ঢাকার প্রাথমিক পর্যায়ের ৮০% শিক্ষার্থীই পড়াশোনা করছে বেসরকারি স্কুলে

ফাতেমা-তুজ-জিনিয়া

ছবি : বণিক বার্তা

দেশজুড়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের উদ্দেশ্য ছিল বিনামূল্যে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা। প্রায় প্রতিটি জেলায়ই প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম চলছে এসব বিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে। প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে এখানেই। ব্যতিক্রম শুধু ঢাকা। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এখানকার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ছে প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিকের মাত্র ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী। বাকি ৮০ শতাংশই অধ্যয়ন করছে বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। 

যদিও ঢাকার বাইরে প্রাইমারি পর্যায়ের শিক্ষার্থীর অর্ধেকেরও বেশি পড়াশোনা করছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বিভাগীয় শহরগুলোর মধ্যে চট্টগ্রামে ৫৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ, রাজশাহীতে ৬৪ দশমিক ১১, রংপুরে ৪৮ দশমিক ৯, খুলনায় ৬৪ দশমিক ১৯, ময়মনসিংহে ৫৭ দশমিক ২৪, সিলেটে ৬৭ দশমিক ২ ও বরিশালে ৭৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে সরকারি বিদ্যালয়ে। 

প্রাথমিক শিক্ষা পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে, ঢাকায় প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩ লাখ ২২ হাজার ৯০৭ জন। তাদের মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ছে ৪৫ হাজার ৪১৮ জন, যা মোট শিক্ষার্থীর মাত্র ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ। অন্যদিকে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৩ লাখ ৫২ হাজার ৭২৩। তাদের মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ছে মাত্র ২ লাখ ৯০ হাজার ৬০৩ জন, যা মোট শিক্ষার্থীর ২১ দশমিক ৪৮ শতাংশ। সব মিলিয়ে এখানে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক পর্যায়ে মোট শিক্ষার্থীর মাত্র ২০ দশমিক ৬ শতাংশ পড়াশোনা করছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার অভাব, নিরাপত্তা ব্যবস্থার অপর্যাপ্ততা, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আধিক্য এবং আর্থিকভাবে সচ্ছল ব্যক্তিদের অনীহার কারণেই ঢাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থীরা কম ভর্তি হচ্ছে। 

ঢাকায় সরকারি প্রাথমিকে শিক্ষার্থী কম ভর্তি হওয়ার বিষয়টি কাটিয়ে উঠতে গবেষণানির্ভর পদক্ষেপ প্রয়োজন বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বরাবরই ঢাকা জেলায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আধিক্য দেখা যায়। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর অবকাঠামো জরাজীর্ণ, নিরাপত্তাব্যবস্থা অপর্যাপ্ত। মূলত এসব কারণেই শিক্ষার্থী কম ভর্তি হয়। এছাড়া অনেক জায়গায় দেখা যায়, সরকারি প্রাথমিকের শিক্ষকরা কোচিং ব্যবসায় জড়িত এবং শিক্ষার্থীদের ভালো ফল করতে কোচিংয়ে ভর্তি হতে হচ্ছে। ফলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আপাতদৃষ্টিতে খরচ কম হলেও কোচিংয়ের কারণে খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এ কারণেও অনেক অভিভাবক সরকারি প্রাথমিকে সন্তানকে পড়াতে চান না। বিষয়টি কাটিয়ে উঠতে হলে সরকারের গবেষণা করতে হবে, কেন সরকারি প্রাথমিকে ঢাকার অভিভাবকরা সন্তানদের পড়াচ্ছেন না সেটি শনাক্ত করতে এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে। গবেষণায় যদি দেখা যায়, অবকাঠামো সমস্যা প্রধান কারণ; তাহলে ভালো অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে। আর গবেষণায় যদি অন্য কোনো কারণ উঠে আসে, সেটি সমাধানে পদক্ষেপ নিতে হবে।’

সরজমিনে ঢাকার বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ বিদ্যালয়ই জরাজীর্ণ ভবনে কার্যক্রম চালাচ্ছে। নেই কোনো খেলার মাঠ। এমনকি অনেক বিদ্যালয়ের জমিও বেদখল হয়ে গেছে। শিক্ষক ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এসব বিদ্যালয়ে যারা পড়াশোনা করছে, তাদের প্রায় সবাই নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। এসব শিক্ষার্থীর ৩০-৪০ শতাংশই প্রায় নিয়মিত ক্লাসে অনুপস্থিত থাকে।

রমনা থানার প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শাহানাজ বেগম বলেন, ‘‌আমাদের ঢাকার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অবকাঠামোগত একটি বড় সমস্যা রয়েছে। রমনা থানায় নয়টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে একটির জায়গা সম্পূর্ণরূপে কাঁচাবাজার বসিয়ে দখল করা হয়েছে। বাকিগুলোর মধ্যে দিলকুশা বিদ্যালয়ের জমি নিয়ে সমস্যার কারণে কাজ শুরুই করা যাচ্ছে না। আর বাকি সাতটির মধ্যে পাঁচটিরই খেলার মাঠ নেই এবং ভবন জরাজীর্ণ। এছাড়া স্কুলগুলোয় পরিচ্ছন্নতাকর্মী এবং গেটে দারোয়ান রাখার ব্যবস্থা নেই। ফলে অনেক সময় বিদ্যালয়গুলো নোংরা থাকছে। নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। স্বাভাবিকভাবেই এমন পরিবেশে অভিভাবকরা সন্তানদের পড়াতে চান না। আর ঢাকায় যেহেতু বিকল্প শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সুযোগ বেশি, অর্থ ব্যয় করে হলেও তারা সেখানে যাচ্ছেন।’

খোদেজা খাতুন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় অবস্থিত রাজধানীর বাংলামোটরে। স্কুলটি কার্যক্রম চালাচ্ছে চারতলা বিশিষ্ট বেশ পুরনো একটি ভবনে। মূল সড়কের কাছাকাছি অবস্থিত স্কুলটিতে নেই কোনো খেলার মাঠ বা খোলা জায়গা। স্কুলটিতে কাগজে-কলমে শিক্ষার্থীর সংখ্যা দুই শতাধিক। যদিও গতকাল সেখানে উপস্থিত ছিল মাত্র ৪০-৫০ জন। আর সাত শিক্ষকের মধ্যে উপস্থিত পাওয়া গেছে তিনজনকে। দেখা মেলেনি প্রধান শিক্ষকেরও। 

সেগুনবাগিচার নিধুস্মৃতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, এখানে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে তিনতলা একটি ভবনে। এখানেও শিক্ষার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত খেলার মাঠ নেই। স্কুলের প্রধান শিক্ষক জাহানারা পারভীন বলেন, ‘‌আমাদের একটি বড় সংকট হলো বেশির ভাগ শিক্ষার্থী নিম্নবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর। মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত দুয়েকজন যারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করান, তারা সাধারণত বেসরকারি স্কুলে ভর্তির পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে বা শিক্ষার্থীকে প্রাথমিক পর্যায়ে স্কুলের সঙ্গে পরিচিত করে তুলতেই পাঠান। ‌সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তরা সন্তানদের ভর্তি না করানোর একটি বড় কারণ হলো আমাদের ভবনগুলো খুব একটা ভালো নয়। গেটেও দারোয়ান বা নিরাপত্তাব্যবস্থা নেই। এছাড়া অনেক অভিভাবক মনে করেন যত বেশি বই, তত ভালো পড়ালেখা। এ কারণেও তারা শিক্ষার মান যাচাই না করে শুধু বইয়ের সংখ্যা বিবেচনা করে কিন্ডারগার্টেনের প্রতি বেশি আগ্রহী হন। যদি সরকার নিয়ম করে দিত শিক্ষার্থীদের ওপর বাড়তি বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দেয়া যাবে না, তাহলে হয়তো অভিভাবকরা এ ধারণা থেকে বেরিয়ে আসত।’

বেইলি রোডে অবস্থিত সামাজিক শিক্ষা কেন্দ্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, ভবন নির্মাণাধীন থাকায় স্কুলটির শিক্ষা কার্যক্রম চলছে বেসরকারি কিন্ডারকার্টেন প্রিপারেটরি স্কুলের একটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে। দিলকুশা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, ভবন না থাকায় এ বিদ্যালয়টির শিক্ষা কার্যক্রম চলছে ফকিরাপুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।

এছাড়া মাধ্যমিক পর্যায়ে উঠে স্কুল পরিবর্তনের ঝামেলা এড়াতেও অনেক অভিভাবক সন্তানদের সরকারি প্রাথমিকে ভর্তি করতে চান না বলে মনে করছেন ঢাকা জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আব্দুল মজিদ। তিনি বলেন, ‘‌আমাদের অভিভাবকরা স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তার সন্তানকে ভর্তি করাতে চান। এর একটা বড় কারণ যে শিক্ষার্থী একবার এসব স্কুলে প্রাথমিকে ভর্তি হয়, পরবর্তী সময়ে মাধ্যমিকে উঠতে হলে তাকে আর পরীক্ষা দিতে হয় না, কোনো স্কুলে চান্স পেতে হয় না। অভিভাবকরা নির্ভার থাকে। ঢাকায় যেহেতু এ ধরনের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেশি, তাই অভিভাবকরা নির্ভার থাকতে এ প্রতিষ্ঠানগুলোকেই বাছাই করে।’

পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা ও শিক্ষার মান নিশ্চিত করা গেলে রাজধানীর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েও শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়বে বলে প্রত্যাশা করছেন ঢাকা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. আবদুল আজিজ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘‌আমাদের যেসব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত শিক্ষক আছে, শ্রেণীকক্ষ আছে, ভালো সুযোগ-সুবিধা আছে; সেখানে ভালো সংখ্যক শিক্ষার্থীও ভর্তি হচ্ছে। ঢাকায়ও আমরা প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা উন্নয়নে কাজ করছি।’

বর্তমানে দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর উন্নয়নে পিইডিপি-৪ প্রকল্প চলমান রয়েছে। সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত সচিব এবং এ প্রকল্পের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ড. উত্তম কুমার দাশ বলেন, ‘‌ঢাকায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মূল সমস্যা অবকাঠামোগত। এ সমস্যা দূর করতে ৩৪৬টি বিদ্যালয়ে দৃষ্টিনন্দন ভবন নির্মাণের প্রকল্প চলছে। প্রকল্পটি শেষ হলে অবকাঠামোগত সমস্যা দূর হবে এবং তখন অনেক শিক্ষার্থীও বাড়বে বলে আশা করছি। এছাড়া সারা দেশেই প্রাথমিক পর্যায়ে এখনো আমরা টিচিং-লার্নিং সিস্টেমটি পুরোপুরি উন্নয়ন করতে পারিনি। এ বিষয়ে কাজ চলছে। আমাদের পরবর্তী প্রকল্পে সবচেয়ে জোর দেয়া হবে মানসম্মত শিক্ষায় এবং এর ফলে আগামীতে শিক্ষার্থী বাড়বে বলে আমি আশাবাদী।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন