বিশ্লেষণ

সহজে পাওয়া ঋণ অনেক সময় অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকারক হয়ে দাঁড়ায়

আবু আহমেদ

ছবি : বণিক বার্তা

২০২২-এর শুরু থেকেই বিপর্যয়ের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল। ২০২৩ সালে ২০২২ অপেক্ষা আমরা যথেষ্ট পিছিয়েছি। মূল্যস্ফীতির চাপ যে বাড়ছিল তা ২০২২ থেকেই সংকেত দিচ্ছিল। বৈশ্বিক অর্থনীতির দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখব, যুক্তরাষ্ট্র পলিসি রেট বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ (ইসিবি) প্রধান অর্থনীতিগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেদিকেই এগিয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভকে গত বছর বেশ সফলই বলা যায়।

আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদহার কয়েক দফা বাড়িয়েছে। তবে আমাদের নীতিনির্ধারক বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যারা আছেন তাদের বুঝতে হবে, আমাদের মূল্যস্ফীতি একটু অন্য রকম। আমাদের মূল্যস্ফীতিটা মনিটারি ফেনোমেনন নয়। মুদ্রার সম্প্রসারণজনিত কিংবা সুদের হার একেবারে শূন্যের কাছাকাছি হলে এক ধরনের যে মূল্যস্ফীতি হয় সেটাকে ‘মনিটারি ফেনোমেনন’ বলে। এমন ক্ষেত্রে সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা বা কমিয়ে আনা যায়। 

কিন্তু আমাদের মূল্যস্ফীতি মনিটারি ফেনোমেনন নয়। আমাদের এখানে মূল ফ্যাক্টরটা হচ্ছে, আমরা অনেক কিছু আমদানি করি, বিশ্বে কোনো পণ্যের দাম বাড়লে আমাদের এখানেও বাড়বে, উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। আমাদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মুদ্রা বিনিয়ম হার। যখন আমাদের রিজার্ভ নিচের দিকে যাওয়া শুরু করল, স্বাভাবিকভাবেই তখন টাকার অবমূল্যায়ন করতে বাধ্য হয়েছি। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ার সময় বিনিময় হার দীর্ঘদিন ৮৫-৮৬ টাকায় ছিল। এটা অর্থনীতির জন্য ভালো। অনেকেই বলেন, এটাকে মার্কেটের ওপর আগেই ছেড়ে দেয়া দরকার ছিল। আমি এটার সঙ্গে সম্মত নই। কারণ আমাদের রিজার্ভ বাড়ছিল। তখন এটার প্রয়োজন ছিল না। তখন যেকোনো উদ্দেশ্যে আমাদের ডলারের সহজপ্রাপ্যতা ছিল। চিকিৎসা, পর্যটক বা আমদানির জন্য তখন ডলারের সহজপ্রাপ্যতা ছিল। আমাদের আমদানি বিল যখন রফতানির চেয়ে বেশি হচ্ছিল তখনই রিজার্ভ নিচের দিকে যাওয়া শুরু করল এবং বিনিময় হার আমাদের বিরুদ্ধে যাওয়া শুরু করল। রিয়েল ইফেক্টিভ বিনিময় হার একটা হয়তো আছে, বাংলাদেশ ব্যাংক চেষ্টা করেছে এটাকে কাছাকাছি রাখার জন্য। অর্থনীতিতে একটা ভীতি সঞ্চার হলো যখন ডলারের বিনিময় হার ৯০ টাকা অতিক্রম করে। তখন কিছু লোক অনুমান করে যে ডলারের দাম আরো বাড়বে। এ সময় তারা নিজেরাই ডলার কিনতে শুরু করে। অন্য সম্পদের পরিবর্তে তারা ডলার কিনেছে। তবে ডলারের দামটা স্থিতি হলে হয়তো তারা বিক্রি করত। কিন্তু এখনো সেটা স্থিতিতে আসেনি। বর্তমানে ডলারের বিনিময় হার ১১৫-১২০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। 

বাজারে স্পেকুলেশন হলে ডলারের মান স্থিতিশীল রাখা যায় না। ধরা যাক, কোনো পণ্যের দাম বাড়ার আশঙ্কা বা দেশের অর্থনীতি খুব খারাপ হয়ে যাবে—এ ভয় সৃষ্টি হলে তখন কিছু লোক পুঁজি পাচার করতে থাকে, বৈধ আয়ও নিয়ে যায়। তখন তো তারা বাংলাদেশের স্থানীয় মুদ্রায় নেবে না। তারা নেবে মার্কিন ডলারে। এরা ভাসমান মুদ্রাবাজার থেকে যেমন বেশি দামে ডলার কেনে, তেমনি বিদেশে গিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশীদের রেমিট্যান্স কেনে। এটা হুন্ডি বা অপ্রাতিষ্ঠানিক বাজার হিসেবে দাঁড়িয়েছে। তাহলে আমার এখানে রেমিট্যান্স কীভাবে বাড়বে। ব্যাংকিং চ্যানেলে যে অর্থ আসে তাকে আমরা রেমিট্যান্স গণ্য করি। অতিরিক্ত রেমিট্যান্স যখন আসে তখন বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু কিনে নেয় তার রিজার্ভ তৈরির জন্য। বাকিটা তো ব্যাংক খাতে থেকে যায়। এটা আমদানি-রফতানির বিভিন্ন পেমেন্টে ব্যবহার হয়। এখন যদি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও বিনিময় হার স্থিতিশীল না রাখা যায় এবং রিজার্ভ যদি ভালো না থাকে তাহলে অর্থনীতি খারাপের দিকে যাবে। যখনই মানুষ দুর্যোগের কথা চিন্তা করবে তখনই তারা বৈদেশিক মুদ্রা পুঞ্জীভূত করার চেষ্টা করবে—সেটা বিদেশেই হোক বা স্থানীয়ভাবে হোক। এটার সমাধানের একমাত্র ভালো উপায় আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে ভালো পর্যায়ে রাখা। আরেকটি উপায় দেশের মানুষকে নিশ্চিত করা যে দেশের আইন-কানুন ঠিক থাকবে। অপ্রয়োজনীয় ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করা যাবে না বা করা হবে না। মনে রাখতে হবে, কোনো দেশে ভীতিকর ও অনিশ্চিত পরিবেশ থাকলে কিন্তু ধনিক শ্রেণী প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে থাকে বেশি। তারা অর্থ ধরে রাখে কিংবা বিদেশে পাচার করে দেয়। কোনো ধরনের নতুন বিনিয়োগ করে না। আর মধ্যবিত্ত শ্রেণী বা নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণী কখনো অর্থ পাচার করে না, ডলারও জমিয়ে রাখে না। এসব করে মূলত তথাকথিত ধনিক শ্রেণী। 

অর্থের কোনো সীমানা নেই। বর্তমানে ব্যাংকিং চ্যানেল কিংবা হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ সহজেই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পাঠানো যায়। আমাদের ক্যাপিটাল অ্যাকাউন্ট কিন্তু পরিবর্তনযোগ্য (কনভার্টিবল) না। চলতি হিসাব পরিবর্তনযোগ্য। বৈদেশিক মুদ্রা আনা যাবে, বাজারে বিক্রি করা যাবে, কিন্তু নেয়া যাবে না। তবে কিছু বিশেষ উদ্দেশ্যে নেয়া যায়। যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সফর অনুষ্ঠানের ব্যয়ের জন্য। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে নেয়া যায়। যেহেতু ক্যাপিটাল অ্যাকাউন্ট পরির্বতনযোগ্য নয়, ধনী লোকদের যদি বৈধ আয় থাকে তাদের পক্ষেও নেয়া কঠিন। আর ক্যাপিটাল অ্যাকাউন্ট পরিবর্তন করাও যাবে না। তবে একসময়ে কিছুটা হলেও করা যেতে পারত। তখন ৪৬ বিলিয়ন ডলার আমাদের রিজার্ভ ছিল। এখন কথা হচ্ছে, হুমকিটা কোথায়? আর এ অবস্থায় এল কেন? ক্যাপিটাল পাচারের কারণে আমাদের রেমিট্যান্স প্রবাহটা যেভাবে আসার কথা ছিল সেভাবে আসেনি। 

প্রতি বছরই সরকারি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। তাই দু-তিন বছর ধরে বৈদেশিক মুদ্রায় সেটা পরিশোধ শুরু করেছি। আমাদের আমদানি বিল কিন্তু আগের মতোই আছে। তাহলে আমাদের অর্থটা কোথায় যাচ্ছে? বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। এ ঋণের পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলার, যা আমাদের জিডিপির ২৫ শতাংশের মতো। বৈদেশিক ঋণ কখন বিপদের কারণ হয়? বিপদের কারণ তখনই হয়, যখন বিদেশ থেকে একটি ঋণ নিয়ে অন্য একটি ঋণ পরিশোধ করতে হয়। শ্রীলংকা ও পাকিস্তানের মতো অনেক রাষ্ট্রই অতীতে এমনটা করেছে, এখনো করছে। তারা বৈদেশিক ঋণের ফাঁদ থেকে বের হতে পারে না। শ্রীলংকা কোনো রকমে এ অবস্থা থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছে। পাকিস্তান তো বহুদিন ধরে এ ফাঁদের মধ্যে আছে। সহজে বৈদেশিক ঋণ পাওয়ার কারণে বাংলাদেশ অনেক সময় অপব্যবহার করছে। যে প্রকল্পে হয়তো ৫০০ মিলিয়ন ডলার লাগত সেখানে ৬০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হচ্ছে। যে প্রকল্প ১০ বছরে শেষ হওয়ার কথা ছিল তা শেষ হতে ১৫ বছর লাগছে। সহজে পাওয়া ঋণ বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

তবে মনে রাখতে হবে, অর্থনীতি খারাপের দিকে গেলে ঋণ পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। যারা একসময় ঋণ দিতে চাইত, তারা হয়তো আর দিতে চাইবে না। এটা বাংলাদেশকে বুঝতে হবে। তবে কিছু নীতিনির্ধারক বুঝতে পেরেছেন, আমাদের বাজেটটা কাটছাঁট করছেন। এটা ভালো চিন্তা। বৈদেশিক ও স্থানীয় এ দুটি উৎস থেকে সরকার ঋণ নিয়ে থাকে। সরকারের জন্য স্থানীয় ঋণও ঠিক না। তবে স্থানীয় ঋণের সুবিধা স্থানীয় টাকায় ফেরত দেয়া যায়। সরকার যখন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নেয় সেটা হচ্ছে নোট ছাপানো। আমাদের এক বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ ব্যাংকে বলে এসেছেন, প্রিন্ট করে সরকারকে কোনো ঋণ দেবেন না। এটা ভালো চিন্তা এবং ভালো উপদেশ। তবে আশা করি, এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক একটু শক্ত থাকবে। টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দিলে মূল্যস্ফীতি আরো বাড়িয়ে দেবে। তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সুদহার বাড়ানোর কোনো অর্থ হয় না। 

ধরে নিলাম, সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিল না। তাহলে ব্যাংকিং চ্যানেল থেকে সরকার ঋণ নেবে। ব্যাংকিং চ্যানেল থেকে সরকার ঋণ নিলে বেসরকারি খাত পাবে না। কারণ মোট টাকা তো সীমিত করে দেয়া আছে। সেটা সরকারই এখন সুদের হার বাড়িয়ে ফেলেছে। সাড়ে ১০ শতাংশ ট্রেজারি বিলের সুদের হার। অনেক মানুষ এসব কিনতে চেষ্টা করছে। সরকারকে ঋণ দিচ্ছে। সেটা তো তারা ব্যাংকের এফডিআর ভেঙে দিচ্ছে। তখন সুদের হার বাড়িয়ে দিতে ব্যাংকও বাধ্য হয়। তবে সুদের হার বৃদ্ধির চক্রের মধ্যে পড়ে যাচ্ছি। 

সুদের হার বাড়লে বিনিয়োগ ও ভোগ কমবে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি নিয়ে আমরা যতটা আশাবাদী ততটা অর্জন হবে না। সরকারের রাজস্ব বিভাগের রাজস্ব সংগ্রহ কমবে। রাজস্ব সংগ্রহ নির্ভর করছে মূলত বিনিয়োগ ও ভোগের ওপর। যে অর্থনীতি চাঙ্গা থাকে সেখানে রাজস্ব সংগ্রহ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাড়তে থাকে। আর যে অর্থনীতি মন্থর হয়ে যায় সেখানে রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ে না। আমি মনে করি, সরকারের উচিত বাজেটকে ছোট করে ফেলা। কিন্তু সরকারের পক্ষে সেটা করা সম্ভব নয়। কারণ রাজস্ব বাজেটের আকার অনেক বড়। 

নব্বই দশক পর্যন্ত আমরা এমনটা করতে দেখেছি। বিশ্বব্যাংক যদি বলত তোমাদের সরকারি ঋণের আকার বড়, এটা ছোট করতে হবে। তখন তাদের হুঁশ হতো। বহুদিন ধরে জনতা ব্যাংককে কোনো শাখা করতে দেয়া হয়নি। সেটা শেষ হওয়ার পর জনতা ব্যাংক সমানে শাখা খুলতে শুরু করেছে। এসব শাখা থেকে কোনো লাভ হবে কিনা সেটা চিন্তা করে না। এভাবে তো ব্যাংক খাত চলতে পারে না। 

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশকে কেন সহজে ঋণ দিচ্ছে। তারা দেখছে বাংলাদেশ ভালো গ্রাহক। আইএমএফের তো ঋণ বিক্রি করতে হবে। তারা কয়টি দেশ পাবে যারা সহজে ঋণ ফেরত দিতে পারবে। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২৫ বিলিয়ন ডলারের ওপরে ছিল। তখন তারা দেখছে বাংলাদেশ তাদের ঋণের ভালো গ্রাহক। তবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১৫ বিলিয়নের নিচে এলে আইএমএফের কাছে বাংলাদেশ আর ভালো গ্রাহক থাকবে না। তখন তারা ঋণের কিস্তি দিতে কিন্তু গড়িমসি শুরু করবে। 

আবু আহমেদ: অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন