২০৩০ সালের মধ্যে বিলিয়ন ডলারের ইন্ডাস্ট্রি হবে প্লাস্টিক

আপনাদের প্লাস্টিক পণ্যের রফতানিটা শুরু হয়েছিল কীভাবে? 

১৯৬৯ সালে বেঙ্গল প্লাস্টিকের যাত্রা শুরু। আমরা তখন বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং পার্টস বানাতাম। জুট ও টেক্সটাইল মিলে বিভিন্ন পার্টস বানাতাম। গার্মেন্টস যখন শুরু হলো সেই অ্যাকসেসরিজ দিয়েই আমাদের শুরু। তখন হ্যাঙ্গার সাপ্লাই শুরু করি। আমেরিকা এবং ইউরোপেও আমরা সাপ্লাই করি। অনেক বড় বড় কোম্পানির আমরা নমিনেটেড হ্যাঙ্গার সাপ্লায়ার। নব্বইয়ের দশকেই মূলত আমাদের এক্সপোর্ট শুরু হয়। গার্মেন্টস দিয়ে শুরু করার কারণে আমরা হ্যাঙ্গারটা এক্সপোর্ট শুরু করলাম। তারপর বাংলাদেশের গার্মেন্টসগুলো আমাদের কাছ থেকে হ্যাঙ্গার নিচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে হ্যাঙ্গার সাপ্লাই করছিলাম তখন। এরপর আমরা হ্যাঙ্গারের বাইরে এসে প্রতিদিনের ব্যবহারের জন্য যেসব আইটেম লাগে সেগুলো উৎপাদন শুরু করি। ২০০০-এর দিকে আমরা টেবিল ওয়্যার, কিচেন ওয়্যার এবং ফার্নিচার উৎপাদন শুরু করি। ওগুলো আমরা লোকাল মার্কেটে সাপ্লাই করি এবং বিশ্বের ৫৫টি দেশে এক্সপোর্ট করি। তবে মেজর এক্সপোর্ট করি আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কোরিয়া, ভারত, জাপান এবং ইউরোপের দেশগুলোয়।

মেজর পণ্য কী হ্যাঙ্গার?

এটা মেজর। তবে আমরা হাউজহোল্ড আইটেমও করছি। এর মধ্যে টেবিল ওয়্যার, কিচেন ওয়্যার এবং প্লাস্টিক ফার্নিচার রয়েছে। ভারত, জাপান এবং আমেরিকায় মূলত হাউজহোল্ড আইটেমগুলো আমরা রফতানি করি। বিদেশে আমরা বড় বড় কাস্টমারের সঙ্গে ব্যবসা করি। হ্যাঙ্গার তো আমরা পৃথিবীর বড় বড় রিটেইলারদের সাপ্লাই দিই। এটা আমরা অনেক সময় চায়নায়ও এক্সপোর্ট করি।

শুরুর দিকে ইঞ্জিনিয়ারিং প্লাস্টিক দিয়ে...

আমরা শুরু করেছিলাম প্লাস্টিকের ইঞ্জিনিয়ারিং প্রডাক্ট দিয়ে। তখন জুট মিল, টেক্সটাইল মিলের পেপারস বানাতাম আমরা। তখন তো এ মিলগুলো খুব রমরমা ছিল। তখন আমরা কাঠ এবং লোহার রিপ্লেসমেন্ট প্রডাক্ট বানাতাম। শুরুটা প্লাস্টিকের ইঞ্জিনিয়ারিং প্রডাক্ট দিয়ে কিন্তু পরে আমরা প্রচুর ডাইভারসিফাই করি। ইনস্টিটিউশনাল সাপ্লাই হিসেবে আমরা দেশে নাম্বার ওয়ান। আমরা আরো অনেক ধরনের প্রডাক্ট সাপ্লাই করি। এডুকেশনাল ইনস্টিটিউশনাল যে ফার্নিচারগুলো লাগে, যেমন প্রাইমারি বা হাইস্কুলে তার পুরোটাই আমরা সাপ্লাই করি। বছরে কয়েকশ কোটি টাকার সাপ্লাই হয়। আমরা কনজিউমার প্রডাক্ট করি না, তাই অ্যাডভারটাইজমেন্টের প্রয়োজন পড়ে না। কোকা-কোলা এবং পেপসির ক্রেট অলমোস্ট সাপ্লাইয়ার আমরা। আরএফএল তো প্লাস্টিক শুরু করছে নব্বইয়েরও পর। প্রাণের ক্রেটগুলোও আমরা দিতাম।

আপনারা তো দুই মার্কেটেই আছেন। আপনাদের রফতানির পরিমাণ কেমন?

রফতানি আমাদের অন অ্যান এভারেজ ৭ কোটি ডলার। প্রচ্ছন্ন রফতানি মিলিয়ে এক্সপোর্ট প্রায় বিলিয়ন ডলার।

লোকাল মার্কেট আর এক্সপোর্ট মার্কেটে কোন জায়গায় আপনারা বেশি শক্তিশালী? 

লোকাল মার্কেটটা আমাদের অনেক বড়। আগেই বলেছি অনেক ইনস্টিটিউশনাল প্রডাক্ট বানাই আমরা। ফলে লোকাল মার্কেটটা শক্তিশালী। এক্সপোর্ট মার্কেটেও পোটেনশিয়াল আছে। তবে এই মার্কেটটা বিশ্বজুড়ে ৮০-৯০ শতাংশ দখল করে আছে চীন। ধীরে ধীরে মার্কেটটা ওরা রিলোকেট করছে। এ সুযোগ বাংলাদেশ নিতে পারে। ইন্ডিয়া নিচ্ছে, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়াও নিচ্ছে। বিশ্বে এখন পলিটিক্যাল শিফটিং হচ্ছে। তাই এ সুযোগটা আমরা নিতেই পারি। আমাদের অবকাঠামো সংকট তো আছেই। প্লাস্টিক যখন এক্সপোর্টে যাবেন তখন আপনার অনেক ফ্যাক্টরি লাগবে। এক-দুটি ফ্যাক্টরি দিয়ে হবে না। বড় বড় বায়ার আসতে চায় না।  যেমন আমাদের গার্মেন্টসে অনেক ফ্যাক্টরি আছে তাই বায়ার এসে তাদের মতো করে সোর্সিং করতে পারে। 

ওয়ালমার্টের মোট সেলের মাত্র ১৪ শতাংশ হলো গার্মেন্টস। অধিকাংশই অন্যান্য আইটেম। তার মধ্যে ফুডের অংশ সবচেয়ে বড়। তাদের প্রচুর প্লাস্টিক আইটেমও আছে। তাদের প্লাস্টিক আইটেম ১-১০ এর মধ্যে। তারা ২৯৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য বিক্রি করে। তারা ১৫ বিলিয়ন ডলারের মতো প্লাস্টিক পণ্য বিক্রি করে। এটি একটি কোম্পানির কথা বলছি। সে হিসেবে বাংলাদেশ এখনো রেস শুরুই করেনি।

এর কারণ কী?

এর কারণ হলো চীনের ওপর বায়ারদের নির্ভরতাটা বেশি।

আস্থার কোনো সমস্যা আছে কি?

আস্থার সমস্যা নেই। আমাদের প্লাস্টিক তো গার্মেন্টসের মতো সমৃদ্ধ নয়। এক্ষেত্রে মেশিন লাগে, মোল্ড লাগে। একজন বায়ার অনেক ধরনের প্রডাক্ট কেনে। প্রতিটি প্রডাক্টের আলাদা মোল্ড লাগে। আলাদা বিনিয়োগ প্রয়োজন হয়। তারা নিজস্ব ডিজাইনে প্রডাক্ট কিনে। যে প্রডাক্ট আমি লোকাল মার্কেটে সেল করছি, সেই প্রডাক্ট তো আর ওয়ালমার্ট কিনবে না। তার জন্য আলাদা ডিজাইনে পণ্য তৈরি করতে হয়। সে কারণে বিনিয়োগও লাগে প্রচুর। তাই প্রতিটি মোল্ডের জন্য আলাদা বিনিয়োগ প্রয়োজন। বাংলাদেশের এক্ষেত্রে সক্ষমতার অভাব আছে। এখন আপনি যখনই মোল্ড আমদানি করতে যান, আপনার তিন-চার মাস চলে যায়। কিন্তু লিড টাইম তো অত বেশি নেই। বাংলাদেশে এ ধরনের অবকাঠামো এখনো ঠিকমতো গড়ে ওঠেনি। আমরা বেঙ্গল গ্রুপ নিজেদের মোল্ড বানাতে চেষ্টা করেছি। তার পরও আমার প্রয়োজনীয় মোল্ডের ৫০-৬০ শতাংশ আমদানি করতে হয়। ৩০-৪০ শতাংশ আমি নিজে বানাতে পারি। অবকাঠামো, লোকবল, টেকনিক্যাল পিপল, এগুলো এখনো বাংলাদেশে ওভাবে হয়নি। আরএফএলও কিছু বানায়। কিন্তু এখনো পুরো ইন্ডাস্ট্রি অলমোস্ট আমদানিনির্ভর। কারণ আমাদের দেশে প্লাস্টিকের ওপর ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশন তো ওভাবে নেই। আমরা বাংলাদেশ প্লাস্টিক ইঞ্জনিয়ারিং ইনস্টিটিউট বানানোর উদ্যোগ নিয়েছি। আমি তার ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান। ওখানে আমরা মোল্ড, ডিজাইনের ওপর ট্রেনিং দেয়ার মাধ্যমে এরিয়াগুলো ডেভেলপ করার চেষ্টা করব। প্লাস্টিকের ম্যানুফ্যাকচারার আরো যারা আছেন, তারাও যদি এ ধরনের ক্যাপাবিলিটি নিয়ে আসতে পারেন, তাহলে লিড টাইম নিয়ে ঝামেলায় পড়তে হবে না। অথবা থার্ড পার্টি মোল্ডের ইউনিটগুলো বাংলাদেশে হওয়া দরকার। বিদেশী অনেক কোম্পানি মোল্ড ফ্যাক্টরি বানানোর চেষ্টা করছে। সেটি যদি হয়ে যায়, তাহলে রফতানি আরো সহজ হবে। কিছুদিন আগে প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলারের একটি অর্ডার আমি ধরতে পারিনি। কারণ তাদের লিড টাইম অনেক কম ছিল। চীন থেকে মোল্ড বানিয়ে এনে সাপ্লাই করার মতো সময় আমার হাতে ছিল না। এ রকম অনেক সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায়। তবে প্লাস্টিক রফতানির অনেক সম্ভাবনা আছে। বায়াররাও এখন রিলোকেট করার চিন্তা করছেন। বাংলাদেশকে তারা সম্ভাব্য ডেস্টিনেশন হিসেবে ভাবছে। বাংলাদেশ সোর্সিং কান্ট্রি হতে পারে বলে তারা মনে করছে। তারা এখন বাংলাদেশকে গোনায় ধরছে।

এছাড়া আর কী ধরনের চ্যালেঞ্জ আছে?

চ্যালেঞ্জ তো আছেই। প্লাস্টিক হলো পেট্রোকেমিক্যাল। তাই এর চ্যালেঞ্জ সবসময়ই আছে। কারণ বাংলাদেশে তো র ম্যাটেরিয়ালস হয় না। র ম্যাটেরিয়ালস আমদানি করে তারপর আমাকে রফতানি করতে হচ্ছে। 

আমাদের তো র ম্যাটেরিয়ালসের সোর্সিংটা নেই। তবে বাংলাদেশ মোটামুটি একটু ম্যাচিউরড হয়েছে। একটি পেট্রোকেমিক্যাল কমপ্লেক্স হতে পারে বাংলাদেশে, যেখানে র ম্যাটেরিয়ালস বানানো যেতে পারে। কিন্তু সমস্যা হলো পেট্রোকেমিক্যালের ইন্ডাস্ট্রিতে অনেক বেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন। এটি প্রাইভেট সেক্টরের জন্য খুবই কঠিন। আমাদের বিজনেস সামিটে সৌদি বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আমি এ বিষয়ে আলোচনা করেছিলাম। একটি পেট্রোকেমিক্যাল কমপ্লেক্স করার কথা ভাবতে বলেছি। ওই ধরনের একটি কমপ্লেক্স হওয়ার মাধ্যমে র ম্যাটেরিয়ালস যদি লোকালি অ্যাভেইলেবল হয়, তাহলে এক্সপোর্ট মার্কেট আরো ফ্লারিশ হওয়ার সুযোগ আছে। পেট্রলের দাম বাড়লে প্লাস্টিকের দামও বাড়ে। এটিও একটি সমস্যা।

প্লাস্টিক খাতের কোনো বিষয় স্পেসিফিক্যালি হাইলাইট করার প্রয়োজন মনে করলে আপনি বলতে পারেন।

লোকাল মার্কেটই বলুন কিংবা এক্সপোর্ট মার্কেট, কারণ আমাদের মার্কেট তো ছোট না, ১৪ কোটি মানুষের মার্কেট। মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়ছে। কনজাম্পশনও বাড়ছে। কিন্তু বাংলাদেশে প্লাস্টিকের কনজাম্পশন এখনো অনেক কম। বাংলাদেশে প্লাস্টিকের এভারেজ কনজাম্পশন নয় কেজি। অথচ যুক্তরাষ্ট্রে ১১০ কেজি। আমি যখন বাংলাদেশ প্লাস্টিক অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ছিলাম, আমি একটি রোডম্যাপ করিয়েছিলাম। সে রোডম্যাপ অনুসরণ করা সম্ভব হলে গড় কনজাম্পশন ৩৫ কেজি হবে। তখন আরেকটি সমস্যা দেখা দেবে। এ নয় কেজি নিয়েই আমরা পরিবেশ দূষণ রোধ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে হিমশিম খাচ্ছি। প্লাস্টিকের কনজাম্পশন বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পরিবেশগত বিষয়গুলোও কিন্তু আধুনিক করতে হবে। ২০০২ সালে আমরা প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করেছি। তখন তো আমাদের কনজাম্পশন ছিল দুই-আড়াই কেজি। তখনই নিষিদ্ধ করতে হয়েছে। সে জায়গায় ৩৫ কেজিতে গেলে তো আমাদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, রিসাইক্লিং, সার্কুলার ইকোনমি এগুলো আধুনিক ও যুগোপযোগী করতে হবে। আর না হলে ভুল বোঝাবুঝির কারণে ইন্ডাস্ট্রি ভুগবে। এ ভুল বোঝাবুঝির কারণে প্লাস্টিককে পরিবেশের প্রতিদ্বন্দ্বী বানিয়ে ফেলা হচ্ছে। অথচ ১০টি প্লাস্টিকের ফার্নিচার একটি গাছ কাটা বন্ধ করেছে। ৫০০ টাকা দিয়ে একটি চেয়ার কিনে ৫-১০ বছর ব্যবহার করা যায়। এগুলো ট্রান্সপোর্ট করতে সহজ। প্যাকিং করতে সহজ। এগুলো তো বেনিফিট। এগুলো নষ্ট হলে আবার রিসাইকেল করার সুযোগ আছে। সেক্ষেত্রে পলিসি মেকারদের আমাদের ইন্ডাস্ট্রিগুলোর সঙ্গে আরো ক্লোজলি কাজ করা দরকার। ইন্ডাস্ট্রির প্রয়োজন তাদের বোঝা দরকার। তাহলে পলিসি করতে সুবিধা হবে। সেক্ষেত্রে আমরা এ খাত থেকে আরো বেশি বেনিফিট নিতে পারব। কিছুদিন আগে প্লাস্টিকের একটি পলিসি হয়েছে। এটি শিল্প মন্ত্রণালয় ও নীতিনির্ধারকরা মিলে তৈরি করেছে। আমাদের ইন্ডাস্ট্রির লোকজনও সেখানে ছিল। সেটি যদি বাস্তবায়ন হয়, তাহলে এ ভুল বোঝাবুঝিগুলো দূর হবে বলে আশা করি। এক্সপোর্ট ওরিয়েন্টেড ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করার জন্য কমপ্লায়েন্স খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তা না হলে বায়াররা আপনার কাছ থেকে পণ্য নেবে না। সেক্ষেত্রে এ বিষয়গুলো নিশ্চিত করা প্রয়োজনীয়। তা না হলে এ খাতের রফতানি বাড়ানো যাবে না।

সবকিছু ঠিক থাকলে প্লাস্টিক কবে নাগাদ বিলিয়ন ডলারের ইন্ডাস্ট্রি হতে পারে?

আমরা যে রোডম্যাপ করেছিলাম, তা বাস্তবায়ন হলে বিলিয়ন ডলারে যাওয়ার কথা ছিল ২০৩০ সালের মধ্যে। এখন ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে তো আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। কিন্তু এখনো সম্ভাবনা আছে। আমরা তো প্রচ্ছন্নভাবে এখনই বিলিয়ন ডলারের ওপরে রফতানি করছি। সরাসরি রফতানি আরো বাড়ানো যায়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন