বিশ্লেষণ

খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তায় জিনোম এডিটিং প্রযুক্তি

অধ্যাপক ড. মো. তোফাজ্জল ইসলাম

ছবি : বণিক বার্তা

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর কৃষি ও খাদ্যনিরাপত্তায় সাফল্য একটি মাইলফলক অর্জন। কৃষিতে সমস্যাভিত্তিক গবেষণা এবং কৃষকদের খামারে উপযুক্ত প্রযুক্তির সময়োপযোগী প্রয়োগের কারণে এটি ঘটেছে। তবে বিভিন্ন কারণে কৃষি এবং খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তায় এ সাফল্য অব্যাহত রাখা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কৃষিতে নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য জীবপ্রযুক্তি, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, জিনোম এডিটিং, ন্যানো প্রযুক্তি, ইন্টারনেট অব থিংস এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো উন্নত প্রযুক্তির অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রয়োগ আশু প্রয়োজন। জিনোম এডিটিং একবিংশ শতাব্দীতে মানব আবিষ্কৃত সবচেয়ে শক্তিশালী বৈপ্লবিক প্রযুক্তি। এটিকে চতুর্থ কৃষি এবং শিল্প বিপ্লবের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। কীভাবে এ প্রযুক্তি বাংলাদেশে কৃষি খাদ্য এবং পুষ্টিনিরাপত্তায় এক বৈপ্লবিক প্রযুক্তি হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে তা এ প্রবন্ধের প্রতিপাদ্য বিষয়। 

আসুন শুরুতে জিনোম এডিটিং প্রযুক্তিটি কী এবং কীভাবে এটি একটি বৈপ্লবিক প্রযুক্তি হিসেবে বিকশিত হচ্ছে তা জেনে নেয়া যাক। আমরা জানি, প্রতিটি জীবের বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণকারী জেনেটিক কোড কোষের ডিএনএ অণুতে সজ্জিত থাকে। জীবের জেনেটিক কোডগুলোকে জিনোম সিকোয়েন্সিং এবং বিশাল সিকোয়েন্স ডাটা কম্পিউটার সফটওয়্যারের মাধ্যমে বিশ্লেষণ এবং গবেষণাগারে পরীক্ষার মাধ্যমে জেনেটিক কোডগুলো উদ্ঘাটন করা হয়। সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের জন্য দায়ী সিকোয়েন্সকে জিন (কোড) বলা হয়। জিনোম এডিটিং হচ্ছে ডিএনএ সিকোয়েন্সে ইচ্ছামতো এবং নিখুঁতভাবে পরিবর্তন আনয়নের প্রযুক্তি। এক্ষেত্রে কোনো খারাপ বৈশিষ্ট্যের জন্য দায়ী জিন বা জিনোম অনুক্রমকে ফটোশপের ন্যায় পরিবর্তন করে উন্নত জাত বা বৈশিষ্ট্যের জীব তৈরি করা যায়। এছাড়া জীবের ডিএনএ অণুতে কাঙ্ক্ষিত জেনেটিক কোডগুলো বা জিন প্রবেশ করিয়ে জীবে উন্নত বৈশিষ্ট্যের সংযোজন করা যায়। 

জিনোম এডিটিং অনেকটা কম্পিউটারের ওয়ার্ড প্রসেসরে লেখা এডিট বা সম্পাদনা করার মতো ব্যাপার। আমরা যেমন লেখার ভেতর কোনো শব্দ বা অক্ষরকে ইচ্ছামতো পরিবর্তন করতে পারি, তেমনি বিজ্ঞানীরা এমন কিছু প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছেন, যা দিয়ে তারা জিনোমের ভেতরে ইচ্ছামতো জিনের পরিবর্তন ঘটাতে পারেন। শুনতে অনেকটা বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর মতো লাগলেও জিনোম এডিটিং এখন জীবপ্রযুক্তির জগতে এক বাস্তবতা। 

এ পর্যন্ত চারটি জিনোম এডিটিং পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে। সেগুলো হলো, জিঙ্ক ফিঙ্গার নিউক্লিয়েজ (জেডএফএন), ট্রান্সক্রিপশন-অ্যাক্টিভেটর লাইক ইফেক্টর নিউক্লিয়েজ (টিএএলইএন), মেগানিউক্লিয়েজ এবং ক্লাস্টারড রেগুলারলি ইন্টারস্পেসড শর্ট প্যালিনড্রোমিক রিপিটস (ক্রিসপার-কাস) সিস্টেম। এদের মধ্যে ক্রিসপার-কাস হলো জিনোম এডিটিং প্রযুক্তির সর্বশেষ সংযোজন এবং এ সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও ফলপ্রসূ পদ্ধতি। অন্যান্য পদ্ধতি জটিল এবং জিনোম এডিটিংয়ের জন্য ব্যবহারকারীবান্ধব নয়। কারণ এ পদ্ধতিগুলো ব্যবহারের জন্য অসুবিধাজনক ও কষ্টসাধ্য প্রোটিন ডাইজেশন, সংশ্লেষণ এবং যথার্থতা (Validity) যাচাই আবশ্যক। অন্যদিকে ক্রিসপার-কাস পদ্ধতি এসব বিবেচনায় অনেক বেশি সহজ ও সুবিধাজনক। যেমন ক. এটি কম ব্যয়সাপেক্ষ এবং সহজেই প্রয়োগ করার মতো প্রযুক্তি খ. এ প্রযুক্তি অনেক বেশি সূচারুভাবে জিনোমের নির্দিষ্ট জায়গায় পরিমার্জন করার জন্য খুব সরল প্রকৃতির উপাদানের ওপর নির্ভর করে তৈরি। গ. পছন্দের জিনোমের ওপর ভিত্তি করে এবং একাধিক জিনকে উদ্দেশ্য করে সহজেই ক্রিসপার-কাস সিস্টেম ডিজাইন করা যায়, যার মাধ্যমে একই সঙ্গে ওইসব জিনকে এডিটিং করা যায়। ঘ. এ প্রযুক্তিতে সম্পাদিত জিনের পরিবর্তনগুলো স্থিতিশীল এবং বংশানুক্রমে স্থানান্তরিত হয়। ঙ. সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো, এ প্রক্রিয়ায় মাত্র কয়েক প্রজন্মের মধ্যে ট্রান্সজিন-মুক্ত উদ্ভিদ উন্নয়ন সম্ভব। চ. সম্পাদিত উদ্ভিদ/জাত উদ্ভিদ প্রচলিত প্রজননের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।

জিনোম এডিটিং প্রযুক্তির মধ্যে ক্রিসপার-ক্যাস হলো সর্বোচ্চ নির্ভুলতার সঙ্গে যেকোনো জীবের জিনোম সম্পাদনা করার সবচেয়ে দ্রুততম পদ্ধতি। ক্রিসপার (CRISPR) আসলে একটা শব্দসংক্ষেপ। এর বাংলা করা যেতে পারে নিয়মিত-ব্যবধানযুক্ত-গুচ্ছবদ্ধ-ক্ষুদ্র-প্যালিনড্রোমিক পুনরাবৃত্তি। বিজ্ঞানীরা অনেক আগে থেকেই ব্যাকটেরিয়ার জিনোম বিশ্লেষণ করে একটা বিষয় লক্ষ করেছিলেন যে জিনোমের একটা অংশজুড়ে রয়েছে কিছু প্যালিনড্রোমিক সিকোয়েন্স, অর্থাৎ অ্যাডেনিন (এ), থাইমিন (টি), গুয়ানিন (জি), সাইটোসিন (সি) দিয়ে লিখিত এমন কিছু জেনেটিক কোড, যা বাম থেকে ডানে পড়লে যা হবে, ডান থেকে বামে পড়লেও তা-ই হবে‌। দেখা গেল, ‌বেশ বড় অংশজুড়ে এ রকম প্যালিনড্রোমিক সিকোয়েন্স, এরপর কিছু এলোমেলো সিকোয়েন্স, আবার একটা প্যালিনড্রোমিক সিকোয়েন্স—এটা আবার আগেরটি থেকে ভিন্ন। বিজ্ঞানীরা অবাক হয়ে গেলেন, যখন তারা এই প্যালিনড্রোমিক সিকোয়েন্সগুলোর সঙ্গে ফেজ ভাইরাসের বিশেষ কিছু জেনেটিক সিকোয়েন্সের মিল খুঁজে পেলেন। ক্রিসপার-কাস সিস্টেম হলো ভাইরাসের বিরুদ্ধে ব্যাকটেরিয়াসহ প্রোকারিয়োটিক জীবের একটি অভিযোজিত প্রতিরোধ ব্যবস্থা। ক্রিসপার-কাস একটি প্রাকৃতিক পদ্ধতি যা ব্যাকটেরিয়া বা আর্কিয়া জাতীয় ক্ষুদ্র অণুজীবগুলো ভাইরাসের আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষার জন্য ব্যবহার করে থাকে। 

এমানুয়েল শারপাঁতিয়ে এবং জেনিফার ডাউডানা সর্বপ্রথম প্রাকৃতিক ক্রিসপার-কাস সিস্টেম ব্যবহার করে গবেষণাগারে টেস্ট টিউবে ডিএনএ অণুতে এডিটিং করার বৈপ্লবিক জীব প্রযুক্তিটি আবিষ্কার করেন। তাদের এ আবিষ্কার সাপ্তাহিক বিজ্ঞান সাময়িকী সায়েন্সে প্রকাশ হয় এবং বিশ্বব্যাপী হইচই শুরু। দ্রুতগতিতে এটির ব্যবহার উদ্ভিদ, প্রাণী, অণুজীব এমনকি মানবভ্রুণেও সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন হয়। যেকোনো জীবের বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তনে এবং ক্ষতিকর জেনেটিক রোগ, যেমন ক্যান্সার, ডায়াবেটিস নিরাময়ে ক্রিসপার-কাস জিনোম এডিটিং এক বৈপ্লবিক পদ্ধতি হিসেবে আবির্ভূত হয়। দ্রুত পদ্ধতিটির উৎকর্ষ এবং উন্নয়নের ফলে এটি কৃষি এবং জীববিজ্ঞানে ব্যাপক প্রয়োগের মাধ্যমে শিল্প এবং কৃষি বিপ্লবের এক বিস্ময়কর হাতিয়ারে পরিণত হতে থাকে। জিনোম এডিটিংয়ের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রযুক্তি আবিষ্কারের জন্য বিজ্ঞানী এমানুয়েল শারপাঁতিয়ে এবং জেনিফার ডাউডানাকে ২০২০ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। 

ক্রিসপার-কাস জিনোম এডিটিং প্রযুক্তি আমাদের একটি জীবের ডিএনএর (ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড) গোপন কোডগুলো সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে নির্ভুল পরিবর্তন করতে সক্ষম। ডিএনএ-তে হাজার হাজার গোপন কোড সব জীবন্ত প্রাণীর বিকাশ, কার্যকারিতা, বৃদ্ধি এবং প্রজননের নীলনকশা। তাই ডিএনএ অণুর যেকোনো কোডে সম্পাদনা সেই জীবের বৈশিষ্ট্যকে নাটকীয়ভাবে পরিবর্তন করতে পারে। যেকোনো জীবের একটি ডিএনএ অণু মূলত মিলিয়ন থেকে বিলিয়ন নিউক্লিওটাইড ইউনিটের সমন্বয়ে গঠিত একটি দ্বিসূত্রক প্যাঁচানো মইয়ের মতো। নিউক্লিওটাইডগুলো চারটি নাইট্রোজেন ক্ষারক সমন্বয়ে গঠিত, যেমন অ্যাডেনিন (এ), থাইমিন (টি), গুয়ানিন (জি), সাইটোসিন (সি)। ডিএনএ ডাবল হেলিকাল কাঠামোতে এ চার ক্ষারক জোড়া হিসেবে এবং একটি অনুক্রমিক পদ্ধতিতে থাকে। মানুষের ডিএনএ-তে প্রায় তিন বিলিয়ন বেজ-পেয়ার রয়েছে। ডিএনএ অণুতে এটিজিসির ক্রমগুলো জীবের জন্য অনন্য। একটি ছোট ডিএনএ সেগমেন্ট, যা কোষে প্রোটিন সংশ্লেষণকে এনকোড করে তাকে জিন বলে। জিন একটি জীবের নির্দিষ্ট কার্য, বিকাশ এবং বংশগত বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে জড়িত। মানুষের ডিএনএ-তে ২০-২৫ হাজারেরও বেশি জিন শনাক্ত করা হয়েছে। একটি জীবের কোষে সম্পূর্ণ জেনেটিক উপাদান বা ডিএনএ অণু একটি জিনোম হিসেবে পরিচিত।

ক্রিসপার-কাস জিনোম এডিটিং হলো একটি শক্তিশালী টুলবক্স, যা যেকোনো জীবের ডিএনএ/জিনোম সুনির্দিষ্ট এবং নির্ভুলভাবে সম্পাদনা করতে ব্যবহার হয়। এ ধরনের জিন এডিটিংয়ের ফলে নতুন এবং কাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়। মাল্টিপ্লেক্স জিনোম এডিটিং ডিজাইন করে একটি উদ্ভিদের একাধিক বৈশিষ্ট্য একই সময়ে উন্নত করা যেতে পারে। জিনোম এডিটিং সাইট নির্দেশিত নিউক্লিয়াস (এসডিএন) ব্যবহার করে জিনোমের নির্দিষ্ট অবস্থানে (যেমন ডিএনএ সিকোয়েন্স) একটি পছন্দসই পরিবর্তন করা হয়, যা কোনো নিউক্লিওটাইড অপসারিত করা, প্রতিস্থাপন করা বা একাধিক নিউক্লিওটাইড বা বেজ যোগ করতে পারে।

ক্রিসপার-কাস জিনোম এডিটিং পরিবর্তনশীল জলবায়ুর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়া নতুন উচ্চফলনশীল ফসলের জাতগুলোর উদ্ভাবনের জন্য অত্যন্ত দ্রুত এবং সুনির্দিষ্ট প্রযুক্তি হিসেবে স্বীকৃত। এ প্রযুক্তির মাধ্যমে এরই মধ্যে বিপুলসংখ্যক উদ্ভিদের জিনোম এডিটিং করা হয়েছে। এরই মধ্যে এ প্রযুক্তির প্রয়োগে জাপানে উচ্চ গামা এমিনু বিউটারিক অ্যাসিড (গাবা)-সমৃদ্ধ টমেটো, উচ্চ পেশিবিশিষ্ট রেড সি ব্রিম মাছ এবং পটকা মাছের জাত বাণিজ্যিকভাবে বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। গাবা-সমৃদ্ধ টমেটো মানবস্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী, কারণ গাবা উচ্চ রক্তচাপ হ্রাস, মানুষের মানসিক উন্নতি, চাপ সহ্যক্ষমতা বৃদ্ধিসহ মানবমস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপের উন্নয়নে সহায়ক হিসেবে প্রমাণিত। রেড সি ব্রিম এবং পটকা মাছ দুটি জাপানে সুশি হিসেবে খুবই দামি। জিনোম এডিটিংয়ের ফলে এদের পেশির বৃদ্ধি ৩০-৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধু জাপান নয়, জিনোম এডিটেড কাটলে বাদামি বর্ণ রূপান্তররোধী মাশরুম, মানবস্বাস্থ্যের জন্য উপকারী তেল উৎপাদনকারী সয়াবিন এবং কমেলিনা যুক্তরাষ্ট্রে বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ হচ্ছে ।

এরই মধ্যে জিনোম এডিটেড নন-ট্রান্সজেনিক উদ্ভিদ ও অন্যান্য উন্নত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জীবকে যেসব দেশ সরাসরি বাণিজ্যিকভাবে মাঠে ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, জাপান, কানাডা, ফিলিপাইন, অস্ট্রেলিয়া অন্যতম। বাংলাদেশও এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমির ফেলো ড. জেড করিমের নেতৃত্বে একটি জাতীয় পর্যায়ের কমিটি গত বছর কৃষি মন্ত্রণালয়কে দেশের কৃষি গবেষণায় জিনোম এডিটিংয়ের সুফললাভের উদ্দেশ্যে একটি স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউরস বা এসওপি অনুমোদনের জন্য বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের মাধ্যমে সুপারিশ করে। সব অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা এবং পর্যালোচনার পর কৃষি মন্ত্রণালয় এটি অনুমোদন করে। ফলে বাংলাদেশে জিনোম এডিটিং প্রযুক্তিটির মাধ্যমে স্বল্প সময়ে ফসলের উন্নত জাত উদ্ভাবন এবং তা কৃষকের মাঠে প্রয়োগের এক বিরাট সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হলো। এছাড়া প্রযুক্তিটি সম্পর্কে সবার জ্ঞান ও ধারণালাভের লক্ষ্যে বাংলা ভাষায় অধ্যাপক তোফাজ্জল ইসলাম রচিত একটি পুস্তক জিনোম এডিটিং মাতৃভাষায় প্রকাশ হয়েছে। জিনোম এডিটিং প্রযুক্তিটিকে ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষি খাদ্য এবং পুষ্টিনিরাপত্তা অর্জনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ে ফলপ্রসূ প্রকল্প গ্রহণ প্রক্রিয়া চলমান আছে। ক্রিসপার-কাস জিনোম এডিটিং প্রযুক্তিটি বাংলাদেশে জলবায়ু-স্মার্ট শস্যের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা উচিত।

কৃষিতে জিনোম এডিটিংয়ের মাধ্যমে জলবায়ুর ঘাতসহনশীল উচ্চফলনশীল ক্লাইমেট স্মার্ট ফসলের জাত তৈরির জন্য পরিকল্পিত গবেষণায় দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ প্রয়োজন। প্রধান প্রধান ফসলের কাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণকারী জিন আবিষ্কারের জন্য চাই দেশের জিন ব্যাংকে রক্ষিত ফসল উদ্ভিদের জিনোম অণুক্রম ও বায়োইনফরমেটিকস বিশ্লেষণ। বাংলাদেশ এরই মধ্যে পাট, ইলিশ, পাটের রোগ সৃষ্টিকারী ছত্রাক, ছাগল, মহিষ, গমের ব্লাস্ট রোগ সৃষ্টিকারী ছত্রাকসহ নানা ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসের জিনোম অণুক্রম নির্ণয় ও বায়োইনফরমেটিকস বিশ্লেষণ করে আধুনিক জীবপ্রযুক্তির সূচনা করেছে। পৃথিবীতে প্রথম মাঠ পর্যায়ে সর্বাধুনিক জিনোমিকস প্রযুক্তির ব্যবহার ও আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানীদের সঙ্গে সমঝোতা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিজিইর বিজ্ঞানীরা ২০১৬ সালে দেশের ১৫ হাজার হেক্টর গমের ক্ষতিগ্রস্ত জমিকে আক্রমণকারী মারাত্মক ব্লাস্ট রোগের ছত্রাক জীবাণুর উৎপত্তিস্থল নির্ণয় করেন। ফলে কৃষকদের সঠিক পরামর্শ দেয়া সম্ভব হয় এবং পরবর্তী বছরগুলোয় ব্লাস্ট রোগ আরো নতুন এলাকায় ছড়িয়ে পড়লেও ক্ষতির পরিমাণ খুব কম হয়। 

কৃষি মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে কানাডার গ্লোবাল ইনস্টিটিউট অব ফুড সিকিউরিটির (জিআইএফএস) সঙ্গে প্লাটফর্ম টেকনোলজি ব্যবহারে যৌথ গবেষণার লক্ষ্যে একটা দূরদর্শী সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে। এ সমঝোতার আওতায় বাংলাদেশ ও কানাডার বিজ্ঞানীরা চারটি ক্ষেত্রে (থিম) কাজ করবেন। ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে, ১. উদ্ভিদ প্রজননে জিনোমিকস ও ফিনোমিকসের প্রয়োগ ২. মৃত্তিকার স্বাস্থ্য ও মান, ৩. মৃত্তিকা পানির অবস্থা ও প্রয়োগ এবং ৪. ফসল সংগ্রহোত্তর প্রক্রিয়া ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ। এক্ষেত্রগুলোকে সমন্বিত করে অগ্রসরমাণ কৃষিপ্রযুক্তি উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের জন্য একটি অ্যাডভান্সড টেকনোলজি সেন্টার স্থাপন, বশেমুরকৃবি, কানাডার জিআইএফএস ও সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু-পিয়েরে ট্রুডো চেয়ার স্থাপন এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলে এসব কাজ সমন্বয়ের জন্য একটি আঞ্চলিক অফিস স্থাপন করা হয়েছে। 

আশা করা যায়, জিনোম এডিটিং ও অন্যান্য আধুনিক জ্ঞানের প্রয়োগে বাংলাদেশ ও কানাডার বিজ্ঞানী দল এবং কৃষি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশে বিশ্বমানের অগ্রসরমাণ কৃষিপ্রযুক্তি উদ্ভাবন হবে, যা জলবায়ুর অভিঘাত মোকাবেলা করে দেশে লাভজনক কৃষির প্রচলনে গতি সঞ্চার করবে। দেশের খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত করে বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত শিল্পের বিকাশের মাধ্যমে আমাদের রফতানিতে কৃষি অধিকতর ভূমিকা রাখবে। উল্লিখিত প্লাটফর্ম প্রযুক্তি ব্যবহার করে এরই মধ্যে অধ্যাপক তোফাজ্জল ইসলামের নেতৃত্বে বারোমাসি কাঁঠালের জীবনরহস্য উন্মোচন করা হয়েছে এবং ঢাকাই মসলিন উৎপাদনকারী ফুটি কার্পাসের জীবনরহস্য উন্মোচনের কার্যক্রম এগিয়ে চলছে। অনন্য জেনেটিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন এ দুই প্রাকৃতিক সম্পদের জেনেটিক কোড আবিষ্কারের মাধ্যমে সূচনা হবে এদের জীবপ্রযুক্তিভিত্তিক বাণিজ্যিক ব্যবহার। জিনোম এডিটিং এক্ষেত্রে ব্যবহৃত হবে সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে। একটি অর্থনৈতিকভাবে সোনার বাংলা রূপায়ণে গৌরবময় ঐতিহ্যের জ্ঞাননির্ভর কৃষি এক নতুন ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে। সেজন্য চাই পরিকল্পিত ও সুসমন্বিত সময়োচিত পদক্ষেপ ও দক্ষ নেতৃত্ব। কৃষিই আমাদের কৃষ্টি। কৃষির বিকল্প কেবল কৃষিই।

বাংলাদেশে এরই মধ্যে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় কৃষি গবেষণা সিস্টেম (NARS) ফসলের নতুন জাত উদ্ভাবন ও স্মার্ট ডায়াগনস্টিক পদ্ধতির উন্নয়নের জন্য গবেষণা প্রকল্প শুরু করেছে। গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে—১. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্লাস্ট প্রতিরোধী গমের জাত উদ্ভাবনের জন্য গমের এস-জিন সম্পাদনার জন্য কাজ করছে। তারা এরই মধ্যে জিনোম-নির্দিষ্ট প্রাইমার এবং ক্রিসপার প্রযুক্তি ব্যবহার করে গমের ব্লাস্ট ছত্রাক নির্ণয়ের জন্য একটি দ্রুত এবং পয়েন্ট-অব-কেয়ার পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে। এ প্রযুক্তিকে কৃষিতে একটি সর্বশ্রেষ্ঠ উদ্ভাবন বিবেচনা করে বিশ্বব্যাপী প্রয়োগের লক্ষ্যে এরই মধ্যে বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন তিন বছর মেয়াদি প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে। জেনেটিক কোড এবং ক্রিসপার-ভিত্তিক এ প্রযুক্তিকে সহজেই অন্যান্য উদ্ভিদ ও প্রাণীর রোগ শনাক্তকরণে সম্প্রসারণ করে কৃষি খাদ্য উৎপাদনে এক শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। ২. বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট সেরোটোনিন উৎপাদনকারী জিনগুলোকে অপসারণ করে পোকা প্রতিরোধী ধানের জাত এবং বিডিএইচ-২ জিন এডিট করে একটি উচ্চফলনশীল সুগন্ধি ধানের জাত উদ্ভাবনের জন্য কাজ করছে। ৩. ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি অ্যাবায়োটিক স্ট্রেস সহনশীল বেগুন এবং ধানের জাত উদ্ভাবনের জন্য কাজ করছে। এছাড়া স্টার্চ ব্রাঞ্চিং এনজাইম সম্পাদনা করে ডায়াবেটিস-বান্ধব উচ্চ অ্যামাইলোজ-ধারণকারী ধান উদ্ভাবন করছে, যা অ্যামাইলোজের সঙ্গে অ্যামাইলোপেক্টিনের অনুপাত বাড়ায়, ফলে রক্তে চিনির নিঃসরণ কম হয়। ৪. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিউকুলার বায়োলজি বিভাগ ধানের লবণাক্ততা সহনশীলতা উন্নয়নে কাজ করছে। বাংলাদেশের অন্যান্য ইনস্টিটিউটের গবেষকদের মধ্যে জলবায়ু-স্থিতিস্থাপক প্রযুক্তির জন্য নির্ভুলভাবে এবং দ্রুততম সময়ে প্রজননের জন্য ক্রিসপার-কাস জিনোম এডিটিংয়ে আগ্রহ বাড়ছে।

শুধু কৃষিতেই নয়, জিনোম এডিটিং প্রযুক্তি রোগনির্ণয়, মানুষ ও প্রাণীর জেনেটিক ও বিপাকীয় রোগ নিরাময়ে বিপ্লব ঘটাবে। জ্বালানি উৎপাদন, খাদ্যনিরাপত্তা বৃদ্ধিতেও এ প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। ক্রিসপার-কাস সিস্টেম মৌলিক গবেষণার জন্য একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। বৈপ্লবিক জিনোম এডিটিং প্রযুক্তির সুবিধা কাজে লাগাতে বাংলাদেশ সরকারকে সক্ষমতা বৃদ্ধি, গবেষণার জন্য অর্থায়ন এবং যথাযথ নীতি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের পাঠক্রমে বৈপ্লবিক জিনোম এডিটিং প্রযুক্তির তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক বিষয়াবলি সংযোজন করে নতুন প্রজন্মকে জ্ঞান ও দক্ষতায় বিশ্বমানের নাগরিক হওয়ার পথ সুগম করা প্রয়োজন। লাভজনক কৃষি এবং টেকসই লক্ষ্য অর্জনের জন্য জাতীয়ভাবে প্রয়োজনভিত্তিক গবেষণার জন্য একটি জাতীয় দল গঠন এবং অর্থায়ন করা উচিত। জিনোম সম্পাদনার সঠিক ও সময়োপযোগী প্রয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ কৃষি এবং শিল্প বিপ্লবের একটি গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে নেতৃত্ব দিতে পারে।

অধ্যাপক ড. মো. তোফাজ্জল ইসলাম: ফেলো, বাংলাদেশ ও বিশ্ব বিজ্ঞান একাডেমি এবং অধ্যাপক, ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং (আইবিজিই), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন