চিত্র যেহেতু বিপুল অর্থ বিনিয়োগে নির্মাণ হয়, তাই একে মুনাফা লোটার জন্য জনতার পকেটে হাত দিতে হয়। বিনিয়োগ অর্থাৎ পুঁজির খেলা মানেই শিল্পকে মনোরঞ্জনি করে পাবলিকের কাছে সুপাচ্য সুস্বাদু খাদ্য করে তোলা। সস্তা না করলে পাবলিক নেবে না। বিনোদনে যদি বিশেষ প্রমোদ না থাকে, তবে তা সর্বস্তরে হানা দিতে পারে না। তাই সিনেমা সর্বব্যাপী, সর্বগ্রাসী, সবচেয়ে শক্তিশালী মুনাফা উৎপাদনকারী শিল্প। দেশজ সংস্কৃতিকে কলুষিত করার ক্ষেত্রে সিনেমা সবচেয়ে সক্রিয়। অন্যপক্ষে মানুষকে মানবিক বোধে উন্নীত করার ক্ষেত্রে ও বৈপ্লবিক প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করার প্রয়োজনে সিনেমাই সবচেয়ে শক্তিধর শিল্পাস্ত্র। তাই জনপ্রিয় সস্তা কুরুচিপূর্ণ ছবির কবল থেকে দর্শককে রক্ষা করার দায় পালন করতে হয় ব্যক্তি ও সংগঠনকে। এ দেশের চলচ্চিত্র সংসদের পুরোধাপুরুষ খসরু সেই দায়িত্ব পালন করেছেন।

স্বাধীনতার পর চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের কর্মকাণ্ড বিশেষ গতি লাভ করে। বিভিন্ন সংসদে প্রচুরসংখ্যক সংসদকর্মীর আগমন ঘটে। এর মধ্যে মুহম্মদ খসরুর সুপরিকল্পিত আয়োজনে এ দেশের বিভিন্ন প্রজন্মের মানুষ পৃথিবীর নানা দেশের শিল্পমানসম্পন্ন বিখ্যাত ছবি দেখার সুযোগ লাভ করে। ফলে সিনেমা সম্বন্ধে শ্রদ্ধা জাগ্রত হয় এ দেশের কবি, শিল্পী, সাহিত্যিকদের। এর আগে এ দেশের বিভিন্ন শিল্পমাধ্যমের গুণীজনেরা চলচ্চিত্র বিষয়ে ছিলেন অনীহ এবং অন্য শিল্পের তুলনায় সিনেমা শিল্প কিনা এ নিয়েও তাদের মনে ছিল সংশয় ও মূর্খ দ্বিধাবোধ। মুহম্মদ খসরুর মূল লক্ষ্য ছিল নবীন প্রজন্ম। তাই তিনি সংসদে প্রদর্শিত ছবির দর্শকের খোঁজে হানা দিতেন প্রধানত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, আর্ট কলেজের (বর্তমানে ঢাবির অনুষদ) বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীদের তিনি সিনেমামুখী করেছিলেন। বুঝিয়েছিলেন সৎ চলচ্চিত্র পাঠের গুরুত্ব। এ আয়োজন শুধু রাজধানী ঢাকায় সীমায়িত ছিল না; বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদের শাখা বিস্তার করেছিল চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনায়ও।

আজ যে এ দেশের মানুষ পৃথিবী বিখ্যাত চলচ্চিত্র সম্বন্ধে জানে-চেনে খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার, অভিনেতা-অভিনেত্রী ও অন্য কলাকুশলীদের তা চলচ্চিত্র সংসদের ছবি প্রদর্শন, চলচ্চিত্র বিষয়ে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, কর্মশালা আয়োজনের ফলে হয়েছে। এছাড়া চলচ্চিত্রবিষয়ক জার্নাল ও গ্রন্থ প্রকাশ করে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদের এ কাণ্ডারি চলচ্চিত্রনিষ্ঠ মানুষদের শিক্ষা-দীক্ষায় উদ্দীপ্ত করার স্থায়ী ব্যবস্থা করে গেছেন। গুরুত্ববহ অবশ্যপাঠ্য চলচ্চিত্রবিষয়ক যত লেখা এ দেশে প্রকাশিত হয়েছে, তার প্রায় পুরোটাই হয়েছে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদের প্রকাশনায়। এসব জার্নালেরই সম্পাদক মুহম্মদ খসরু।

খসরুর অর্জন বহুমাত্রিক। এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে চলচ্চিত্রবিদ্যা পাঠের প্রয়োজনীয়তার কথাও তিনিই প্রথম উত্থাপন করেন। ফিল্ম আর্কাইভ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এ চলচ্চিত্রসাধকের অবদান সর্বাগ্রে স্মরণীয়। কিন্তু এ পোড়ার দেশে বিদগ্ধজনের মূল্যায়ন হয় না। আর্কাইভ প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে লেখা হয়নি তার নাম। উপমহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্রকার হীরালাল সেনের জন্ম মানিকগঞ্জে। এ তথ্যটুকু লেখা ছিল চলচ্চিত্রের ইতিহাস গ্রন্থে। কিন্তু হীরালাল সেনের বসতভিটা মানিকগঞ্জের কোথায় এবং কেন তিনি প্রথম চলচ্চিত্রকার হিসেবে ইতিহাসে স্বীকৃত নন—কেন এ বিস্মৃতি ও অবমাননা—তা খসরুকে তাড়িত করেছে। তাই ১৯৮৪ সালে মুহম্মদ খসরুর উদ্যোগে আমি ও আমার এক বন্ধু মানিকগঞ্জ গিয়ে হীরালাল সেনের বসতভিটার শেষ স্মৃতিচিহ্নটুকু আবিষ্কার করি। পরবর্তী সময়ে হীরালাল স্মৃতি বক্তৃতা ও ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্রবিষয়ক কর্মশালা আয়োজন করে উপমহাদেশের এ চলচ্চিত্রকারকে ইতিহাসে প্রতিষ্ঠিত করে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ। মুহম্মদ খসরুর কাছে দীক্ষালাভ করেই তারেক মাসুদ, তানভীর মোকাম্মেল, শামীম আখতার প্রমুখ এ দেশে নতুন শিল্পগুণসম্পন্ন চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। বলা যায়, এ চলচ্চিত্রকাররা চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের জাতক। ওহিদুল হক, শামসুর রাহমান, মাহমুদুল হক, বেলাল চৌধুরী, রবিউল হুসাইন, কাইজার চৌধুরী, মাহবুব আলম প্রমুখ যে চলচ্চিত্রবিষয়ক সারগর্ভ প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন, তারও মূল প্রেরণা ও তাগাদা মুহম্মদ খসরুর। 

চলচ্চিত্র তার ধ্যানের প্রধান ভরকেন্দ্র হলেও সাহিত্য, সংগীত ও আলোকচিত্রেও তার মনোযোগ ছিল বিরলতুল্য। তিনি প্রচল ধারার সাহিত্যপাঠে আস্থাশীল ছিলেন না। তাই বিকল্প ধারার সাহিত্য ও ছোট কাগজে প্রকাশিত লেখা প্রতিনিয়ত পাঠ করতেন। তিনি পেশায় ও নেশায় ছিলেন আলোকচিত্রী। ছবি তুলেছেন প্রচুর নদীর ও নারীর। পাপক্ষয়ের জন্য তিনি বাঁশি বাজাতেন রাত গভীরতর হলে। মানুষকে যত করে ভালোবেসেছেন, ততই গালমন্দ করেছেন। তার অম্লীয় কথায় বেশি দগ্ধ হয়েছেন সরকারি-বেসরকারি ডাকাবুকো ব্যক্তিরা। নারীকে শ্রদ্ধা করে, শিশুকে ভালোবেসে, জীবনকে সদ্ব্যর্থক ধ্যানে স্থির রেখে চিরকুমার মানুষটি চারণ চলচ্চিত্রজন হিসেবে যাপন করে গেছেন জীবন। তিনি আজ আমাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এক অবশ্যপাঠ্য বিষয়। তার ব্যক্তিত্বের মোহন টানের খবর জানতে যারা তাঁকে জীবিতাবস্থায় দেখেনি, তারাও ছুটে এসেছে কলাকেন্দ্রের ভিডিও ইনস্টলেশন দেখতে। শিল্পী ওয়াকিলুর রহমান, কামরুল হাসান মিথুন ও অমিতাভ সরকারের একনিষ্ঠ উদ্যোগের ফলে খসরুজীবনের চলচ্চিত্রপাঠ দেখার সুযোগ পেল ছবিপ্রিয় দর্শক। 

লেখক: শিল্প সমালোচক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন