স্বল্পমেয়াদে রেশনিং

গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত না হলে অর্থনীতিতে নেতিবাচক অভিঘাত পড়বে

ছবি : বণিক বার্তা

দৈনন্দিন জীবন থেকে শুরু করে দেশের শিল্প খাত, বিদ্যুৎ খাত ও রফতানি আয় ওতপ্রোতভাবে জড়িত গ্যাস সরবরাহের সঙ্গে। দীর্ঘদিন থেকে চলমান গ্যাস সংকট বর্তমানে আরো তীব্র রূপ নিয়েছে। চাহিদার তুলনায় ঘাটতির মধ্যে রয়েছে দেশের গ্যাস খাত। পেট্রোবাংলার তথ্যমতে, দেশে গ্যাসের দৈনিক চাহিদা ৪৩০ কোটি ঘনফুট। আর স্বাভাবিক সময়ে জাতীয় গ্রিডে মোট সরবরাহ হয় ৩০০ কোটি ঘনফুট। আবার চাহিদার অধিকাংশ পূরণ করা হয় আমদানির মাধ্যমে। কিন্তু বর্তমানে আমদানীকৃত এলএনজির সরবরাহ এবং দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে উৎপাদনের পরিমাণও কমেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এর পেছনে দায়ী অর্থ এবং গ্যাস খাতের অনুসন্ধান ও উত্তোলন ব্যবস্থায় ঘাটতি। এ অবস্থার আশু সমাধান না করা গেলে দেশের অর্থনীতি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মুখ থুবড়ে পড়বে। যেহেতু গ্যাসের ওপরই নির্ভরশীল অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলো। এরই মধ্যে স্বল্পমেয়াদে গ্যাস সরবরাহ রেশনিং চালু করা হয়েছে চলমান সংকট মোকাবেলায়। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হলে নিজেদের উত্তোলন বাড়ানো ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।

ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির (আইইএ) এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে বাংলাদেশে ২০২৩ সালের প্রথম ১০ মাসে গ্যাসের চাহিদা কমেছে পূর্ববর্তী বছরের একই সময়ের তুলনায় ১ শতাংশ। কিন্তু ওই সময়ে এলএনজি আমদানি বেড়েছে ২০ শতাংশের কাছাকাছি। যদিও এ আমদানি স্থানীয় উত্তোলন হ্রাসজনিত ঘাটতি পূরণে যথেষ্ট নয়। সরবরাহস্বল্পতার কারণে বিভিন্ন খাতে গ্যাসের রেশনিং করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। এতে বিদ্যুৎ খাতে ক্রমাগত লোডশেডিং বেড়ে চলছে।

বণিক বার্তার প্রতিবেদন বলছে, গ্যাস সংকটের কারণে সবচেয়ে বেশি ভুগছে বিদ্যুৎ ও শিল্প উৎপাদন খাত। দেশে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মোট উৎপাদন সক্ষমতা দৈনিক সাড়ে ১১ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু এ সময় তা ছয় হাজার মেগাওয়াটের বেশি চালানো সম্ভব হচ্ছে না। বিদ্যুতে গত বছর ১ হাজার ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা থাকলেও গড় সরবরাহ ছিল ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট। যদিও পেট্রোবাংলা বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে গ্যাসের সরবরাহ ছিল ১ হাজার ৬৬ মিলিয়ন ঘনফুট। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর বড় অংশ বসে থাকায় বিদ্যুৎ চাহিদা ও উৎপাদনে অন্তত আড়াই থেকে তিন হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং করতে হয়েছে বিতরণ কোম্পানিগুলোকে। ওই সময় বিতরণ কোম্পানিগুলো ঘোষণা দিয়েই অব্যাহতভাবে কয়েক মাস লোডশেডিং করেছে। বিদ্যুতের পাশাপাশি শিল্প খাতেও চলছে গ্যাস সংকট। চট্টগ্রাম, গাজীপুর, সাভার, আশুলিয়া, নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার শিল্প এলাকার টেক্সটাইল মিলগুলো প্রায় অচলাবস্থায় দাঁড়িয়েছে। এছাড়া নারায়ণগঞ্জের বিসিক ও তার আশপাশের এলাকায় দুই সপ্তাহের জন্য গ্যাস সরবরাহ বন্ধও হয়ে যায়। 

বিদ্যুৎ খাতে চাপ সৃষ্টি হওয়ার আরেকটি কারণ হলো আবাসিক কাজ, বিশেষত শহরে রান্নার কাজে গ্যাসের বিকল্প হয়ে উঠেছে বিদ্যুৎ কিংবা তারা রান্না করতে বাজার থেকে চড়া দামে কিনে আনছে গ্যাস সিলিন্ডার। এতে মানুষের ওপর আর্থিক চাপও বেড়ে চলেছে। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে আমাদের আবাসিক খাত থেকে শুরু করে শিল্প-কলকারখানার উৎপাদন ব্যবস্থা ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন গ্যাস সংকটের জন্য। যার প্রভাব রফতানি বাণিজ্যে পড়ছে। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে নিজস্ব গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে অনীহার কারণে এ সংকট দেখা দিয়েছে। এছাড়া চলমান ডলার সংকটে আমদানি কমছে, যা পরিস্থিতিকে আরো বিরূপ করেছে।

দেশে স্থানীয়ভাবে উত্তোলিত গ্যাসের চাহিদা ক্রমেই বেড়েছে। কিন্তু সে তুলনায় গত ১০ বছরে এখানে বড় কোনো মজুদ আবিষ্কার করা যায়নি। এমনকি ২০১১ সালের পর দেশে গ্যাসের প্রকৃত মজুদসংক্রান্ত কোনো অনুসন্ধানভিত্তিক তথ্যও প্রকাশ হয়নি। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো-ভিত্তিক কনসালট্যান্সি ফার্ম গুস্তাভসন অ্যাসোসিয়েটসের সমীক্ষা মতে, দেশে গ্যাসের মজুদ পাওয়ার সম্ভাবনা ৯০ শতাংশ। অনুমান করা হয় খনিগুলোয় গ্যাসের সম্ভাব্য মজুদ আছে ৩৮ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ)। সুতরাং দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য গ্যাস অনুসন্ধানে আমাদের তৎপরতা বাড়াতে হবে। তাছাড়া কেবল আমদানির মাধ্যমে চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে না এবং তা কোনো অর্থনৈতিক সুফল বয়ে আনবে না।

জানা যায়, গ্যাসের উত্তোলন বাড়াতে সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে ৪৬টি কূপ খননের উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত মাত্র নয়টি কূপ খনন করা সম্ভব হয়েছে। এর মাধ্যমে জাতীয় গ্রিডে খুব বেশি গ্যাসও যুক্ত হয়নি। বোঝা যায় যে এসব উদ্যোগ বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। বর্তমানে এ সংকট মোকাবেলা করতে ভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

এরই মধ্যে বিদেশী কোম্পানিকে সাগরে গ্যাস অনুসন্ধান চালাতে আহ্বানের জন্য সদ্য অনুমোদন পেয়েছে পেট্রোবাংলা। আর এলএনজি আমদানিতে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি সই হয়েছে তিনটি। ২০২৬ সাল নাগাদ আমাদের সংকট অনেকটাই লাঘব হবে বলে আশা করা যায়। কিন্তু বর্তমানে গ্যাস রেশনিংই শেষ ভরসা। তবে সবচেয়ে বড় আশঙ্কার জায়গা হলো গ্যাসের ওপর নির্ভর করে কতদূর এগোনো যাবে।

হাইড্রোকার্বন ইউনিট বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের মজুদ পাওয়া গেছে ২৯ দশমিক ৯৩ টিসিএফ। এর মধ্যে গত বছরের জুন পর্যন্ত ২০ দশমিক ৩৫ টিসিএফ গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে। চলতি মাস পর্যন্ত উত্তোলন হয়েছে আরো অন্তত ৬০০ বিসিএফ। সে হিসেবে বাকি গ্যাস দিয়ে চলবে প্রায় ১০ বছর। অর্থাৎ গ্যাসের মজুদ দ্রুত শেষ হতে খুব বেশি সময় লাগবে না। এক্ষেত্রে স্পট মার্কেটের ওপর নির্ভরশীলতাও সমাধান নয়।

আমাদের জ্বালানি ও উৎপাদন খাতকে গ্যাসনির্ভরতা থেকে সরিয়ে আনতে হবে। উন্নত বিশ্বের মতো নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে ধাবিত হতে হবে। মজুদ যতই থাকুক না কেন, অনবায়নযোগ্য জ্বালানি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে একসময় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তাই আমাদের শিগগিরই এর বিকল্প পথে হাঁটা শুরু করতে হবে। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন