পিএইচডি ও অধ্যাপকের আধিক্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

ফাতেমা-তুজ-জিনিয়া

ছবি : বণিক বার্তা

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) দর্শন বিভাগ। শিক্ষকের সংখ্যা ২১। তাদের মধ্যে ১৬ জনই পিএইচডি ডিগ্রিধারী। রাবি থেকেই সবাই পিএইচডি সম্পন্ন করেছেন। শুধু দর্শন নয়, বিশ্ববিদ্যালয়টির সবক’টি বিভাগেই কমবেশি এমন চিত্র দেখা যায়।

বর্তমানে দেশে পিএইচডি ডিগ্রিধারী শিক্ষকের হার সবচেয়ে বেশি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষকসংখ্যা ১ হাজার ৮১। তাদের মধ্যে ৮৯৬ জনই পিএইচডিধারী, যা মোট শিক্ষকের প্রায় ৮৩ শতাংশেরও বেশি। আবার যাদের পিএইচডি সম্পন্ন করা নেই, তাদের মধ্যেও অধিকাংশই এমফিল বা সমমানের ডিগ্রিধারী। তাদের মধ্যেও অধিকাংশই এ ডিগ্রি সম্পন্ন করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই।

শুধু পিএইচডিধারী নয়, মোট শিক্ষকের মধ্যে অধ্যাপকের হার বিবেচনায়ও রাজশাহী শীর্ষে। ইউজিসির তথ্য অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষকদের মধ্যে অধ্যাপক আছেন ৬৪৮ জন বা প্রায় ৬০ শতাংশ। অন্যান্যের মধ্যে ৩০৫ জন সহযোগী অধ্যাপক ও ১০৯ জন সহকারী অধ্যাপক। আর প্রভাষক আছেন সাকল্যে মাত্র ১৯ জন।

মোট শিক্ষকের ৮০ শতাংশের বেশি পিএইচডিধারী এবং প্রায় ৬০ শতাংশ অধ্যাপক হলেও দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে র‍্যাংকিংয়ে তেমন একটা উল্লেখযোগ্য অবস্থানে নেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষণা সংস্থা কোয়াককোয়ারেল সাইমন্ডসের (কিউএস) র‍্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে রাবির অবস্থান অষ্টম। আর এশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ৪৫১তম। 

শিক্ষাবিদরা মনে করছেন, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে প্রতি বছর যে পরিমাণ পিএইচডি দেয়া হচ্ছে, তা অস্বাভাবিক। দেশে পিএইচডি ডিগ্রিকে সহজ করা হয়েছে, ফলে গবেষণার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। আবার শিক্ষকদের অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতির ক্ষেত্রেও উন্নত বিশ্বের দেশগুলোয় শিক্ষা কার্যক্রমের পাশাপাশি গবেষণায়ও ব্যাপক মাত্রায় সম্পৃক্ত থাকতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশে শিক্ষকরা অনেক সময় উল্লেখযোগ্য গবেষণা না করেও শুধু দীর্ঘ সময় একাডেমিক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত থেকেই অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পেতে পারেন। ফলে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে অধ্যাপকের সংখ্যা বাড়লেও মানসম্মত গবেষক বাড়ছে না। সে কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো র‍্যাংকিংয়েও এগোতে পারছে না।

কারো ভালো গবেষণা, বোঝাপড়া না থাকলে তাকে অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি দেয়া উচিত নয় বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘‌অধ্যাপক হওয়া কঠিন করা উচিত। আবার আমরা দেখি, কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক বেশি। কিন্তু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় বা জেলা শহরগুলোয় থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকের সংখ্যা খুবই কম। অধ্যাপকরা এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে চান না, থাকতে চান না। আবার পিএইচডি ডিগ্রিকেও অনেক সহজ করে ফেলা হয়েছে। আমরা প্রায়ই গবেষণায় চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ শুনছি, যা কাম্য নয়। মানসম্মত গবেষণা নিশ্চিতে অবশ্যই সৃজনশীল গবেষণা এবং ভালো সুপারভাইজার নিশ্চিত করতে হবে।’

পিএইচডিধারী শিক্ষকদের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের প্রায় ৯০ শতাংশ শিক্ষক রাবি থেকেই পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন করেছেন। রাবি ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, দর্শন বিভাগের পিএইচডিধারী শিক্ষক ১৬ জন। ইতিহাস বিভাগে নয় শিক্ষকের মধ্যে ছয়জন, ইংরেজি বিভাগের তিনজনের মধ্যে দুজন, বাংলা বিভাগের ১৩ জনের মধ্যে ১২ জন, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ১৫ জনের মধ্যে ১৪ জন, আরবি বিভাগের ১৭ জনের সবাই, থিয়েটার বিভাগের ১০ জনের নয়জন, সংগীত বিভাগের পাঁচজনের তিনজন, পার্সিয়ান ভাষা ও সংস্কৃতিতে ১০ জনের আটজন, সংস্কৃত বিভাগের আটজনের সাতজন এবং উর্দু বিভাগের ছয়জন পিএইচডি ডিগ্রিধারী শিক্ষকের সবাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ইনস্টিটিউট ও বিভাগ থেকে উচ্চতর এ ডিগ্রি নিয়েছেন। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কলা অনুষদের ডিন মো. বেলাল হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌বিদেশে পিএইচডির ক্ষেত্রে বড় সমস্যা ফান্ড। যেমন কলা অনুষদভুক্ত বিষয়গুলোয় বিদেশে সহজে স্কলারশিপ পাওয়া যায় না। আবার শিক্ষকদের বেশির ভাগেরই স্কলারশিপ না পেলে দেশের বাইরে পড়তে যাওয়ার সামর্থ্যও থাকে না। অনেকের পারিবারিক বিভিন্ন দায়বদ্ধতা থাকে। ফলে তারা দেশেই পিএইচডি বেছে নেন। তবে বিদেশে পিএইচডিকে আমরা সবসময়ই উৎসাহিত করি। কারণ এর মাধ্যমে শিক্ষকদের জ্ঞানের পরিধি বাড়ে বেশি।’

রাবির অন্য অনুষদগুলোর মধ্যে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ব্যবসায় শিক্ষা, আইন, কৃষি, জীববিজ্ঞান ও চারুকলা অনুষদভুক্ত বিভাগগুলোয়ও অধিকাংশ শিক্ষকই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম বিজ্ঞান ও ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদ।

বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষকদের দাবি, এখানে মানসম্মত পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ থেকে প্রতিষ্ঠার পর থেকে মোট ৪০৭ জনকে পিএইচডি ডিগ্রি দেয়া হয়েছে। এ ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. নেজামুল হক বলেন, ‘‌আমাদের ইনস্টিটিউটের কাঠামো বিবেচনা করলে এটি দেশের অন্যতম সেরা ইনস্টিটিউট। আমরা সবসময়ই আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা নিশ্চিত করতে চেষ্টা করি। সার্বিকভাবে আমরা আমাদের পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে সন্তুষ্ট।’

পিএইচডির মতো অধ্যাপকেরও প্রাচুর্য দেখা যায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। যদিও সে তুলনায় নতুন শিক্ষক বা প্রভাষকের সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। এর একটি বড় উদাহরণ হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ। এখানে মোট শিক্ষক আছেন ৩৫ জন। তাদের মধ্যে ৩২ জনই অধ্যাপক। বাকি তিনজনের মধ্যে দুজন সহযোগী অধ্যাপক। অন্যজন সহকারী অধ্যাপক। বিভাগটিতে প্রভাষক নেই একজনও। শুধু রসায়ন নয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মোটামুটি সবক’টি বিভাগেই কমবেশি একই চিত্র।

বিধিমালা ও বর্তমান বাস্তবতাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এমন চিত্র দেখা দেয়ার বড় কারণ বলে মনে করছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ড. প্রণব কুমার পাণ্ডে। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘‌আমাদের দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের পদোন্নতির জন্য নিজস্ব বিধিমালা রয়েছে। প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিমালা অনুযায়ী দেখা যায়, আমাদের দেশের শিক্ষকরা নির্ধারিত কয়েক বছর শিক্ষকতা করলে আর এক-দুটো প্রকাশনা থাকলেই অধ্যাপক হয়ে যেতে পারেন। এক্ষেত্রে কে ভালো গবেষণা করছেন বা কে গবেষণা করছেন না, সেটি খুব একটা প্রভাব ফেলে না। ফলে দেখা যায় একটু পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অধ্যাপকের সংখ্যা অত্যন্ত দ্রুত বাড়ছে।’

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি অধ্যাপক রয়েছেন বিজ্ঞান অনুষদে। এ অনুষদে ১৭৪ শিক্ষকের মধ্যে অধ্যাপক রয়েছেন ১৪২ জন। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে কলা অনুষদ। এ অনুষদে ১৫৩ শিক্ষকের মধ্যে অধ্যাপক ১১৬ জন। এছাড়া সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ব্যবসায় শিক্ষা, আইন ও চারুকলা অনুষদভুক্ত বিভাগগুলোয়ও প্রায় ৫০ শতাংশের বেশি শিক্ষক অধ্যাপক। শুধু ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদে অধ্যাপকের হার ৫০ শতাংশের নিচে।

বিশ্ববিদ্যালয়টির বিভাগগুলোর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৫৯টি বিভাগের মধ্যে মাত্র ১১টিতে একজন বা দুজন করে প্রভাষক রয়েছেন। বাকি ৪৮টি বিভাগ পুরোপুরি প্রভাষকশূন্য। সমাজকর্ম বিভাগে ২১ শিক্ষকের সবাই অধ্যাপক। বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকিউলার বায়োলজি বিভাগের ৩৮ শিক্ষকের মধ্যে ৩৪ জনই অধ্যাপক। বাকি চারজন সহযোগী অধ্যাপক। রসায়ন বিভাগে ৩৫ শিক্ষকের ৩২ জনই অধ্যাপক। এছাড়া বিজ্ঞান, কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ছয় বিভাগে অধ্যাপকের হার ৮০ শতাংশের ওপর। 

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ড. মো. হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘‌আমাদের প্রভাষক সংখ্যা কম হওয়ার কারণ দীর্ঘদিন নিয়োগ বন্ধ। আর যারা অধ্যাপক হচ্ছেন, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী যোগ্যতা প্রমাণ করেই হচ্ছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই ভালো মানের গবেষকও। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা অবশ্যই আরো বৃদ্ধি পাওয়া উচিত। বিশেষ করে গবেষণায় যুক্ত হওয়া প্রত্যেক শিক্ষকের দায়িত্ব। যদি কোনো শিক্ষক গবেষণায় যুক্ত না হন তবে তিনি দায়িত্বে অবহেলা করছেন।’

তিনি আরো বলেন, ‘‌আমাদের সব পিএইচডি ডিগ্রি মানসম্পন্ন হচ্ছে, এটি বলব না। আমাদের অবশ্যই মান আরো বৃদ্ধি করা উচিত। আর বিদেশে যখন কেউ উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করেন তখন তিনি নতুন অনেক কিছু শিখতে পারেন, যা তার জ্ঞানের পরিধি বাড়ায়। এতে আমাদের শিক্ষাঙ্গনও আরো বেশি সমৃদ্ধ হয়। তাই বিদেশে উচ্চ শিক্ষাকে আমরা সবসময় উৎসাহিত করি। কিন্তু মাঝে আমাদের কিছু প্রশ্নবিদ্ধ নিয়োগ হয়েছে, যাদের অনেকের যোগ্যতা আশানুরূপ নয়। তারা শিক্ষকতাকে শুধু চাকরি হিসেবে নিচ্ছেন। এর একটা প্রভাব সামগ্রিকভাবেও পড়ছে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ে পদোন্নতির ক্ষেত্রে গবেষণাকে আরো বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেন, ‘‌দেশে মানসম্মত উচ্চ শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে অবশ্যই শিক্ষকদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে গবেষণার গুরুত্ব আরো বাড়াতে হবে। তবে শুধু নীতিমালা করে হবে না। শিক্ষায় বরাদ্দও বাড়াতে হবে। ভালো গবেষকদের গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক সহযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন