যোগসূত্রের ফলাফল

ওয়াহিদ সুজন

যোগাযোগের নানা পরিপ্রেক্ষিত থাকে। পরিসর থাকে। যাকে যোগসূত্র বলা যায়। প্রশ্ন হলো কোন শর্তে যোগাযোগ ঘটছে। যে মানুষগুলো বিদেশের মাটিতে একজোট হন, তাদের এক মাত্রা; দেশের মাটিতে তা বেশ ভিন্ন। ইত্যাকার অনুমান নিয়ে আমরা যখন হাজির হই ‘যোগসূত্র’ প্রদর্শনীতে, তখন মূলত একাধিক সম্ভাবনা ও আবিষ্কার দেখা ছাড়া উপায় থাকে না। দুনিয়া তো এমনই। এ যোগাযোগের অন্তরালে রয়েছে শিল্পসূত্র। মানুষে মানুষে শৈল্পিক যোগাযোগ আবহমানকালের; আর এ প্রদর্শনী মহাকালের পরিসরে ঝলকানির মতোই ঘটনা। আশ্চর্য কী!

লালমাটিয়ার কলা কেন্দ্রে সদ্য সমাপ্ত প্রদর্শনী ‘যোগসূত্র’। ২০১৮-২৩ সালের মাঝে ইন্ডিয়ার বাংলাভাষী রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন এমন ১৫ দৃশ্যশিল্পীর কাজ স্থান পেয়েছে এ আয়োজনে।

সাধারণত যা নেয়া হয়, বাংলাদেশী পরিচয়ের সঙ্গে ভারতীয় পরিচয়ের একটি যোগাযোগ ঘটেছে। ভাষার ক্ষেত্রে বাঙালিত্বের সাধারণ ঐতিহ্যের মিথস্ক্রিয়া তো আছে। না, ঠিক বাঙালিত্বও বলা যাচ্ছে না। ভিন্ন নৃসত্তার উপস্থিতি আছে এ পরিচয়ে। চাইলেও জাতি পরিচয়কে আমরা ছাড়িয়ে যেতে পারি না। সে প্রমাণ রয়েছে প্রদর্শনীতে। 

অমিতাভ সরকার, আনিকা তাসনিম অনুপ, মাক্রাইওয়ং, ফারিয়া খানম তুলি, জয়তু চাকমা, মাধবী রানী নাথ, মো. ইমতিয়াজ ইসলাম, মো. সাজিদুল হক, মোহাম্মদ রবিন, মৃণাল বণিক, নাদিয়া হাসিবা, নূপুর পোদ্দার, সুদীপ চাকমা, সুমন বিশ্বাস ও সুমন সূত্রধরের শিল্পকর্ম মিলেছে ‘যোগসূত্র’-তে। তারা এখন বাংলাদেশের নানা অঞ্চলে স্বাধীন বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাজ করছেন। আর ‘যোগসূত্র’ তাদের একই ছাদের নিচে মিলিয়েছে। তাদের ভাবগত বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐকতান খুঁজে পাওয়াই হয়ে ওঠে দর্শকের লক্ষ্য। এমন কিছু পেতে হবে এমনও তো নয়।

‘যোগসূত্র’ শিরোনামটি আইডেন্টিটি বা কিউরেটিংয়ের ভারিক্কি বোঝাপড়ার বাইরে হাজির হয়েছে। তবে কতক্ষণ আমরা আইডেন্টিটি আবিষ্কার ছাড়া থাকতে পারি। যেহেতু স্রেফ মানুষ বলে কিছুই নেই জগৎ-সংসারে। এমনও একটা ব্যাপার ঘটে যে শিল্প আকারে বাংলাদেশ থেকে ভারতযাত্রায় দুই দেশের কাজের মধ্যে কী তফাত বা যোগ-বিয়োগ ঘটে (এভাবে কি বলা যায়!) তার একটি উপস্থাপন আশা করা যায়। ধারণাগতভাবে তো থাকেই, তবে প্রমাণ দেয়া সহজ নয়।

প্রদর্শনীর অন্যতম শিল্পী ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক মো. সাজিদুল হক এ-সংক্রান্ত প্রকাশনায় বলছিলেন, ‘সামগ্রিকভাবে এ শিল্পীদের শিল্পকর্মকে আমরা তিনটি ভিন্ন সময়ে ভাগ করে ফেলতে পারি। বাংলাদেশের একাডেমিক শিক্ষার সময়, ভারতে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়নরত সময় এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পরের সময়। তিন সময়ের তিনটি রূপান্তরের অধ্যায় শিল্পকর্মগুলোয় সুস্পষ্ট।’

অবশ্য এ ধরনের তুলনাযোগ্য আঁকাআঁকি কম। আবার এমন নয়, শিল্পীরা যা এঁকেছেন তাও বারবার করে দেখানো সম্ভব। শিল্প তো অনুকৃতি নয়, একটা বাস্তবতা। সময় তার প্রবহমানতার অভিজ্ঞতা দেয়া থেকে আমাদের রেহাই দেবে বলে ভাবা কল্পনায়ও অকল্পনীয়। কিন্তু লক্ষণীয় যে বেশ কয়েকজন শিল্পী তাদের আনা ছবিতে একটা ক্রম রক্ষা করেছেন। একই টাইটেল ও আঙ্গিকের অন্তর্ভুক্ত সিরিজে সময়ের কিছুটা উল্লম্ফন ঘটেছে।

সাজিদের পাইনউডের কাজগুলোর কথাই বলা যাক। সাধারণ শিরোনাম ‘মেমোরাবিলিটি’। যার শুরুরটি ‘ময়নামতি’ ২০১৮ সালে, শেষটি পরের বছরে ‘বুদ্ধা, অজন্তা’। প্রথমটির জটিলতার তুলনায় শেষ ছবিটি সরল ও ধ্যানী অবয়ব সামনে নিয়ে আসে। শিক্ষা, সময় ও শৈলীর সম্পর্ক কীভাবে বিচার হবে তা নিশ্চয় তুমুল তর্ক তৈরি করতে পারে। 

মো. ইমতিয়াজ ইসলামের আলাদা তিনটি গুচ্ছ কাজের শিরোনাম ‘ন্যারেশন অব আ জার্নি’। দুটি কাজ ২০১৯ সালের ও একটি ২০২৩ সালের। অসংখ্য মানুষের ফটোগ্রাফ ব্যবহার করে নিরন্তর চলাচলের চিত্র তুলে ধরেছেন। ইমতিয়াজ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা, ভারতযাত্রা ও সেখান থেকে ফিরে এসে দেশে কাজ করছেন—সেই জার্নিও ভাবা যায়। মাধ্যম হিসেবে অদল-বদলও দেখি। ব্যবহার করেছেন ওয়াটার কালার, উডকাট, অ্যাক্রিলিক ও সাইনোটাইপ। কিন্তু একে স্রেফ ব্যক্তিগত ভ্রমণ আকারে দেখা কঠিন। একগাদা মুখ তুলে ধরার মধ্যে অজস্র ব্যবধান ও সাধারণ অর্থে বৈচিত্র্যের মাঝে মানুষের নিঃসঙ্গ চরিত্রটি সম্ভবত খুবই স্পষ্ট। মানচিত্রের বিভাজন তো নয়, সংস্কৃতি-ঐতিহ্য বিদ্যমান স্বাতন্ত্র্য রূপটি তুলে ধরে। যান্ত্রিক সভ্যতার নিজের প্রয়োজনে মানুষকে নির্দিষ্ট ছাঁচে ফেলে দেখার প্রবণতা রয়েছে। সেখানেই শিল্পই পারে মানুষকে বাঁচাতে। স্টোরি অব ন্যারেশন সে কাজটুকু করে।

বিচ্ছিন্নতা প্রদর্শনীর একাধিক ছবিতে উঠে এসেছে অবলীলায়। বিচ্ছিন্নতা, নিঃসঙ্গতা দিয়েছে মেটাফোরের এক জগৎ। ভয়েরও। মাক্রাইওয়ংয়ের ‘আনসার্টেইনিটি’ বা অনিশ্চয়তার দৃশ্য বা ভঙ্গুরতা ও আনিকা তাসনিম অনুপের ‘অ্যানোইমোস ফাঙ্ক’ যে বিবর্ণতা তুলে ধরে; তার কথাই বলছি। আবার রাজনৈতিক পরিসরে জাতিসত্তার বিলোপ বা সংঘাতকে জুতসইভাবে এ প্লাটফর্মে তুলে ধরেছেন জয়তু চাকমা ও সুদীপ চাকমা। বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল ঘিরে যে রক্তক্ষয়ী লড়াই চলে আসছে কয়েক দশক ধরে, তা স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে বহুমাত্রিক রূপ লাভ করেছে। জয়তু ‘স্টোরি অব গ্রে হিলস’ ও সুদীপ ‘নট কনফ্লিক্ট, পিস’ সিরিজে সেই রক্তাক্ত দিকটি তুলে ধরেছেন। একদম সোজাসুজি। অর্থাৎ ব্যক্তি মানুষ ও গোষ্ঠীগত লড়াইয়ের দিকটি এ শৈল্পিক প্রদর্শনীতে একদম দুটি ভিন্ন ধারা তৈরি করেছে। বিচ্ছিন্নতা ও সংবদ্ধতা মানুষকে তার পরিপার্শ্বের সংকটসহ তুলে আনছে। 

আমরা যখন যোগসূত্র বিষয়ে শিল্পী অমিতাভ সরকারের সঙ্গে আলাপ করছিলাম, তিনি জানান, বাংলাদেশ ও ভারতে দুই দেশের চারুকলায় শিক্ষায় উল্লেখযোগ্য পার্থক্য আছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের কারিকুলামে ফিগারেটিভ আর্টের যে প্রচলন ভারতে তার থেকে ভিন্ন কিছু করার সুযোগ রয়েছে। 

অমিতাভ সরকারের চারটি চিত্রকর্ম নিয়ে সিরিজের শিরোনাম ‘ইনডেক্স’। ২০২৩ সালে অ্যাক্রিলিকে আঁকা এ ছবিগুলো একগুচ্ছ আকার তুলে ধরেছে। এখানে কার কী প্রভাব বা শিক্ষা আছে তা স্পষ্ট নয়। তবে বিমূর্তের অস্থানিক এ রূপ মুগ্ধ করে। 

কিউরেটর ও কলা কেন্দ্রের অন্যতম কর্তা শিল্পী ওয়াকিলুর রহমানের কথায়ও যোগাযোগ নিয়ে একটি বার্তা পাওয়া গেল। তিনি বলছেন, ‘প্রদর্শিত শিল্পকর্ম শিল্পীদের সিদ্ধান্তে হয়েছে। আমাদের উৎসাহ, এসব নবীন শিল্পীকে পরিচয় করিয়ে দেয়া। সঙ্গে সঙ্গে তাদের চিন্তা-চেতনা, কর্মকে বোঝার চেষ্টা করা। এ উপস্থাপনা বাংলাদেশ-ভারতের শিল্পশিক্ষা পদ্ধতি ও একাডেমি উত্তর সময়, দ্বন্দ্বগুলো কিছুটা উন্মুক্ত হবে আশা করি।’

এ ধারণা দর্শকের মনেও হয়তো থাকে। ‘যোগসূত্র’ মূলত শিল্পীর যাপনের প্রতিফলন। শৈল্পিক যাত্রায় শরীরের একটা ভূমিকা তো থাকে। সেখানে সিদ্ধি-অসিদ্ধির পরিক্রমা থাকে। শিল্পীর রঙ-তুলি-চেনি বা আরো যা আছে তা নিয়ে কথা বলবেন; তাই তো! সেখানে যোগাযোগ একটি নিরন্তন প্রক্রিয়া। নইলে শিল্পী কীভাবে বাঁচেন! সেই যোগাযোগের আপতিক এ ফলাফল আমাদের মুগ্ধ করে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন