সাক্ষাৎকার

প্রতীকের মাধ্যমে মূর্ত হয়েছে জাতিগত পরিচয়

সুলাইমান মনসুর। ছবি: মিডল ইস্ট আই

ফিলিস্তিনের চিত্রশিল্পী, ভাস্কর, লেখক ও কার্টুনিস্ট সুলাইমান মনসুর। চিত্রশিল্প নিয়ে পড়িয়েছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৪৭ সালে তার জন্ম। নিজের বেড়ে ওঠা, চিত্রকর্ম, ইসরায়েলি দখলদারত্ব ও ফিলিস্তিনি শিল্পীদের কাজ নিয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে।  অন্তর্জালে ইংরেজি ভাষায় সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নিজাম আশ শামস। নভেরার পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি বাংলায় ভাষান্তর করা হয়েছে।

আপনার জন্ম বেড়ে ওঠা সম্পর্কে জানতে চাই।

১৯৪৭ সালে বিরজেইত গ্রামে আমার জন্ম। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ফিলিস্তিনের বিভিন্ন অঞ্চল আক্রমণ করেছিল। ইতিহাসে এটিনাকবা নামে পরিচিত। তবে আমাদের পরিবারে নাকবার প্রভাব পড়েনি। গ্রামও ছাড়তে হয়নি। বিরজেইত ছিল খুব সুন্দর একটি গ্রাম। চারপাশে প্রচুর জলপাই গাছ। আমাদের পূর্বপুরুষরা অন্যান্য ফলের গাছও লাগিয়েছিলেন। অনেক প্রাকৃতিক ঝরনা ছিল। আর ছিল প্রাচীন জলাশয়। শিশুরা সেসব জলাশয়ে সাঁতার শিখত। এসবের মধ্যেই আমরা গ্রীষ্মকাল কাটাতাম। আমাদের জন্য এটি ছিল স্বর্গের মতো। আমার চার বছর বয়সে বাবা মারা যান। মা আমাদের বেথেলহেমের একটি বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলেন। সেখানেই শৈশব-কৈশোরের অধিকাংশ সময় কেটেছিল।

আঁকাআঁকির শুরুটা কীভাবে হলো? অনুপ্রেরণা কীভাবে পেয়েছিলেন?

আমাদের স্কুলটি জার্মানদের অনুদানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তাই কয়েকজন জার্মান শিক্ষক ছিলেন। তাদের একজন ছিলেন চিত্রশিল্পী। তিনি পেইন্টিংয়ের প্রতি আমার ভালোবাসা বুঝতে পেরেছিলেন। আমাকে ছবি আঁকার প্রয়োজনীয় উপকরণও দিয়েছিলেন। আঁকাআঁকির প্রতি উৎসাহিত করেছিলেন। তার উৎসাহে আমি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলাম। জাতিসংঘ একবার সারা বিশ্বের শিশুদের নিয়ে একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল। সে প্রতিযোগিতায় আমি ২০০ ডলার পুরস্কার পাই। তখন ১৯৬২ সাল। সে সময়ের হিসাবে অনেক টাকা। তাই বন্ধু, শিক্ষক গ্রামবাসীদের মাঝে আমি বেশ বিখ্যাত হয়ে গেলাম। সবাই আমাকে চিত্রশিল্পী হিসেবে সমীহ করতে লাগলেন৷ আমার মধ্যেও এর প্রতিফলন ঘটল। আমিও নিজেকে চিত্রশিল্পী হিসেবে দেখতে শুরু করলাম।

১৯৬৭ সালের যুদ্ধ আপনার জীবনকে কীভাবে প্রভাবিত করেছিল?

স্কুলের পাঠ চুকানোর সঙ্গে সঙ্গে চিত্রশিল্প নিয়ে পড়াশোনার কথা ভাবলাম। যুক্তরাষ্ট্রের একটি আর্ট স্কুলে ভর্তির আবেদন করেছিলাম। আবেদন মঞ্জুরও হয়েছিল। যাতায়াতের খরচ জোগাড়ের জন্য কিছুদিন কাজ করার কথা ভেবেছিলাম। এরই মধ্যে ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু হলো। তাই দেশে আটকে গিয়েছিলাম। বাইরে আর যেতে পারলাম না।

তারপর আপনি কী করলেন?

তখন পশ্চিম জেরুজালেমের একটি আর্ট স্কুল সম্পর্কে জানতে পারি। সেখানে ভর্তি হলাম। প্রথম বছর সবকিছু চমৎকার ছিল। কিন্তু তারপর থেকে অপ্রত্যাশিত সব ঘটনা ঘটতে লাগল। সেখানে স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। একটি উদাহরণ দিচ্ছি। একবার লাইব্রেরিতে আগুন ধরেছিল। আমাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাওয়া হলো। আমার প্রতি সবার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গিয়েছিল। আমিও তা বুঝতে পেরেছিলাম। পরে কর্তৃপক্ষ আবিষ্কার করল যে বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে আগুন লেগেছিল। আমি আর প্রতিষ্ঠানটি পছন্দ করতাম না। কারণ তখন সেখানেঅ্যাবস্ট্র্যাক্ট এক্সপ্রেশনিজম শিল্পরীতির চর্চা করা হতো। ধারাটিকে আমি অপছন্দ করতাম। ১৯৬৭-৭০ পর্যন্ত সেখানে ছিলাম। তারপর স্কুলটি ত্যাগ করে চিত্রশিল্প নিয়ে পড়ানো শুরু করি।

ফিলিস্তিনের ওপর ইসরায়েলের ঘটনায় চিত্রশিল্পী হিসেবে আপনার ভূমিকা কেমন ছিল?

বন্ধুদের নিয়ে ফিলিস্তিনি চিত্রশিল্পীদের একটি ইউনিয়ন তৈরি করেছিলাম। ১৯৬৭ সালে আমি আমার সমবয়সী অনেকেই নিজেদের জর্ডানি ভাবতাম। কারণ আমরা হাশেমী সাম্রাজ্যের শাসনাধীনে বেড়ে উঠেছি। আমরা আসলে একই ছিলাম। আমাদের সবকিছুতে সাদৃশ্য ছিল। ১৯৬৭ সালের পর আমরা বুঝতে শুরু করি যে আমরা ফিলিস্তিনি।৷ একটি ঐতিহাসিক সমস্যা জোর করে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে আমাদের ওপর। বোঝানো হয়েছিল যে ঈশ্বর আমাদের ভূখণ্ডটি পোল্যান্ড ইউরোপের ইহুদিদের জন্য বরাদ্দ করেছেন। আমরা ভাবতে লাগলাম, যুক্তিটি একেবারেই মেনে নেয়ার মতো নয়। ইউরোপ থেকে আসা ইহুদিরা ফিলিস্তিনিদের অস্তিত্ব অস্বীকার করতে লাগল। এটিই ছিল মূল সমস্যা। তাদের পক্ষে এটি ভাবা অধিকতর সহজ ছিল যে তারা যেন একটি জনমানবহীন ভূখণ্ডে এসেছে এবং সেটিকে আবাদ করেছে। অথচ এটি একটি ডাহা মিথ্যা। তাই চিত্রশিল্পী হিসেবে আমাদের মূল চিন্তা ছিল ফিলিস্তিনের বিভিন্ন প্রতীক তৈরির মাধ্যমে ফিলিস্তিনি পরিচয় প্রচার করা।

চিত্রকর্মে কী ধরনের প্রতীক উপস্থাপিত হয়েছে?

পরিচয় একটি বিমূর্ত ধারণা। তাই চিত্রকর্মে বিভিন্ন প্রতীকের মাধ্যমে জাতিগত পরিচয়কে মূর্ত রূপ দেয়া হয়েছে। কয়েকটি মৌলিক উৎস থেকে প্রতীকগুলো নেয়া হয়েছে। . ক্যানানাইট, মিসর মেসোপটেমিয়ার মতো প্রাচীন সংস্কৃতি, . ইসলামী চিত্রকলা, মূলত ক্যালিগ্রাফি, . লোকশিল্প, লোক পোশাক, এমব্রয়ডারি অন্যান্য বিষয় থেকে প্রতীকগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে। ফিলিস্তিনের ল্যান্ডস্কেপও প্রতীক হিসেবে উঠে এসেছে। এর মধ্যে আছে গ্রামগুলোর স্থাপত্যশিল্প, কিছু গুরুত্বপূর্ণ গাছ। যেমন ১৯৪৮ সালে দখলকৃত ভূখণ্ডের প্রতীক হিসেবে কমলা গাছ আঁকা হয়েছে। আর ১৯৬৭ সালে দখল হওয়া ভূখন্ডের প্রতীক হিসেবে ক্যানভাসে ফুটে উঠেছে জলপাই গাছ। প্রকৃতির আরো অনেক উপাদান আমরা প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছি। যেমন অর্কিড, ক্যাকটাস, পাখি ইত্যাদি। সম্প্রতি ফিলিস্তিনের পতাকার প্রতীক হিসেবে আঁকা হচ্ছে তরমুজ।৷ ইসরায়েলের দখলদারত্বের কারণে অনেক বিষয় আমাদের চিত্রকর্মে প্রবেশ করেছে। যেমন কাঁটাতার, জেলখানার গারদ, দেয়াল, ফিলিস্তিনের ভৌগোলিক অবস্থানের বিভাজন ইত্যাদি।

ছবি আঁকতে গিয়ে এখন পর্যন্ত কী ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন?

১৯৭৫ সালে আমরা প্রদর্শনী শুরু করি। তখন বড় একটি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। প্রয়োজনীয় কোনো অবকাঠামো আমাদের ছিল না। প্রদর্শনীর জন্য কোনো গ্যালারি বা হল ছিল না। কিছু গ্রাম ক্যাম্পে বিদ্যুৎ পর্যন্ত ছিল না। তাই অধিকাংশ মানুষের কাছে পৌঁছনোর জন্য আমরা আমাদের চিত্রকর্ম, পোস্টকার্ড পোস্টারগুলো ছাপানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। এক বছরের মধ্যেই অধিকাংশ ঘরে চিত্রকর্মসংবলিত পোস্টার পৌঁছে গেল। এতে ফিলিস্তিনি চিত্রশিল্পের ব্যাপারে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী সচেতন হয়ে উঠল। তারা পোস্টারগুলো জব্দ করা শুরু করল। তারা আমাদের প্রদর্শনীগুলোয় এসে চিত্রকর্মগুলো জব্দ করতে লাগল। চিত্রশিল্পীদের স্টুডিও ঘরেও তারা গিয়ে চিত্রকর্মগুলো নিয়ে যেতে লাগল। এসব বিষয় সামরিক দখলদারত্বের বিরুদ্ধে শিল্পীদের সরাসরি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। এখানে একটি বিষয় বলা প্রয়োজন। ইসরায়েলি চিত্রশিল্পীদের কয়েকটি গ্রুপ ছিল। ফিলিস্তিনি চিত্রশিল্পীদের সমর্থন দিতে তারা রামাল্লা নাবলুসে এসেছিলেন।

আপনি অনেক সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সে বিষয়ে জানতে চাই।

আমি আমার অধিকাংশ শিল্পী বন্ধু নিজেদের রাজনৈতিক চিত্রশিল্পী মনে করি না। আমরা কেবল দখলদারত্বের নিষ্পেষণে থাকা আমাদের জীবনকে তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলি। ১৯৭৪ সালেলিগ অব প্যালেস্টাইনিয়ান আর্টিস্টস প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। তারপর খেয়াল করলাম যে ফিলিস্তিনি চিত্রশিল্পের জন্য আমাদের আরো অনেক কিছু করার আছে। ১৯৭৯ সালে আমরা একটি গ্যালারি চালু করেছিলাম। এর নাম দিয়েছিলামগ্যালারি ৭৯ তারপর হেবরন, গাজা রামাল্লায় আমরা লিগ অব প্যালেস্টাইনিয়ান আর্টিস্টসের কয়েকটি দপ্তর চালু করেছিলাম। ১৯৯৩ সালে আমরা জেরুজালেমে একটি কলাকেন্দ্র চালু করি। এর নাম রেখেছিলামআল ওয়াসিতি আর্ট সেন্টার রামাল্লায় আরেকটি গ্যালারি চালু করেছিলামআল হাল্লাজ নামে। তারপর নরওয়েজীয় সরকারের সহায়তায় একটি আর্ট একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। বর্তমানে এটি বিরজেইত বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন