প্রদর্শনী

অবিচ্ছেদ্য সংযোজনের দ্বৈবিধ্য

ফারিহা আজমিন

‘‌দ্বৈবিধ্য—মা ও সন্তান, অবিচ্ছেদ্য সংযোজন’ ছবি: সালাহউদ্দিন পলাশ

লালমাটিয়ায় অবস্থিত কলা কেন্দ্রে এবার ভিন্ন রকমের আয়োজন করা হয়েছে। ভিন্নমাত্রার চিত্র প্রদর্শনী নিয়ে আয়োজিত হয়েছে দ্বৈবিধ্য। মা ও সন্তান অবিচ্ছেদ্য সংযোজন বিষয়টিকে প্রদর্শনীটিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। প্রদর্শনীটি শুরু হয়েছে ১৯ জানুয়ারি এবং চলবে ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত। প্রদর্শনীর মূল লক্ষ্য একজন মায়ের শিল্পী ও ব্যক্তিজীবনের সব কঠিন অবস্থাকে মোকাবেলা করে নিজ পরিকল্পনাকে অক্ষুণ্ন রাখার গল্প জনসম্মুখে প্রকাশ করা। নারী, শিল্পী ও দায়বদ্ধ মায়ের প্রচেষ্টার প্রতিচ্ছবি সমাজের সবার সামনে উপস্থাপনের প্রয়াস হিসেবে এ প্রদর্শনী আয়োজনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রদর্শনীটি পরিদর্শনে দর্শক ভিন্নমাত্রার চিন্তা করার রসদ খুঁজে পাবেন বলেই মনে করেন প্রদর্শনীটির কিউরেটর আবু কালাম শামসুদ্দিন। তিনি বর্তমানে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্কন ও চিত্রায়ণ বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি অটিস্টিক শিশুদের নিয়ে নানা ধরনের কাজ করেন। সেই জায়গা থেকেই শিল্পী সালমা জাকিয়া বৃষ্টি ও তার ছোট সন্তান মাশরাফি আভিনের আঁকা ছবিগুলো নিয়ে আয়োজন করা হয়েছে ‘‌দ্বৈবিধ্য—মা ও সন্তান, অবিচ্ছেদ্য সংযোজন’ শীর্ষক প্রদর্শনী। অধ্যাপক আবু কালাম শামসুদ্দিন এ আয়োজনকে দর্শকদের জন্য একটি উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা হিসেবে দেখছেন। তিনি বলেন, ‘‌এ ধরনের আয়োজনের ফলে নিজ নিজ অবস্থানে থাকা অনুকূল-প্রতিকূল সব পরিস্থিতির মানুষই জীবনের অর্থ উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে।’

মা ও সন্তান সর্বদাই একটি অবিচ্ছেদ অংশ বা সংযোগ। কিন্তু এখানে শিল্পী সালমা জাকিয়া বৃষ্টি ও তার ছেলের গল্পটি আলাদা। ছেলে মাশরাফি আভিনের বয়স বর্তমানে ১৭ বছর। সে একজন অটিস্টিক শিশু এবং আমরা জানি অটিজমে আক্রান্ত শিশুরা খুব বেশি হাইপার হয়ে যায়। হাইপার হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি আভিন অনেক বেশি অমনোযোগী ছিল। মা সালমা জাকিয়া জানিয়েছেন, আভিনের একদম ছোটবেলায় রঙতুলি বা আঁকাআঁকির তেমন কোনো ইচ্ছেই ছিল না। আভিন পেন্সিল ধরতেও পছন্দ করত না। নিজে শিল্পী বলে সন্তানকেও ছবি আঁকতে হবে এমন কোনো চিন্তা কখনো পোষণ করেননি তিনি। তবে তিনি চেয়েছিলেন আভিন সুস্থ থাকার জন্য তার ভালো লাগে এমন কোনো কাজ করুক। তিনি সন্তানের মানসিক প্রশান্তি ও বিকাশের লক্ষ্যে দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে চেষ্টা করেছেন। তরল যেকোনো কিছু হাতে মাখাতে আভিন পছন্দ করত। সে জায়গা থেকেই মা জাকিয়া তাকে তরল রঙ দিয়েছেন। তারপর তিনি লক্ষ করলেন কিছু নির্দিষ্ট রঙ দেখলে তার সন্তান অনেক বেশি হাইপার হয়ে যাচ্ছে। কালো ও নীল রঙ দুটি নিয়েই বেশি হাইপার হয়ে যেত আভিন। শিল্পী সালমা জাকিয়া বলেন, ‘‌আমি ভেবেছি ও এ রঙগুলোয় ভয় পাচ্ছে। তাই সেগুলো দেয়া বন্ধ করে দিয়েছি। কিন্তু হঠাৎ লক্ষ করে দেখলাম আভিন পোশাকের ক্ষেত্রে এ রঙগুলো বেশ পছন্দই করছে। তখনই আমি বুঝতে পারি হাইপার হয়ে যাওয়ার পেছনে কারণ হলো আভিন কালো ও নীল রঙ বেশি পছন্দ করে। কিছুদিন বন্ধ রেখে অন্য রঙের সঙ্গে আমি ধীরে ধীরে এ দুটি রঙ আভিনকে দিতে শুরু করলাম।’

আভিনের মতো হাজারো অটিস্টিক শিশুকে নিয়ে তাদের মায়েরা প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে যাচ্ছে। কীভাবে সন্তানকে একটু ভালো রাখা যায় সে ভাবনায় কঠিন দিন পার করছেন। তবে সেই জায়গা থেকে সন্তানের পছন্দের বা আনন্দের বিষয় খুঁজে পেয়েছেন শিল্পী সালমা জাকিয়া। আভিন অটিজমে আক্রান্ত এটি জানতে পেরেছেন যখন তার বয়স ১৮ মাস। তারপর ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠা এবং রঙ-ক্যানভাস নিয়ে তার কৌতূহলের শুরু। সালমা জাকিয়া বলেন, ‘‌আমি যে ছবিগুলো ক্যানভাসে আঁকি সেগুলো আভিন অনুকরণের চেষ্টা করে এবং ক্যানভাসে আঁকতে থাকে। এভাবেই ১৫ বছর ধরে চলছে। এ রকম অনেক ছবি নিয়ে এবার কলা কেন্দ্রে আমাদের আয়োজন দ্বৈবিধ্য।’ এ আয়োজন নিয়ে কিউরেটর আবু কালাম শামসুদ্দিন বলেন, পুরো ব্যাপারটি আমাদের সমাজে ভিন্নমাত্রা যোগ করবে বলেই মনে হয়েছে। আভিনকে বুঝে এবং তার ভালোলাগার জায়গা খুঁজতে দীর্ঘ ১৫ বছর শিল্পী সালমা চেষ্টা চালিয়ে গেছেন এবং তিনি বিশ্বাস করেন এত লম্বা একটি সময় দেয়ার কারণেই হয়তো আজকে আভিন মা যেভাবে ক্যানভাসে স্ট্রোক দিচ্ছেন সেভাবে দেয়ার চেষ্টা করছে।

শিল্পী সালমা জাকিয়া মনে করেন, অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের ডেভেলপমেন্টের জন্য যদি তাদের চিন্তা বা ভালোলাগার জায়গাটা বুঝে মা-বাবারা উৎসাহ জোগান তাহলে অটিস্টিক সন্তানরাও ভালো করতে পারবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন