কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। কৃষক ও কৃষিবিদদের নিরলস প্রচেষ্টায় শত প্রতিকূলতার মাঝেও সমগ্র জাতির আহারের নিশ্চয়তা আজ দৃশ্যমান। অনাদিকাল থেকে মানুষ খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানসহ মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য কৃষির ওপর নির্ভর করে আসছে। দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি শিক্ষা, গবেষণা, সম্প্রসারণ ও কৃষির উপকরণ বিতরণ কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য বিভিন্ন কৃষিপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। কৃষি শিক্ষায় আগ্রহী ও কৃষিকে মজবুত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি কৃষিবিদদের মর্যাদার আসনে আসীন করেন। তার সুযোগ্য কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর কৃষিবান্ধব নীতি এবং কৃষি ও কৃষিবিদদের প্রতি দরদের কারণে আজ আমরা দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। শাকসবজি, ফলমূল, মাছ, মাংস ও ডিম উৎপাদন করে দৈনন্দিন পুষ্টি চাহিদা পূরণে কৃষি খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
এফএওর তথ্যমতে, ২০০১ সালে ১১টি কৃষি উৎপাদনে শীর্ষ দশে ছিল বাংলাদেশ। ২০১১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭টিতে। সব মিলিয়ে ২০২১ সালে ২২টি কৃষিপণ্য উৎপাদনে শীর্ষ তালিকায় স্থান পেয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ বিশ্বে পাট, সুপারি ও শুকনা মরিচ উৎপাদনে দ্বিতীয়, চাল, রসুন এবং অন্যান্য শ্রেণীভুক্ত চিনিজাতীয় ফসল ও সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, জামের মতো ফল, সুগন্ধি মসলা ও চা উৎপাদনে চতুর্থ, মসুর ডাল ও গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ফল উৎপাদনে ষষ্ঠ, পেঁয়াজ, আলু, আদা, বেগুন, শিমের বিচি, আম উৎপাদনে সপ্তম, কুমড়া, পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম, ফুলকপি, মটরশুঁটি এবং পাখির খাদ্য উৎপাদনে নবম, অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ের মাছ উৎপাদনে তৃতীয় এবং ইলিশ উৎপাদনে প্রথম স্থান অধিকার করে বিশ্ব পরিমণ্ডলে সমাদৃত।
২০০৮-০৯ সালে খাদ্যশস্য উৎপাদন ছিল ৩ কোটি ৩৮ লাখ ৩৩ হাজার টন, বর্তমানে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়ে হয়েছে ৪ কোটি ৭৭ লাখ ১৮ হাজার টন। পাশাপাশি সরকারের নীতিসহায়তা ও আধুনিক প্রযুক্তির অবদানে কৃষিপণ্যের উৎপাদন বেড়েছে ৪৫ শতাংশ। ২০০৯ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত নার্সভুক্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন ফসলের ৬৩১টি উচ্চফলনশীল নতুন জাত এবং ৯৪০টি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। জিএমও প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিটি বেগুন এবং বিটি তুলার জাত উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ করা হয়েছে। দেশী ও তোষা পাটের জীবনরহস্য আবিষ্কারসহ পাঁচ শতাধিক ফসলের ক্ষতিকরণ ছত্রাকের জীবনরহস্য উন্মোচন করা হয়েছে। উল্লেখিত সব অর্জনের পেছনে নিয়ামক বা নির্দেশনা হিসেবে কাজ করেছে ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণীর পদমর্যাদায় উন্নীত করার ঘোষণা। কৃষিবিদরা দিনটিকে ২০১২ সাল থেকে কৃষিবিদ দিবস হিসেবে যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপন করে থাকেন।
১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য দীর্ঘকাল পর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদের ২০১০ সালের ২৭ নভেম্বরের সভায় ১৩ ফেব্রুয়ারিকে কৃষিবিদ দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। এর নেতৃত্বে ছিলেন সে সময়ের কেআইবির মহাসচিব এবং বর্তমান বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কৃষিবিদ আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম এমপি। সেই সিদ্ধান্তের আলোকে ২০১২ সাল থেকে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ ১৩ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে প্রথমবারের মতো কৃষিবিদ দিবস হিসেবে উদযাপন করে এবং বর্তমানে প্রতি বছর নিয়মিতভাবে দিনটিকে যথাযোগ্য মর্যাদায় এবং নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে পালন করে আসছে।
কৃষিবিদদের কল্যাণে এবং কৃষকদের অক্লান্ত পরিশ্রমে কৃষি খাতে এখন উৎপাদন বেড়েছে বহুগুণ। বর্তমানে চাল উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। বিভিন্ন ফসলের জাত উদ্ভাবন ও উন্নয়নে বাংলাদেশের স্থান হলো সবার ওপরে। তাছাড়া পাট উৎপাদনে বাংলাদেশের স্থান দ্বিতীয়, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, চাষকৃত মৎস্য উৎপাদনে দ্বিতীয়, আম উৎপাদনে সপ্তম ও আলু উৎপাদনে অষ্টম বলে বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে চালের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় চার গুণ, গম দুই গুণ, ভুট্টা ১০ গুণ এবং সবজির উৎপাদন বেড়েছে পাঁচ গুণ। প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে আম, আলু রফতানি হচ্ছে বিদেশে। মাছ রফতানিও বাড়ছে। চিরকালের দুর্ভিক্ষ, মঙ্গা আর ক্ষুধার দেশে এখন ঈর্ষণীয় উন্নতি হয়েছে খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহের ক্ষেত্রে। জমির সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার কারণে দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ।
বর্তমানে কৃষি শিক্ষায় শিক্ষিত গ্যাজুয়েটের সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার, তাদের মধ্যে সরকারি পর্যায়ে প্রায় ১৫ হাজার কৃষিবিদ এবং বেসরকারি পর্যায়ে পাঁচ হাজার কৃষিবিদ কর্মরত। তাছাড়া সহস্রাধিক কৃষিবিদ অস্ট্রেলিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে সুনামের সঙ্গে কর্মরত। সরকারি পর্যায়ে কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মিলে বর্তমানে প্রায় ২৪টি কৃষিভিত্তিক সংস্থার পাশাপাশি কৃষিবিদরা সাতটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যাংক-বীমাসহ পুলিশ ও প্রশাসনে কর্মরত রয়েছেন। যে পেশায় থাকুক না কেন সর্বক্ষেত্রে সফলতার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। তাছাড়া রাজনীতিতে রয়েছে কৃষিবিদদের আধিপত্য, বর্তমানে জাতীয় সংসদে পাঁচজন কৃষিবিদ সংসদ সদস্য রয়েছেন।
আমাদের প্রাপ্তি কম নয়, তবে প্রত্যাশা রয়েছে অনেক। বিশেষ করে বিজ্ঞানীদের চাকরির বয়সসীমা বৃদ্ধি, ইনসিডো পদোন্নতি, নতুন গ্র্যাজুয়েটদের কর্মসংস্থান তৈরি, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে জনবল বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের আবেদন দিবসটিকে জাতীয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করা। আজকের দিনে আমাদের অঙ্গীকার হোক ঐক্য ও সংহতির মাধ্যমে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া এবং ১৭ কোটি মানুষের খাদ্য, পুষ্টি ও বস্ত্রের নিরাপত্তায় নিজেদের উৎসর্গ করা।
ড. মো. তাসদিকুর রহমান সনেট: সাধারণ সম্পাদক কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ, ঢাকা মেট্রোপলিটন