সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি

দেশী-বিদেশী সংস্থার প্রতিবেদন আমলে নেয়া হোক

মানুষ মরণশীল। তবে অস্বাভাবিক মৃত্যু আমাদের কাম্য নয়। বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। এ দুর্ঘটনায় অনেক পরিবার তাদের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারায়। অনেকেই পঙ্গুত্ব বরণ করেন। এতে স্থায়ীভাবে দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তির পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারীর প্রাণহানিতে অনেক পরিবারে দুর্দশা নেমে আসে। পঙ্গুত্বের কারণে পরিবারের বোঝা হয়ে জীবন যাপন করেন দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি। এসব পরিবারের স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হয়ে পড়ে, যা একেবারেই অপ্রত্যাশিত। কিন্তু চালকের অদক্ষতা ও সড়কে বিশৃঙ্খলার কারণে প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। দিনের পর দিন প্রাণহানির সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও এক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। নিরাপদ সড়ক সবার কাম্য। এজন্য নিরাপদ সড়ক গঠনে জনসচেতনতা তৈরিতে কার্যকর ও সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। 

বণিক বার্তায় প্রকাশ, বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৫ হাজার ৪৯৫টি। এসব দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৫ হাজার ২৪ জন। বাংলাদেশ পুলিশের তথ্যমতে, দুর্ঘটনার সংখ্যা ৫ হাজার ৯৩। মারা গেছে ৪ হাজার ৪৭৫ জন। যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্যানুযায়ী, দুর্ঘটনার সংখ্যা ৬ হাজার ২৬১ এবং মৃত্যুর সংখ্যা ৭ হাজার ৯০২। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য বলছে, দুর্ঘটনার সংখ্যা ৬ হাজার ৯১১ এবং মৃত্যুর সংখ্যা ৬ হাজার ৫২৪। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী, ২০২১ সালে নিহতের সংখ্যা ছিল ৩১ হাজার ৫৭৮। 

আমরা অতীতে দেখেছি, নিরাপদ সড়কের দাবিতে বিভিন্ন সময়ে বড় বড় আন্দোলন হয়েছে। পাঁচ বছর আগেও নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করেছেন। তখন শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ফলে নতুন আইন করা হলেও কার্যত কোনো পরিবর্তন লক্ষ করা যায়নি। বিশেষজ্ঞদের ভাষ্যমতে, সড়ক পরিবহন আইনের প্রয়োগ কাগজ-কলমে সীমাবদ্ধ থাকলে দুর্ঘটনা হ্রাস পাবে না। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এবং বিআরটিএ মালিকদের প্রভাব বলয়ে চলছে। তারা একপেশে ও একচেটিয়া সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। আইন প্রয়োগে প্রভাবশালীদের ছাড় দেয়া হচ্ছে। দেখা যায়, প্রভাবশালী ও সবলদের ওপর পুলিশ আইন প্রয়োগ থেকে বিরত থাকে। কিন্তু দুর্বলের ওপর ঠিকই আইন প্রয়োগ করা হয়। এছাড়া সড়কে চাঁদাবাজি, ছোট যানবাহনের আধিক্যের কারণে সড়ক পরিবহন নেটওয়ার্ক বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ছে। উন্নত দেশগুলোয় গণপরিবহনকে প্রাধান্য দেয়া হয়, কিন্তু আমাদের দেশে ব্যক্তিগত গাড়িসহ ছোট যানবাহন প্রাধান্য পায়।

চালকের অদক্ষতা ও বেপরোয়া যানবাহন চালানোর পাশাপাশি ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, সড়ক ও সেতুর নাজুক অবস্থাও সড়ক দুর্ঘটনার জন্য বহুলাংশে দায়ী বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। গণপরিবহনে বাড়তি যাত্রী সামাল দিতে গতিসীমার বাইরে দ্রুত গাড়ি চালিয়ে বেশি ট্রিপ দেয়ার অশুভ প্রতিযোগিতা আর বাড়তি মুনাফার লোভে পরিবহন সংস্থাগুলো চালকদের অনেক বেশি সময় কাজ করতে বাধ্য করে। ফলে চালকের ওপর এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপ পড়ে, তাকে বেসামাল হয়ে গাড়ি চালাতে হয়; যা প্রকারান্তরে দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিভিন্ন উৎসবের সময় দীর্ঘদিনের পুরনো যানবাহনে রঙ লাগিয়ে কোনোমতে মেরামত করে রাস্তায় চলাচল করে গণপরিবহন। এ সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অতিরিক্ত যাত্রী দূরদূরান্তে গমন করে। সড়ক-মহাসড়কে অনেক সময় বাস-ট্রাকের মাদকাসক্ত চালকের গতির লড়াইয়ে দুর্ঘটনা ঘটে। কেউ-বা আবার গাড়ি চালানোর সময় সেলফোন ব্যবহার করেন, যা সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়। পণ্যবাহী যানবাহনে যাত্রী বহন, অদক্ষ চালক ও হেলপার দিয়ে যানবাহন চালানো, বিরামহীন যানবাহন চালানো, মহাসড়কে অটোরিকশা, নসিমন-করিমন ও মোটরসাইকেলের অবাধ চলাচল এবং ব্যস্ত সড়কে ওভারটেকিং, ওভারলোডিং তদারক না করা সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকি অনেকাংশে বাড়িয়ে দেয়। ত্রুটিপূর্ণ মহাসড়কের কারণেও দুর্ঘটনা ঘটছে। সড়ক দুর্ঘটনায় বিপুলসংখ্যক মানুষের মৃত্যুর কারণে প্রধানমন্ত্রী সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে পাঁচ দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সেগুলো ছিল চালক ও সহকারীদের প্রশিক্ষণ প্রদান, দূরপাল্লার বাসযাত্রায় বিকল্প চালক রাখা ও ৫ ঘণ্টা পরপর চালক পরিবর্তন করা, চালক ও যাত্রীদের সিটবেল্ট বাঁধা বাধ্যতামূলক করা, চালকদের জন্য মহাসড়কে বিশ্রামাগার নির্মাণ এবং সিগন্যাল মেনে যানবাহন চালানোর ওপর কড়াকড়ি আরোপ, যা তেমন বাস্তবায়ন হতে দেখা যায়নি। 

বিশ্বের প্রথম সারির উন্নত পরিবহন ব্যবস্থার কথা বলতে গেলে সিঙ্গাপুরের নামটি সামনে চলে আসে। সিঙ্গাপুরে পরিবহন ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে ল্যান্ড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি গঠন হয় ১৯৯৫ সালে। এক দশকের ব্যবধানে সংস্থাটি দেশটির পরিবহন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনে। গ্রাহক সন্তুষ্টির দিক থেকে সিঙ্গাপুরের পরিবহন ব্যবস্থা বিশ্বে প্রথম সারিতে। এশিয়ার মধ্যে চীন, জাপান, দুবাই, ইউরোপের সুইডেন, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি প্রভৃতি দেশের পরিবহন ব্যবস্থা বিশ্বে আদর্শ। প্রতিটি দেশই নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। দেশগুলোয় সংশ্লিষ্ট আইনটি অত্যন্ত শক্তিশালী। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, আইন বাস্তবায়নে তাদের প্রশাসন খুবই কঠোর, কোনো ছাড় দেয়া হয় না।

সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে—সড়কে দুই ও তিন চাকার গাড়ির সংখ্যা বাড়তে থাকা, বেপরোয়া গতি, বিপজ্জনক ওভারটেকিং, রাস্তা নির্মাণে ত্রুটি, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের অবাধে চলাচল, যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতা, চালকের অদক্ষতা ও বেপরোয়া মনোভাব, চলন্ত অবস্থায় মোবাইল বা হেডফোন ব্যবহার এবং মাদক সেবন করে যানবাহন চালানো। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে যে ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে; ১. সড়ক নিরাপত্তায় বাজেটে বরাদ্দ বাড়িয়ে মন্ত্রণালয়ে আলাদা সড়ক নিরাপত্তা ইউনিট গঠন করা যেতে পারে। ২. দেশের সড়ক-মহাসড়কে প্রয়োজনীয় রোড সাইন (ট্রাফিক চিহ্ন) স্থাপন ও জেব্রা ক্রসিং অঙ্কন। ৩. গাড়িচালকদের দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণের পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা আবশ্যক। ৪. পরিবহন খাতে বিদ্যমান অনিয়ম-দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি বন্ধ করা জরুরি। ৫. গাড়ির ফিটনেস ও চালকদের লাইসেন্স প্রদানের পদ্ধতি উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিকায়ন করা। ৬. সড়ক দুর্ঘটনায় আর্থিক সহায়তা তহবিল গঠনপূর্বক হতাহতদের দ্রুত উন্নত চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। ৭. দেশব্যাপী চাহিদানুযায়ী পর্যাপ্ত মানসম্মত নতুন গণপরিবহন নামানোর উদ্যোগ নেয়া। ৮. ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তা ও সদস্যদের প্রশিক্ষণের জন্য ট্রেনিং একাডেমি গড়ে তোলা। সড়কে মৃত্যুর যে মিছিল চলছে প্রতিদিন তা নিয়ন্ত্রণে অবিলম্বে পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। সড়ক দুর্ঘটনা পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে আসে। সুপ্রশিক্ষিত চালক, সড়কে সুব্যবস্থাপনা এবং নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যথাযথ নীতি প্রণয়ন ও কার্যকর পদক্ষেপ ছাড়া এ-জাতীয় ক্ষয় এড়ানো সম্ভব নয়। জাতিগত শক্তির নিদারুণ অপচয় রোধে সরকার যথাযথ পদক্ষেপ নেবে এ কামনা করছি। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন