ঋণ আদায় প্রক্রিয়া সহজ ও ত্বরিত না হলে ব্যাংকের সংকট আরো বাড়বে

ছবি : বণিক বার্তা

অর্থনীতিবিদ ও গবেষক ড. জায়েদ বখ্ত ২০১৪ সাল থেকে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে ছিলেন সোনালী ব্যাংকের পরিচালক। ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক এবং ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের ইসলামাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় (বর্তমানে কায়েদ-এ-আযম বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে এমএসসি সম্পন্ন করেন করেন। যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল ইউনিভার্সিটি থেকে দ্বিতীয়বার অর্থনীতিতে এমএসসি এবং ১৯৭৮ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। সামষ্টিক অর্থনীতি ও ব্যাংক খাতের সংকট ও সম্ভাবনা নিয়ে সম্প্রতি কথা বলেন বণিক বার্তায়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হাছান আদনান

অর্থনীতিবিদ ও গবেষক হিসেবে চার দশক ধরে আপনি বাংলাদেশের অর্থনীতি বিনির্মাণের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ২০১৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে দেশের ব্যাংক খাতকে ভেতর থেকে দেখছেন। অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতার আলোকে দেশে বিরাজমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই।

বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি এ মুহূর্তে বেশকিছু চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছে। এ চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করা আরো কিছু ফ্যাক্টরের ওপর নির্ভর করছে। আমরা দেখেছি, শ্রীলংকা যে ধরনের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল, সেখান থেকে যথেষ্ট উত্তরণ করতে পেরেছে। অথচ আমরা দেখছি, আমাদের কিছু সংকট আরো বেড়ে যাচ্ছে। শ্রীলংকার আর আমাদের সংকটের মধ্যে বেশকিছু ভিন্নতা রয়েছে। যেমন শ্রীলংকা থেকে পুঁজি পাচারের সংকট তেমন নেই। কিন্তু আমাদের দেশের জন্য এটি একটি বিরাট সংকট। 

গভর্নর নিজেই হিসাব দিয়েছেন, দুবাইয়ে বাংলাদেশীদের কতগুলো কোম্পানি খোলা হয়েছে। পর্তুগালে বিনিয়োগ করে কতজন বাংলাদেশী নাগরিকত্ব নিয়েছে। এগুলো বাংলাদেশ থেকে পাচারকৃত অর্থেই হয়েছে। ক্রমাগত পুঁজি পাচার দেশের ব্যালান্স অব পেমেন্টের ওপর ব্যাপক মাত্রায় চাপ তৈরি করেছে। পাচারকৃত অর্থ তেমন কোনো হিসাবেই আসে না। কিন্তু দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের ওপর ভয়াবহ রকমের চাপ তৈরি করে।

দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য আপনি অনেকগুলো চ্যালেঞ্জের কথা বলছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর সংকট কোনটিকে মনে করছেন?

এ মুহূর্তে দেশের ব্যালান্স অব পেমেন্টের (বিওপি) ঘাটতিকেই আমি সবচেয়ে বড় সংকট বলে মনে করি।  কারণ এ সংকটের অনেক উপাদানই আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। শ্রীলংকার বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস হলো পর্যটন। কভিড-১৯ সৃষ্ট দুর্যোগের সময় দেশটির পর্যটন খাত স্থবির হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে পর্যটন খাত ঘুরে দাঁড়িয়েছে। দেশটির স্থানীয় মুদ্রার বিপুল অবমূল্যায়ন হয়েছিল। এ কারণে পর্যটকরা অনেক কম খরচে দেশটি ভ্রমণ করতে পেরেছে। কভিডের মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রবৃদ্ধির ধারায় ছিল। এখন আমরা চাইলেও চলমান কোনো উন্নয়ন প্রকল্প বন্ধ করে দিতে পারব না। সরকারের ব্যয়ের যেসব চাপ আছে, সেগুলোও একেবারে কমিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। এ অবস্থায় ব্যালান্স অব পেমেন্টের ঘাটতি কাটিয়ে ওঠা বেশ কঠিন।

দ্বিতীয় বড় চ্যালেঞ্জ হলো মূল্যস্ফীতি। গত বছরজুড়ে দেশে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি দেখেছি। বাংলাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক বাস্তবতায় এ হার অনেক বেশি। মানুষের জ্বর আর অর্থনীতির মূল্যস্ফীতির চিকিৎসার মধ্যে সাদৃশ্য আছে। জ্বর বেড়ে গেলে বরফ দিতে হয়। আর মূল্যস্ফীতি তেতে উঠলে সুদহার বাড়াতে হয়। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মৌলিক চিকিৎসাই এটি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এরই মধ্যে ব্যাংক ঋণের সুদহার কয়েক দফায় বাড়িয়েছে। নতুন মুদ্রানীতিতেও সুদহার বাড়ানোর ইঙ্গিত আছে। বাজারে মুদ্রা সরবরাহ কমিয়ে আনলে মূল্যস্ফীতি অবশ্যই সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসতে বাধ্য।

দেশের আর্থিক হিসাবের ঘাটতিও বড় হচ্ছে। অর্থনীতিতে এ ঘাটতির প্রভাব কতটুকু?

আর্থিক হিসাবের ঘাটতি দেশের অর্থনীতির জন্য বড় বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সচরাচর বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের মনোযোগ থাকত সরকারের চলতি হিসাবের ওপর। এ হিসাব বেশির ভাগ সময়ই ঘাটতিতে থাকত। আমদানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে চলতি হিসাবের ভারসাম্য উদ্বৃত্তের ধারায় নিয়ে আসা হয়েছে। তার পরও আমরা দেখছি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। দেশের আর্থিক হিসাবের বড় ঘাটতি তৈরি হওয়ার কারণেই রিজার্ভের ক্ষয় থামানো যাচ্ছে না। গত ১৪ বছরে আমরা কখনই এ হিসাবে ঘাটতি হতে দেখিনি। আর্থিক হিসাবের উপাদানগুলো হলো বিদেশী বিনিয়োগ, বিদেশী দান-অনুদান ও ঋণ। আন্তর্জাতিক বাজারে এখন সুদহার বেশ চড়া। এ কারণে বিদেশী অনেক প্রতিষ্ঠান এখন থেকে স্বল্পমেয়াদি ঋণ প্রত্যাহার করেছে। এক্ষেত্রে দেশে ডলার সংকট, ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাওয়াসহ অর্থনীতির অন্য সংকটগুলোর ভূমিকাও আছে।

আমাদের ডলারের চাহিদা ও জোগানের মধ্যে দুটি বিষয় আছে। প্রথমত আইনসিদ্ধ খাতে ডলারের চাহিদা। অন্যটি আইনে অনুমোদিত নয়, এমন খাতের ডলারের চাহিদা। রিয়েল ইফেক্টিভ রেট হিসাবায়ন করে ডলারের প্রকৃত দর নির্ধারণ করা দরকার। এটির জন্য যদি দেশের মূল্যস্ফীতি বাড়েও তাহলে সেটি মোকাবেলা করতে হবে। কিন্তু আইন অনুমোদন করে না, এমন খাতের তথা হুন্ডির বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার, অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংককে কঠোর হওয়া দরকার। ব্যাংকে ডলারের দর ১১৫ টাকা হলে হুন্ডিতে সেটি বেড়ে ১২০ টাকা হয়ে যাবে। এরই মধ্যে আমরা কার্ব মার্কেটে ডলারের দর ১২৭-১২৮ টাকা পর্যন্ত উঠে যেতে দেখেছি। হুন্ডি বা কার্ব মার্কেটকে অনুসরণ করে ব্যাংক খাতে ডলারের দর নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। গুটিকয়েক পাচারকারীর জন্য গোটা জনগোষ্ঠীকে ভুক্তভোগী করা যাবে না। সংকটকালে অর্থনীতিকে সুরক্ষা দেয়ার জন্যই আমরা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষণ করি। এ রিজার্ভ আরো কমলে কমবে। বিনিময়ে ডলারের বিনিময় হারকে স্থিতিশীল করতে হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, রেমিট্যান্সের ডলার বেশি দামে কিনলেও সর্বোচ্চ ১১০ টাকায় বিক্রি করতে হবে। এটি কতটা বাস্তবসম্মত বলে মনে করেন?

এটি একেবারেই অসম্ভব। বেশি দামে ডলার কিনে সেটি কম দামে বিক্রি করার বিষয়টি যৌক্তিকও নয়। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ব্যবসায় উন্নয়ন খাত কিংবা সিএসআর থেকে এ ব্যয় মেটানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু বেসরকারি অনেক ব্যাংকের সে অর্থে সিএসআর তহবিলও থাকে না। তারা হয়তো অন্যভাবে এ আয়-ব্যয়ের হিসাব রাখবে। ডলারের বিনিময় হার নিয়ে এ ধরনের লুকোচুরি ঠিক হচ্ছে না।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কেবল সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা কি সম্ভব, যেখানে কোনো উপলক্ষ ছাড়াই ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয় বলে অহরহ অভিযোগ উঠছে?

আমার দুঃখ লাগে মূল্যস্ফীতি কমাতে যারা সুদহার বাড়ানো বা সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির পক্ষে বলেন তারা বিষয়টিকে আরেকটু বিস্তারিত করে বলেন না। সুদহার বাড়ালে কীভাবে মূল্যস্ফীতি কমবে, সেটি বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা হয় না। এক্ষেত্রে খুব হালকাভাবে যেটা বলা হয় এবং টেক্সটবুক যা বলে সেটা হচ্ছে, সুদহার বাড়ালে ঋণের চাহিদা কমবে। ঋণের চাহিদা কমলে বাজারে অর্থ সরবরাহও কমবে। অর্থ সরবরাহ কমলে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ তৈরি হবে। সুদহার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয়ার পরও দেশের বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি বাড়েনি। ১৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করলে অর্জিত হয়েছে ১২ শতাংশ। আর ১২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করলে সেক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ শতাংশ। এ অবস্থায় সুদহার বাড়িয়ে ঋণপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে কেন? অর্থের প্রবাহ তো এমনিতেই নিয়ন্ত্রিত হয়ে আছে। ব্রড মানির (ব্যাপক মুদ্রা) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যও অর্জিত হচ্ছে না। এ অবস্থায় সুদহার বাড়িয়ে কেন আমি ঋণপ্রবাহ কমাতে যাব? আর বাজারের সিন্ডিকেট বা মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য তো রয়েছেই।

মূল্যস্ফীতি কমানোর লক্ষ্যে যে নীতি নেয়া হয়েছে, সেটিতে কোনো ভুল দেখছেন কিনা?

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ (আইএমএফ) বাংলাদেশের সব নামকরা অর্থনীতিবিদ একযোগে সুদের হার বাড়াতে বলেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকও সে আহ্বানে সাড়া দিয়েছে। এক্ষেত্রে কিছুটা যুক্তি আছে। মূলস্ফীতি হলো চাহিদা-সরবরাহের মিথস্ক্রিয়া। যদি চাহিদা অনেক বেড়ে যায় কিংবা পণ্যের সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটে তখনই মূলস্ফীতি বাড়ে। এ দুটোতে কোনো পরিবর্তন না হয়েও মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে। যদি মানুষের মাথায় এ চিন্তা থাকে যে জিনিসের দাম তো বাড়বে। এটি হলো ইনফ্লেশনারি এক্সপেক্টেশন। এ ধরনের পরিস্থিতিতে পণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। তখন সরবরাহেও টান পড়ে। এটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে কিছু দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে হবে। ব্যাংকের বাইরে তথা মানুষের হাতে থাকা নগদ অর্থের পরিমাণ বেশ বেড়ে গেছে। মানুষের মাথায় এটি ঢুকে গিয়েছিল যে ব্যাংকে টাকা রেখে লাভ নেই। জিনিসপত্রের দাম বাড়বে, সুতরাং আমি এটা-ওটা কিনে ফেলি। তবে আমি মনে করি, সুদহারকে বাস্তবতার কাছাকাছি আনতে এটি ভালো পদক্ষেপ। এ সুদহারকে লাগামহীনভাবে বাড়তে দেয়া যাবে না। এটি যেন ১৭-১৮ শতাংশ না হয়ে যায় সেটির প্রতি লক্ষ রাখতে হবে।

তবে এটার ফলে মূল্যস্ফীতি কমবে সেটা আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি না। কারণ এতে অর্থের প্রবাহে তেনম কোনো প্রভাব পড়বে না। ইনফ্লেশনারি এক্সপেক্টেশন কিছুটা কমতে পারে। মূল্যস্ফীতি এতটা বেড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ডলারের বিনিময় হারের বড় ভূমিকা রয়েছে। কিছু মানুষ জিজ্ঞাসা করে, ডাবের দাম বাড়ে কেন? এটা কি আমদানি করা হয়? এর উত্তর হলো ডাব বিক্রেতা মনে করছে, সবকিছুর দাম যেহেতু বাড়ছে, ডাবের দামও বাড়বে।

দেশের ব্যাংক খাতের ভঙ্গুরতা নিয়ে নানা কথা হচ্ছে। বর্তমান বাস্তবতায় ব্যাংক খাত দেশের অর্থনীতির চাহিদার কতটুকু পূরণ করতে পারছে? ভবিষ্যতে কতটুকু পারবে?

বাংলাদেশের অর্থনীতির আজকের অবস্থানে আসার প্রধান কৃতিত্ব ব্যাংক খাতের। স্বাধীনতার সময়ে আমাদের শিল্প খাতের অবদান ছিল ৯-১০ শতাংশ। এটা এখন প্রায় ৩০ শতাংশের কাছাকাছি। যেকোনো বিনিয়োগেই অর্থায়নের দরকার হয়। এ অর্থায়ন কোত্থেকে এসেছে। অবশ্যই ব্যাংক খাত থেকে। সরকারি-বেসরকারি উভয় শ্রেণীর ব্যাংকের এক্ষেত্রে অবদান রয়েছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো প্রজেক্ট ফাইন্যান্সিংয়ে বেশি ঋণ দিয়েছে। বেসরকারি ব্যাংক স্বল্পমেয়াদি ঋণ বেশি দেয়। তারা দীর্ঘমেয়াদে ঋণ দিতে চায় না। আমরা দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে প্রজেক্টকেও জামানত হিসেবে নিয়েছি। যেকোনো প্রজেক্টই সময়ের সঙ্গে ডিপ্রিশিয়েট করবে। উদ্যোক্তা যদি ঠিকমতো ঋণের অর্থ ফেরত না দেয় তাহলে জামানতের চেয়ে দেনা বেশি হয়ে যায়। এ ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও ব্যাংকগুলো শিল্প প্রতিষ্ঠায় অর্থায়ন করেছে। 

আমাদের ব্যাংক খাতে বিশেষ করে সরকারি ব্যাংকগুলোর যে দুর্বলতা, সেগুলো যে হঠাৎ করে খুব বেশি খারাপ হয়ে গেছে তা নয়।  দীর্ঘদিন ধরেই ব্যাংক খাতে অযাচিত হস্তক্ষেপ, কারসাজি, ইচ্ছাকৃত খেলাপির চর্চা আছে। আমি সত্যিকার অর্থে মনে করি, এ পরিস্থিতি সংশোধনের ক্ষেত্রে আমরা সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারিনি। আমরা সব সময়ই একেবারে শেষ মুহূর্তে গিয়ে সজাগ হই।

অনেক সময় সব রীতিনীতি মেনে কোনো ঋণ দেয়ার পরও সেটি খেলাপি হয়ে যায়। ঋণ আদায় করতে হলে ব্যাংকগুলোকে আইনি প্রক্রিয়ায় যেতে হচ্ছে। দেশের কোনো ব্যাংকই আইনি প্রক্রিয়ায় গিয়ে প্রভাবশালী খেলাপিদের কাছ থেকে টাকা আদায় করতে পারছে না। কারণ প্রভাবশালী ঋণখেলাপিরা চাইলেই আদালত থেকে স্টে অর্ডার নিয়ে আসছে। ব্যাংকের বিরুদ্ধে উল্টো পাঁচ-সাতটা মামলা করে দিচ্ছে। 

উচ্চ আদালতে রিট আবেদনগুলো নিষ্পত্তি করা গেলে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ অর্ধেকে নেমে আসবে। রায় ব্যাংকের বিরুদ্ধে গেলেও আমরা উপকৃত হব। কারণ তখন পুরোপুরি আদায় না হলেও সে ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হবে না। আইনজীবীর ফি লাগবে না। এ বিষয়গুলো আমরা জানা সত্ত্বেও কিছু করতে পারছি না।

ব্যাংকগুলোর ওপর অযাচিত হস্তক্ষেপ কিংবা অনৈতিক চাপের কথা বলছেন। আপনি তো টানা নয় বছর ধরে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। এক্ষেত্রে আপনার অভিজ্ঞতা কী? চাপের কাছে নতি স্বীকার করতে কখনো বাধ্য হয়েছেন কিনা?

কোনো প্রজেক্ট যদি এমন হয়, যেখানে অর্থায়নের কোনো মানেই হয় না। ঋণ দিলে সে টাকা কখনো ফেরত আসবে না। চাইলে সে প্রস্তাব বিভিন্নভাবে প্রতিরোধ করা যায়। সোনালী ব্যাংকের পরিচালক থাকার সময় আমাদের কাছে অনেক উচ্চ পর্যায় থেকে একটি প্রজেক্টে ঋণ দেয়ার জন্য চাপ এসেছিল। তখন পরিচালনা পর্ষদের পক্ষ থেকে আমরা সরাসরি অর্থমন্ত্রীর কাছে গিয়ে বিষয়টি জানিয়েছিলাম। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আমাদের পূর্ণ সমর্থন করেছিলেন। প্রজেক্টের অস্তিত্বই নেই, এমন কোনো ঋণ দেয়ার চাপ এলেও সেটি প্রত্যাখ্যান করা যায়। হলমার্কের ঘটনার পর ব্যাংকগুলোর পর্ষদ অনেক সচেতন হয়েছে। পর্ষদে অনেক যোগ্য ও সৎ মানুষও আছেন। যারা যেকোনো বিষয়ে সাহসের সঙ্গে মতামত দেন। কিন্তু সমস্যা হয়ে যায় তখন যখন ঋণগ্রহীতা অনেক বেশি প্রভাবশালী হয়। সোনালী ব্যাংকে আমি দেখেছি, একটি ঋণই ১৪ বার পর্যন্ত পুনঃতফসিল হয়েছে। 

অগ্রণী ব্যাংক কেমন আছে?

আমরা অনেক সূচকেই যথেষ্ট ভালো করেছি। আমানত ও ঋণ প্রবৃদ্ধি যথেষ্ট ভালো আছে। এখন অগ্রণী ব্যাংকের আমানত প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা। দেশের অনেক ব্যাংকই তারল্য নিয়ে চাপে আছে। কিন্তু আমরা কোনো চাপ অনুভব করছি না। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক হিসেবে আমাদের ওপর মানুষের সে আস্থা আছে। অগ্রণী ব্যাংকের ঋণ-আমানত অনুপাত (এডি রেশিও) ৭০ শতাংশ। এটি যেকোনো ব্যাংকের জন্যই স্বাচ্ছন্দ্যের। আমাদের ব্যাংকের আমদানি ও রফতানি প্রবৃদ্ধিও যথেষ্ট ভালো। রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধিও মোটামুটি। কিন্তু সমস্যা হলো, টাকার হিসাবে আমদানির ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। ১০০ ডলারের পণ্য আমদানিতে আগের চেয়ে অনেক বেশি টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে। এ কারণে চাপমুক্ত হওয়া যাচ্ছে না। 

জ্বালানি তেল, এলএনজি, সারসহ সরকারি আমদানির এলসি আমাদের খুলতে হচ্ছে। এটি এক ধরনের রাষ্ট্রীয় বাধ্যবাধকতা। এ কারণে আমাদের অনেক বেশি ডলারের সংস্থান করতে হচ্ছে। সরকারি এলসিগুলো নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার সহায়তা দিচ্ছে। তা সত্ত্বেও আমাদের চাপে থাকতে হচ্ছে। ডলারের বিনিময় হারের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো স্থিতিশীল নীতি দিতে না পারায় অগ্রণী ব্যাংকের এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো রেমিট্যান্স কিনতে পারছে না। বেশি দর পাওয়ার কারণে প্রবাসীরা বেসরকারি ব্যাংক কিংবা বিদেশী এক্সচেঞ্জ হাউজের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন।

ব্যাংক খাতের সবচেয়ে বড় সমস্যা কোনটি বলে মনে করেন?

বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের সমস্যাগুলো চিহ্নিত। এগুলোর বিষয়ে কমবেশি আমরা সবাই জ্ঞাত। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও প্রভাবশালী গ্রাহকদের ঋণকে অনেকে বড় করে দেখাতে চায়। কিন্তু এটি ব্যাংক খাতের সবচেয়ে বড় সমস্যা বলে আমি মনে করি না। বরং ব্যাংক খাতের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ঋণ আদায় প্রক্রিয়া। ঋণ আদায় প্রক্রিয়া সহজ ও ত্বরিত না হলে এ সংকট আরো বাড়বে। সুনামধারী কোনো বেসরকারি ব্যাংক একজন গ্রাহককে সব বাছবিচার করে ঋণ দিল। এরপর খেলাপি হয়ে গেলে সর্বশক্তি নিয়োগ করেও সে ব্যাংক ঋণ আদায় করতে পারছে না। আদালতের দীর্ঘসূত্রতা আর রিটের পরিপ্রেক্ষিতে স্থগিতাদেশ ব্যাংক খাতকে পিছিয়ে দিচ্ছে। এখানে রাজনৈতিক প্রভাব মুখ্য নয়। আমাদের একজন খেলাপি গ্রাহক তার সব সম্পত্তি স্ত্রীর নামে লিখে দিয়েছে। সে একেবারেই সাধারণ ব্যক্তি। আইনি প্রক্রিয়ায় গিয়ে আমরা তার কাছ থেকেই ঋণ আদায় করতে পারছি না। তাহলে প্রভাবশালীদের কাছ থেকে ব্যাংক টাকা আদায় করবে কীভাবে?

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন