চলতি অর্থবছরে আমাদের পাট রফতানির লক্ষ্যমাত্রা ১৪০ মিলিয়ন ডলার

আপনাদের পাট রফতানির পরিস্থিতি এখন কেমন?

আমাদের গত তিন বছরের হিস্ট্রি দেখেন। আমরা কভিড মহামারী পার করেছি। দেয়ার ওয়াজ আ হিউজ সার্জ ইন ডিমান্ড। কভিড-১৯-এর মধ্যে যেটি হয়েছে, মানুষ বাড়িঘর থেকে বের হয়নি। তারা আসলে হোম ইমপ্রুভমেন্টের জন্য বিপুল অর্থ খরচ করেছে। আপনি যদি জুটের এক্সপোর্ট ভলিউম সাড়ে ছয় লাখ টন দেখেন, এর প্রায় আড়াই লাখ টনই একটি প্রডাক্ট। আর তা হলো কার্পেট। এ আড়াই লাখ ডিমান্ডটা কভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে সিরিয়াস ডিমান্ড রেইজ করে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশে ওই সময় একটি সাইক্লোন হলো। সে কারণে আমাদের কাঁচামাল সরবরাহে ঘাটতি হলো। জুটের দাম অনেক বেড়ে গেল। তো একদিকে জুটের দাম বাড়ল, অন্যদিকে জুটের চাহিদাও বাড়ল। দুটো মিলিয়ে প্রাইস পয়েন্ট অনেক বেশি হয়ে গেল। সম্ভবত এটিই জুটের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি দাম। আমরা টিপিক্যালি যে সুতা ৯০০ থেকে হাজার ডলারে বিক্রি করতাম, তা বেড়ে ২ হাজার ৬০০ ডলারে চলে গেল। তার পরও উৎপাদন পর্যায়ে ঘাটতির কারণে টোটাল অ্যাবসলিউট নাম্বারে খুব একটা গ্রো করেনি। যেমন ১২০ কোটি ডলার লেভেলে চলে এল। এ মুহূর্তে যেটা হচ্ছে, তা হলো গ্লোবালি মারাত্মক ইনফ্লেশনের প্রেসারে ফেডারেল রিজার্ভের ইন্টারেস্ট রেট বাড়ার ফলে কনজিউমার কনফিডেন্স সারা বিশ্বেই কম। ওই সময় পাটের দাম বাড়াতে কৃষকরা চাষে একটু মনোযোগী হলো। তাই জুটের সরবরাহ বেড়ে গেল। অন্যদিকে, আবার ডিমান্ড কমে গেল। যেটি টিপিক্যালি হাজার ডলারে বিক্রি হতো, তার দাম এখন ৮০০ ডলার বা তারও কম। এসব কারণে আমরা চলতি বছরটি সম্ভবত ডিক্লাইনের মাধ্যমে শেষ করতে যাচ্ছি। কিন্তু যদি ম্যাক্রো পারসপেক্টিভে দেখা হয়, র জুটসহ প্রায় আট লাখ টন জুট রফতানি হচ্ছে। এতে খুব একটা পরিবর্তন আমি দেখছি না। তাই কেবল ডিমান্ড-সাপ্লাইয়ের যে দাম বাড়বে বা কমবে, সেক্ষেত্রে এক্সপোর্টের ভ্যালু হয়তো বাড়বে কিংবা কমবে। র জুট ছাড়া বাকি সাড়ে ছয় লাখ টন জুট প্রডাক্ট ১০ বছর ধরে মোর অর লেস এই একই জায়গায় ঘোরাফেরা করছে। এর একটি মৌলিক কারণ আমরা খুব ভুলভাবে প্লাস্টিককে দোষারোপ করি, আসলে তা না। আসলে ব্যাপারটা হলো জুট তো একটি কমোডিটি। তাই এর উৎপাদন ব্যয় ও সরবরাহ দুটোই গুরুত্বপূর্ণ। একটি হলো সরবরাহ বাড়ানো এবং উৎপাদন ব্যয় কমানো যায়নি। খুব ট্র্যাডিশনাল ম্যানুফ্যাকচারিং প্রসেসে এটি করা হয়। সে কারণে উৎপাদন ব্যয় দিন দিন বেড়েই চলেছে। শ্রম মূল্য বাড়ার সঙ্গে, এনার্জি কস্ট বাড়ার সঙ্গে এবং এগ্রিকালচারে ইনপুট বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে। এটিকে কমানোর জন্য প্রযুক্তিগতভাবে তেমন কিছুই বিনিয়োগ করা হয়নি। খুবই ইমোশনালি বিষয়গুলোকে অ্যাড্রেস করার চেষ্টা করা হয়েছে। বস্তুগতভাবে আমি তেমন কোনো পদক্ষেপ দেখি না। আরেকটি হলো তথাকথিত বৈচিত্র্য পণ্য। এ শব্দ ব্যবহারের জন্য আমি দুঃখিত।

আপনারা এখন কত এক্সপোর্ট করছেন?

এ বছর আমাদের টার্গেট ১ লাখ ১০ হাজার টন।

ভ্যালুটা কতো হবে?

আমাদের বিজনেস প্ল্যান অনুযায়ী ১৪ কোটি ডলার।

পাট রফতানির ক্ষেত্রে আপনার টিম কবে ১০০ কোটি ডলারের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করবে?

আমি মনে করি না যে আমরা সে অবস্থানে যেতে পারব। কারণ আপনি দেখেন যে আমরা প্রতি বছর প্রায় ২৫ শতাংশ হারে গ্রো করছি।

৫০ কোটি ডলারে যাওয়া কি সম্ভব?

সম্ভব না।

৫০ কোটিও পারবেন না আপনারা!

ব্যাপারটা হলো আমি যদি ৫০ কোটি পারিও, সমস্যা হলো আরেকজন কমবে। ইন্ডাস্ট্রি ইন জেনারেল বাড়ছে না।

আপনি কীভাবে আপনার ভলিউম ও স্কেল বাড়ানোর চিন্তা করছেন?

এক্ষেত্রে আমি যেটা চেষ্টা করছি, একটি হলো আমি আমার উৎপাদন ব্যয় কমানোর চেষ্টা করছি। এক্ষেত্রে আমরা কয়েকটি পদ্ধতি অনুসরণ করছি। একটি হলো এনার্জি কস্ট কমানোর চেষ্টা করছি। একই সঙ্গে মেশিনের বিভিন্ন ধরনের ইমপ্রুভমেন্ট করে মেশিনের কনজাম্পশন কমানোর চেষ্টা করছি। আমাদের টার্গেট হলো ওভারঅল প্রায় ৩০ শতাংশ এনার্জি কস্ট কমানো।

আপনার বর্তমানে জুট স্টাফ কয়জন?

সব মিলিয়ে ১০ হাজারের মতো। 

যদি বলা হয় আপনার নেতৃত্বে পাট রফতানির পরিমাণ ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০ কোটি ডলারে পৌঁছবে, সেটা কি সম্ভব?

প্রথম কথা হলো ২০২৫ সালের মধ্যে এটি সম্ভব হবে না। ২০৩০ সাল যদি আপনি বলেন, তাহলে একটি সম্ভাবনা আছে। বিষয়টি হলো আমার উৎপাদন ব্যয় যদি কমাতে না পারি, তাহলে আমার স্কেল বাড়ানোর সুযোগ থাকবে না। আরেকটি হলো বৈচিত্র্য পণ্যের যে সুযোগগুলো আছে, যেমন আমি যেমন গত বছর জার্মানিতে গেলাম আমাদের টেবিলওয়্যার মেলাতে অংশগ্রহণের জন্য, ওখানে দেখলাম কলকাতা থেকে বেশকিছু কোম্পানি এসেছে। ১ ডলারে তারা শপিং ব্যাগ বিক্রি করছে। সেখান থেকে আমি ভাবতে লাগলাম যে ১ ডলারে শপিং ব্যাগ কীভাবে বানানো যায়। কীভাবে বিক্রি করা যায়? আর এখানে সুযোগটা কোথায় আছে? এখানে যেটি হচ্ছে, ইমোশনালি প্রচুর কথা আপনি শুনবেন। কিন্তু আমি তার কোনো বাস্তব ভিত্তি দেখি না। আমাদের দেশে জুটের বার্ষিক উৎপাদন সাড়ে ১২ লাখ টন। এর মধ্যে চার লাখ টন ডোমেস্টিক কনজাম্পশনের জন্য। এ সাড়ে ১২ লাখ টন ক্রপকে আপনি খুব টেনে ১৫ লাখ টনে নিতে পারবেন। এর থেকে বড় করার সুযোগ নেই। এ বছর যেমন পাটচাষীরা দাম পাচ্ছেন না। এটি খুবই দুঃখজনক। চাষীদের এ বছর ভুট্টায় আগ্রহ বেড়ে যাবে।

এই যে জিনোম সিকোয়েন্সিং করা হলো, এতে কি লাভ হচ্ছে?

এ জিনোম দিয়ে আসলে কী করে, আমি আজ পর্যন্ত বুঝতে পারিনি। এটি কি মাথায় দেয়, নাকি খায়, আমি জানি না। 

বলা হয়েছিল যে, এতে প্রডাকশন অনেক বেড়ে যাবে, উন্নত বীজ আসবে...

দুঃখজনক ব্যাপার হলো আমরা মাত্র ৩০ শতাংশ বীজ এখনো নিজেরা উৎপাদন করতে পারি না। ৭০ শতাংশ বীজের জন্য আমরা ভারতের ওপর নির্ভরশীল। এটি খুবই দুঃখজনক। জিনোম ১০ বছর আগে আবিষ্কৃত হয়েছে। এটা দিয়ে আসলে কী হবে, তা এখনো পরিষ্কার না। এর প্র্যাকটিক্যাল ইমপ্যাক্ট কী? আপনি যদি দেখেন যে আমার জানা তথ্যানুযায়ী, পাট মানুষকে কীভাবে কনফিউজড করছে, ড. মোবারক যখন সোনালি পলিথিনের কথা বলছেন, এটি অনেক বড় একটি প্রহসন। এটি একটি অসত্য কথা। কারণ আপনি মনে করেন যে পলিমারাইজেশন অব ন্যাচারাল সেলুলোজ, এটি আজ থেকে ৭০ বছর আগে বাওয়ানি চট্টগ্রামের কর্ণফুলি রেয়ন মিলে করে দেখিয়েছে সেলোফিন বানিয়ে। প্রশ্ন হচ্ছে, এক কেজি পাটের দাম প্রায় ৯০ টাকা। ওই ৯০ টাকার পাটকে পলিমারাইজ করে সেলুলোজ বানিয়ে তার দাম পড়বে ৪০০-৫০০ টাকা। কে এটি কিনবে? কেন কিনবে? ইট ইজ অ্যান অ্যাবসলিউট ননসেন্স। আপনি দেখবেন বিভিন্ন ইউটিউব ভিডিওতে পাট দিয়ে টিন বানাচ্ছে, বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট বানাচ্ছে, এটা ওটা বানাচ্ছে এবং দেশের নীতিনির্ধারকরা উনার সঙ্গে বসে কথা বলছেন। আই জাস্ট ডোন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড হোয়াই! আপনি যদি পাশের দেশ ভারতকে দেখেন, তার পাট আছে, আবার তুলাও আছে। ও তুলাকে ইমোশনালি না নিয়ে ফাংকশনালি নিয়েছে আর তাই দে আর দ্য বিগেস্ট টেক্সটাইল কান্ট্রি ইন দ্য ওয়ার্ল্ড। তাহলে বাংলাদেশ কেন তার নিজস্ব রিসোর্সকে প্র্যাক্টিক্যাল ম্যাটেরিয়ালে রূপান্তর করতে পারছে না! এই যে জেপিডিসি বা অন্যরা যারা বৈচিত্র্য পণ্য বানাচ্ছেন, পাট দিয়ে স্যুট বানাচ্ছে, টাই বানাচ্ছে, ভাই প্লিজ, আপনারা কেন এগুলো করছেন? এগুলো বাস্তবসম্মত নয়। যে জিনিসটিকে আপনি স্কেল আপ করতে না পারবেন, যে বিষয়ের কমার্শিয়াল গেইন নেই, তা দিয়ে তো খুব একটা লাভ নেই। যদি আপনি ইতিহাস দেখেন, ডান্ডিতে যখন পাটের জন্ম হয়, ইউরোপে যখন ফ্ল্যাক্সের (লিনেন) দাম অনেক বেশি হয়ে গেল, তারা বাংলাদেশের ফরিদপুরের এ পণ্যকে ডান্ডি পর্যন্ত পৌঁছায়ে তারা এটিকে ফ্ল্যাক্সের সঙ্গে ইকোনমিক্যালি কমপ্যাটিবল করে নিল। তখন পৃথিবীতে বিভিন্ন যুদ্ধ-বিগ্রহের কারণে ওয়ার কমোডিটি আকারে এর একটি চাহিদা ছিল। তখন এটি ছিল একটি চিপার অল্টারনেটিভ। কিন্তু এখন এটি একটি এক্সপেনসিভ অল্টারনেটিভে পরিণত হয়েছে। আপনি সাড়ে আট লাখ টন পাট দিয়ে গ্লোবাল র‍্যাপিং মার্কেটে কতদূর যেতে পারেন? এর তো একটি নির্দিষ্ট পটেনশিয়াল আছে।

আপনারা যেমন তামাক করার জন্য বীজ দিয়ে তামাক করতেন, পাটের ক্ষেত্রেও কি তেমন কোনো পরিকল্পনা আছে?

আমরা এরই মধ্যে তা শুরু করে দিয়েছি।

আপনার ক্যাপাসিটি কি আদমজীকে ছাড়িয়ে গেছে?

আমার এ মুহূর্তে জানা নেই। তবে আমরা সেই লক্ষ্যেই এগিয়ে যাচ্ছি।

বর্তমানে পাট খাতের চ্যালেঞ্জগুলো সম্পর্কে বলুন?

সরকার পাটকে শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বর্তমান ট্যাক্স রুল অনুযায়ী পাট সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে একটা উৎসে আয়কর কাটার নিয়ম আছে। এ উৎসে আয়করের সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। এটা কৃষকের ঘাড়ে গিয়ে পড়বে। পাট শিল্পের উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। পাট শিল্পটি ছোট হয়ে আসছে। এটা উদ্বেগের। পাটপণ্যের সর্ববৃহৎ বাজার ছিল তুরস্ক। এ বাজারে দুই লাখ টনের চাহিদা এখন এক লাখ টনের নিচে নেমে এসেছে। দ্বিতীয় বৃহৎ বাজার ছিল চীন। এখন ভারত সবচেয়ে বড় বাজার। কিন্তু বাজারটি টেকসই না। দেশটির পক্ষ থেকে অ্যান্টি-ডাম্পিং ডিউটি আরোপিত থাকার ফলে কয়েকজনের মধ্যে ব্যবসাটা নিয়ন্ত্রিত হয়। কারণ অ্যান্টি-ডাম্পিং ডিউটির হার বাংলাদেশের সব মিলারের ক্ষেত্রে সমান নয়। এতে করে কিছু বাংলাদেশী মিলার ডিউটির ক্ষেত্রে লেভারেজ পায়, কিছু মিলার তা পায় না। ভিন্ন ডিউটি হারের ক্ষেত্রে আমরাও সুবিধা পাই। কিন্তু ডিউটির হারে ভিন্নতা থাকা উচিত নয়। এটা জেনারালাইজ করলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হলে শিল্প টিকে থাকতে পারবে। এ অ্যান্টি-ডাম্পিং প্রত্যাহার করাতে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক উদ্যোগ নেয়া উচিত।

পাট একটা কৃষিপণ্য। উৎপাদন পর্যায়ে ৭০-৭৫ শতাংশ হলো উপকরণ মূল্য। এরপর আছে শ্রমের মজুরি এবং অন্যান্য পরিষেবা। এ তিন ব্যয়ের ক্ষেত্র নির্বাহ করে কম মূল্যে ডাম্পিং করার কোনো সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের গবেষণা হতে পারে বাংলাদেশী মিলারদের ইনভয়েস মূল্য নিয়ে। ইনভয়েসের মূল্যের ক্ষেত্রে মিলে সর্বনিম্ন স্তরের কাটিং জুট, আর সর্বোচ্চ স্তরের জুট হচ্ছে ফাইন জুট, যেটা দিয়ে চিকন সুতা বানানো হয়। এ ধরনের ভিন্নতায় মূল্য পার্থক্য দুই থেকে তিন গুণ। যেসব মিল কাটিং জুট দিয়ে উৎপাদিত সুতা বিক্রি করেছে, সেটার দাম স্বাভাবিকভাবেই কম, কারণ মিলগুলোর উপকরণ মূল্য ছিল কম। আর যার উপকরণ মূল্য বেশি তার ইনভয়েস মূল্য দেখে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হলে সেটা মিসলিডিং হবে।

চলতি বছর একমাত্র জনতা-সাদাত বাদ দিয়ে গোটা পাট শিল্প নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির মধ্যে রয়েছে। এটা কোনো ভালো খবর নয়। এ বছর পাট খাত মারাত্মক খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। দুই বছর আগে পাটের মূল্যে অযৌক্তিক প্রবৃদ্ধি হয়, সেই সময় অনভিজ্ঞ ক্ষুদ্র পুঁজিপতিরা পাট মজুদ করতে শুরু করে। বাজারে সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছিল তারা। এ বিনিয়োগকারীদের কেউ কেউ ১০ বা ১২ হাজার টন পাট কিনে রেখে দিচ্ছে। কিনে মৌসুমে বিক্রি করবে না বিনিয়োগকারীরা। মজুদ করে রাখবে। যেহেতু এরা সংখ্যায় অনেক কিন্তু তাদের অনভিজ্ঞতার কারণে সরবরাহ পর্যায়ে পাটের দাম বেড়ে যায়। দুই বছর আগে পাটের সুতার দামের সঙ্গে সমন্বয়ে ওই পরিস্থিতি মোকাবেলা করা সম্ভব হয়েছিল। এরপর বৈশ্বিক চাহিদা কমে যাওয়া, তুরস্কের ভূমিকম্প মিলিয়ে পাটের দামে ধারাবাহিক পতন ঘটছে। আমরা এখন যে মূল্যে বিক্রি করছি তা আমাদের ধারণা মতে গত ১৫ বছরের সর্বনিম্ন। সরকারের প্রণোদনা আছে। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রণোদনা ছাড় করা নিয়ে সমস্যা রয়েছে। যার ফলে তারল্য সমস্যা রয়েছে।

আরেকটা সমস্যা হলো, পাটের দাম এত কমে যাওয়ার পরও আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাপক মূল্য হ্রাস হয়েছে। ভলিউম গ্রোথ হচ্ছে না। এর একটা কারণ তুরস্কের ভূমিকম্প। দেশটি একক দেশ হিসেবে সবচেয়ে বড় রফতানি গন্তব্য। এছাড়া আরেকটা কারণ হলো ভারতের অ্যান্টি-ডাম্পিং ডিউটি। এর প্রভাবে শিল্পটি যতটা প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারত ততটা করতে পারছে না। পশ্চিম বাংলায় জুট কমিশন রয়েছে। বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো কিছু নেই। সরবরাহ ব্যবস্থার মধ্যে হঠাৎ একদল মজুদদারের আবির্ভাব শিল্পকে ব্যাপক মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এদের তৎপরতা অব্যাহত থাকলে আগামীতে বাজার পরিস্থিতি নেতিবাচক হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

পাট খাতকে টেকসই করতে করণীয়গুলো কী?

পাট খাতে বৈচিত্র্যকরণের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সরকারের একাধিক উদ্যোগ রয়েছে। কিন্তু একটা পর্যায় পর্যন্ত গিয়ে সেগুলো কার্যকারিতা ধরে রাখতে পারেনি। এখন পর্যন্ত কোনো গবেষণাতেই বাণিজ্যিকভাবে সফল পণ্য উন্নয়ন সম্ভব হয়নি। পাটের বাজার সম্ভাবনার বিকাশ ঘটাতে হবে। প্রাথমিকভাবে পাটের ব্যবহার তিন-চার ধরনের। কার্পেটের ব্যাকিং হিসেবে শিল্পপণ্য, আরেকটা হলো স্যাকিং ম্যাটেরিয়াল হিসেবে বস্তা, আরেকটা হলো হেসিয়ান। এ তিনটি মৌলিক ব্যবহার ছাড়া কিছু সয়েল সেভার, শপিং ব্যাগ হিসেবে ব্যবহার হয়। এ অবস্থায় স্কেল আপ করতে গেলে বাংলাদেশে কার্পেট ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে ঝুঁকতে হবে। এছাড়া ব্যাগ উৎপাদনে যেতে হবে। উৎপাদন খরচ কমানোর দিকেও মনোনিবেশ করতে হবে। পাট উৎপাদনে যে যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয় সেগুলো অনেক পুরনো। প্রযুক্তিগত তেমন কোনো উদ্ভাবন হয়নি। কিন্তু সুযোগ রয়েছে। আমরা করার চেষ্টা করছি। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনার চেষ্টা করছি, অপচয় কমানোর চেষ্টা করছি। এসব উদ্যোগের মাধ্যমে আমরা পাটকে প্রতিযোগিতামূলক করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। গোটা শিল্পে এ ঘটনাগুলো যতক্ষণ পর্যন্ত না ঘটানো যাবে, আগ্রহী ক্রেতাদের কাছে আকর্ষণীয় এবং অ্যাফর্ড করার মতো একটা পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করা সম্ভব হবে না।

পাটের পচন পদ্ধতি প্রক্রিয়াকে কীভাবে আরো পরিবেশবান্ধব করা যায় সে বিষয়ে ভাবতে হবে। পাটের জাগ দেয়ার কাজটি জুলাই-সেপ্টেম্বরের মধ্যে করতে হয়, কারণ পানি থাকে। জাগ দেয়ার জন্য পানির বিকল্প বের করতে পারলে যেকোনো সময় পাট জাগ দেয়া সম্ভব। এতে করে পাটের মানও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আকিজ বশির গ্রুপ পাট নিয়ে অনেক ধরনের গবেষণার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। পাটের ব্যবহার বৃদ্ধি নিয়ে আমাদের গবেষণা চলমান আছে। পাটের ভ্যালু চেইনে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারি সহায়তা দরকার তার একটা মূল্যায়ন প্রয়োজন। পাটের বীজের ক্ষেত্রে শতভাগ ভারতীয় নির্ভরতা রয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারের নীতিসহায়তার সুযোগ রয়েছে। দ্বিতীয়ত, পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা দরকার। পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত না হওয়ায় পাটের দাম বেড়ে যাওয়ার ঘটনা বিগত দিনগুলোয় ঘটেছে। পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার জন্য ফরিদপুরে কিছু কৃত্রিম নালা আছে। এ নালার মাধ্যমে ফরিদপুরজুড়ে পানি সরবরাহ হয়। ফরিদপুর, কুড়িগ্রাম অঞ্চলের এ নালাগুলোর মাধ্যমে পানির প্রবাহ ঠিক রাখতে পারলে অনেক সমস্যাই থাকে না। সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে পাট ও পাটজাত পণ্যকে টেকসই করতে ও এ পণ্যগুলোর রফতানি বৃদ্ধি করতে হলে সরকারের নীতিসহায়তা প্রয়োজন আছে। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদার ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই।

পাটের উৎপাদন, চাহিদা ও সরবরাহ সম্পর্কে আপনাদের নিজস্ব কোনো সমীক্ষা আছে?

আকিজ গ্রুপের স্বাধীন সমীক্ষা অনুযায়ী, দেশে ১২ লাখ টন কাঁচা পাট উৎপাদন হয়। এ পরিমাণকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। তিন-চার বছর আগে ১০ লাখ টন পাট রফতানি হতো। গত দুই বছরের রফতানি ট্রেন্ড অনুযায়ী উৎপাদনের ১২ লাখ টন পাট থেকে আট থেকে সাড়ে আট লাখ টন কাঁচা পাট রফতানি হয়। স্থানীয় পর্যায়ে ব্যবহার হয় দুই থেকে আড়াই লাখ টন। এ পাট প্রাথমিকভাবে বস্তা তৈরিতে ব্যবহার হয়। সবচেয়ে বেশি পাটের বস্তা ব্যবহার হয় আলু সংরক্ষণের জন্য। কারণ আলু সংরক্ষণের ক্ষেত্রে পাটের বস্তার বিকল্প নেই। সরকার বছরে ৫০-৫৫ হাজার টন পাট ব্যবহার করে বিভিন্ন পণ্য যেমন ধান-চাল সংরক্ষণের কাজে। দেড়-দুই লাখ টন পাট ব্যবহার করা হয়ে ওঠে না।

গত দুই বছরে পাটজাত পণ্যে রফতানি আট থেকে সাড়ে আট লাখ টনের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। সুতা, বস্তা ও হেসিয়ানের মতো পাটজাত পণ্য উৎপাদনে জনতা-সাদাতের সক্ষমতা দৈনিক ৩০০ টন। প্রতিষ্ঠানটি এখন বাংলাদেশের শীর্ষ পাটজাত পণ্য রফতানিকারক। এখন বৈশ্বিক চাহিদা নিম্নমুখী। বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি পাটজাত সুতা আমদানিকারক দেশ ছিল তুরস্ক। দেশটি বছরে গড়ে দুই লাখ টন পাটজাত সুতা আমদানি করত। গত দুই বছরে যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। দেশটি পাটজাত সুতার বিকল্প হিসেবে একটি পণ্য ব্যবহার করছে। ঝুট পোশাক থেকে দেশটি কটন জেনারেট করে, যা পাটজাত সুতার বিকল্প হিসেবে ব্যবহার হয়। এছাড়া স্যাকিং ও হেসিয়ান পণ্যের চাহিদাও সংকুচিত হয়েছে। বাংলাদেশের পাটের বস্তা রফতানি হতো আফ্রিকায়। ওই অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সেখানে রফতানি করা সম্ভব হচ্ছে না।

পাট খাতে আপনার সামগ্রিক অভিজ্ঞতা কেমন?

আমাদের মৌলিক ব্যবসা ছিল পাট। নতুন দুটি পাট কোম্পানি আমি অধিগ্রহণ করেছি। পাট খাতে আকিজ গ্রুপের অভিজ্ঞতা অনেক পুরনো। জনতা-সাদাত জুট মিলের মালিকানার মাধ্যমে পাট খাতে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলতে গেলে প্রবেশের পর আমার মনে হয়েছে, খাতটি কার্যকারিতার চেয়ে আবেগ দিয়েই পরিচালিত হয় বেশি। কৃষি থেকে শুরু করে পাট এবং পাটজাত পণ্যের ভোক্তা পর্যন্ত যে সুযোগ বাজারে রয়েছে, সেখানে অনেকগুলো ডট আছে। এ ডটগুলোর সংযোগ ঘটানো হয়নি সঠিকভাবে। ফলে খাতটির প্রকৃত সম্ভাবনা বিকশিত হয়নি। এ খাতটির বাণিজ্যিক সম্ভাবনা বিকশিত হওয়া প্রয়োজন। পাট ও পাটজাত পণ্যের ক্রেতাদের সঙ্গে আলাপচারিতায় আমার মনে হয়েছে, এ খাতের উন্নয়ন সম্ভাবনার মাত্রা অনেক বেশি ওপরে। বর্তমানে পাটজাত পণ্যের বেশির ভাগটাই র‍্যাপিং ম্যাটেরিয়াল। একটি পাটের বস্তার ক্ষেত্রে দেখা যাবে প্লাস্টিক বস্তার চেয়ে সেটা অপ্রয়োজনীয় ধরনের ভারী। আর এ পাট খাতের উন্নয়নের চেষ্টা হচ্ছে শুধু রাষ্ট্রীয় সহায়তা কাজে লাগিয়ে। কৃষিপণ্য বলে এতে রাষ্ট্রীয় সহায়তা লাগবেই। কিন্তু শিল্পকেও সঠিক সৃজনশীলতার মাধ্যমে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ শুধু নিয়ন্ত্রণমূলক সহায়তা কাজে লাগিয়ে এ শিল্পে বিপ্লব সম্ভব হবে না। আমার অভিজ্ঞতা বলে সম্ভাবনা অপার। এ খাতের ভ্যালু চেইনের প্রতি ক্ষেত্রেই অদক্ষতা আছে। আমাদের প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে চুক্তি সই করেছে। আমরা পাটের আইটেমগুলো সম্পর্কে আরো বেশি জানতে-বুঝতে চাই। পাটের পচন প্রক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করছি। এটার মাইক্রোবায়োলজিক্যাল বিষয়গুলো বোঝার চেষ্টা করছি। এ বিশ্লেষণগুলোর জন্য অনেক বিনিয়োগ করছি। কিছু সুফলও পেতে শুরু করেছি। তবে এগুলো দীর্ঘমেয়াদি কর্মকাণ্ড। আশা করছি একটা নেতৃত্বের জায়গায় আসতে পারব, যেটা এ খাতে প্রয়োজন ছিল। পাট একটা গোল্ডেন ইন্ডাস্ট্রি, যেটা বহুদিন ধরে অবহেলিত ছিল। এখানে উপযুক্ত প্রযুক্তি ও প্রক্রিয়া যুক্ত করার প্রয়োজন রয়েছে, যা আমরা শুরু করেছি। এছাড়া অন্য শিল্প প্রকল্পগুলোর দিকেও একই ধরনের উদ্ভাবনী বিষয়ে নজর রয়েছে। প্রকল্পসহ পণ্যের দিকেও বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকি। প্রকল্পের আগে আমরা পণ্য নিয়ে চিন্তা করি। আমাদের মানসিকতা অনেক বিশ্লেষণধর্মী। গবেষণাধর্মী কাজে বেশি গুরুত্ব দিই, যার ছাপ আমাদের সব পণ্যেই দৃশ্যমান। যার কারণে আমরা সেরা ব্র্যান্ডের স্বীকৃতিও পেয়েছি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন