উৎপাদনস্বল্পতায় সংকটে মাছ রফতানি

ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে চট্টগ্রামের অর্ধেকের বেশি প্রতিষ্ঠান

দেবব্রত রায়, চট্টগ্রাম ব্যুরো

ছবি : বণিক বার্তা ( ফাইল ছবি)

ইউরোপ কিংবা আমেরিকায় ভেনামি জাতের চিংড়ির চাহিদা বাড়ছে ক্রমশ। কিন্তু দেশীয় চিংড়ির চাহিদা বিদেশে কমে যাওয়া এবং দেশের বাজারে ভেনামি চিংড়ি উৎপাদন না হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজার হারিয়েছেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা। ২০০০ সাল-পরবর্তী মৎস্য রফতানিতে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের একক আধিপত্য থাকলেও দুই দশকের মধ্যে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে অর্ধেকের বেশি প্রতিষ্ঠান। অঞ্চলের ৫৪টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২৪টি চালু থাকলেও বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে আরো কয়েকটির উৎপাদন।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদেশে চিংড়ির চাহিদা থাকে ৯০ শতাংশ, যার বেশির ভাগই ভেনামি চিংড়ি, কিন্তু বাংলাদেশে ভেনামি চিংড়ি উৎপাদন সেভাবে না হওয়ায় গলদা বা বাগদা চিংড়ি রফতানি করতে হচ্ছে। তবে চিংড়ির বৈদেশিক চাহিদা না থাকায় দেশীয় যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রফতানির সঙ্গে যুক্ত ছিল তারা বিদেশী অর্ডার না পাওয়ায় তাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার খরচ তোলা এবং ব্যাংকের ঋণ বা সুদ টানতে গিয়ে দেশীয় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

চট্টগ্রামের মৎস্য পরিদর্শন মান নিয়ন্ত্রণ দপ্তরের তথ্যমতে, চট্টগ্রামে ২০০৬ সালে প্রায় ৫৪টি প্রতিষ্ঠান রফতানির সঙ্গে যুক্ত ছিল। ২০২২ সালে ২৭টি রফতানির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও ২০২৩ সালে নিবন্ধন নিয়েছে মাত্র ২৪টি। অর্থাৎ দেড় যুগে শুধু চট্টগ্রামের ৩০টি প্রতিষ্ঠান তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নিয়েছে। ২৪টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে গড়ে ১০-১২টি তাদের কার্যক্রম পূর্ণাঙ্গভাবে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বাকিগুলো চলছে কোনো রকমে। গত দেড় যুগে বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্যতম মিনহার সি ফুড লিমিটেড মিনহার ফিশারিজ। এছাড়া ফিশ প্রিজারভার লিমিটেড, আকুয়া ফুড, কনসেফশন সি ফুড লিমিটেড, কুলিয়াচর সি ফুড, সার অ্যান্ড কোং লিমিটেড, মাহী ফিশ কোম্পানি অন্যতম।

প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার বিষয়ে ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিদেশে চিংড়ির চাহিদা বেশি কিন্তু হিমায়িত সাদা মাছের চাহিদা কম। বাংলাদেশে ভেনামি চিংড়ি উৎপাদন না হওয়ায় অন্যান্য চিংড়ির রফতানি কমে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা বাজারে টিকতে পারেননি।

বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফইএ) পরিসংখ্যান বলছে, দেশে মৎস্য রফতানি খাতে যুক্ত আছে ১০৮টি প্রতিষ্ঠান। সর্বশেষ ২০২৩ সালে চালু ছিল ৪০টির মতো। এর মধ্যে গড়ে ২০টি প্রতিষ্ঠান উৎপাদন প্রক্রিয়াকরণের কাজ করছে। বাকিগুলো কোনো রকমে চালু আছে। রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর মৎস্য প্রক্রিয়াকরণের ক্ষমতা লাখ ৫০ হাজার টন হলেও মাত্র ৩০-৪০ হাজার টন ধারণক্ষমতা ব্যবহার হচ্ছে। অর্থাৎ প্রায় ৮৮ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্ষমতা অব্যবহৃত আছে। দেশের প্রায় লাখ ৬২ হাজার ৯৮০ হেক্টর জমিতে চিংড়ি চাষ হয়ে থাকে। এর মধ্যে প্রায় দুই লাখ হেক্টরে চাষ হয় বাগদা চিংড়ির। বাগদা হ্যাচারি ৫০টি গলদার হ্যাচারি রয়েছে ৩৯টি।

সংগঠনের দেয়া রফতানির তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৫৫ কোটি ডলারের ৪৭ হাজার ৬৩৫ টন হিমায়িত চিংড়ি রফতানি করা হয়। সেখানে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২৫ হাজার টনের ৩০ কোটি লাখ ডলারের হিমায়িত চিংড়ি রফতানি হয়েছে। অর্থাৎ গত এক দশকে ২২ হাজার টনের বেশি হিমায়িত চিংড়ি রফতানি কমেছে। যার বাজার দর ২৫ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) চিংড়ি হিমায়িত মাছ রফতানি হয়েছে ২১৫ মিলিয়ন ডলার। যেখানে এই সময়সীমার মধ্যে রফতানির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২২৮ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এই সময়ে প্রায় দশমিক ৭৬ শতাংশ রফতানি কম করেছে বাংলাদেশ।

বিএফএফইএর সভাপতি মো. কাজী বেলায়েত হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘প্রক্রিয়াকরণ মাছ রফতানিতে একসময় নেতৃত্ব দিতেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা। কিন্তু গত কয়েক বছর শুধু চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা নন দেশের প্রতিটি অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। দেশে উৎপাদন বৃদ্ধি ঠিকই হচ্ছে, তবে বিদেশীদের চিংড়ির চাহিদা আমরা পূরণ করতে পারছি না। কারণে রফতানি কমে আসছে।

চট্টগ্রামের মৎস্য পরিদর্শন মান নিয়ন্ত্রণ দপ্তরের উপপরিচালক মো. শাহজাদা খসরু বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিদেশে ভেনামি চিংড়ির চাহিদা বেশি। কিন্তু দেশী প্রতিষ্ঠানগুলো চাহিদা অনুযায়ী হিমায়িত মাছ সরবরাহ করতে পারছে না। তাছাড়া বিভিন্ন সংকটের কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। যেসব প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন আছে সেগুলোর মধ্যে কিছু সক্ষমতার অর্ধেকও ব্যবহার করতে পারছে না। রফতানিকারক দেশে চাহিদা অনুযায়ী যদি মাছ সরবরাহ করা যায় তাহলে এই খাতের সম্ভাবনা আরো বাড়বে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন