ডেনিম পণ্য রফতানিতে তৈরি পোশাক খাতের সুপারস্টার হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রামভিত্তিক বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ রফতানিকারক শিল্পপ্রতিষ্ঠান প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপ। এ গ্রুপের একাধিক সহযোগী প্রতিষ্ঠান জাতীয় রফতানিতে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে নিয়মিতভাবে বিভিন্ন পদক পেয়ে আসছে। ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী প্রয়াত মো. নাছির উদ্দিন। বাবার অবর্তমানে ব্যবসার হাল ধরে দক্ষতার সঙ্গে এগিয়ে নিচ্ছেন তার সন্তানরা। বাবার জীবদ্দশায়ই ঠিক করে দেয়া মিশন-ভিশন নিয়ে ব্যবসায়িক অবস্থান হয়েছে আরো শক্তিশালী। বাবার কাছ থেকে শেখা ব্যবসায়িক শিক্ষা নিয়েই পথ চলছেন ৩৫ হাজার কর্মী নিয়ে। তাদের প্রস্তুত করা পণ্য রফতানি হচ্ছে বিশ্বের প্রায় অর্ধশতাধিক দেশে। এর সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর। নিজ প্রতিষ্ঠান ছাড়াও কথা বলেছেন ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের পোশাক রফতানির লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে পরিকল্পনাসহ নানা দিক নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন চট্টগ্রামের ব্যুরোপ্রধান রাশেদ এইচ চৌধুরী
উন্নত ডেনিম প্রস্তুতকারী হিসেবে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ফ্যাশন বিক্রেতাদের নিকট প্যাসিফিক জিন্সের পরিচিতি একটি বিশ্বস্ত ও পছন্দনীয় সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে। পণ্যের উৎপাদন ব্যবস্থায় আপনাদের আর কোনো পরিকল্পনা আছে কি?
আমাদের ডেনিম উৎপাদনে সবসময়েই গুরুত্ব পেয়ে আসছে গবেষণা, বৈচিত্র্যময় ডিজাইন ও প্রযুক্তিনির্ভর উদ্ভাবনশীলতা। এর সুফলও এসেছে। এবার আমাদের ফোকাস হচ্ছে পণ্যের বৈচিত্র্য আনা। সেই সঙ্গে মার্কেটেরও। একজন মানুষ সকাল থেকে শুরু করে রাতে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত বিভিন্ন কার্যক্রমে যেসব পোশাক পরিধান করে, সবই উৎপাদনে যুক্ত করব। ধাপে ধাপে এ লক্ষ্য অর্জনের পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের। যাতে আমরা ভিন্ন ভিন্ন প্রডাক্টে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা অর্জন করতে পারি। প্রতিষ্ঠানে চালু রেখেছি মডার্ন ম্যানেজমেন্ট কনসেপ্ট। প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে প্রতিনিয়তই যুক্ত থাকছি গবেষণা ও উদ্ভাবন কার্যক্রমে।
রফতানি পরিসংখ্যান বলছে সম্প্রতি বছরগুলোয় নতুন বাজার তৈরিতে বেশ এগিয়েছে বাংলাদেশী উদ্যোক্তারা।
সম্প্রতি বছরগুলোয় বলব বাংলাদেশ ভালো করেছে এক্ষেত্রে। অপ্রচলিত বাজারে গ্রোথ ভালো। এটা কন্টিনিউ করতে হবে। ফরেন পলিসিতেও বিষয়টি আমাদের অ্যাড্রেস করতে হবে। আবার একটা কথা খেয়াল রাখতে হবে যে জাপান, অস্ট্রেলিয়াসহ অপ্রচলিত যেসব বাজারে ভালো করছি, সেসব জায়গায় কিন্তু আমরা এখন ডিউটি ফ্রি অ্যাকসেস পাই। এ মার্কেটগুলোয় আমরা এখন ভালো করছি, কিন্তু ২০২৭ সালে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের ফলে যে পরিস্থিতি হবে, সেটি আগেই বিবেচনায় আনতে হবে। স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার পর উন্নত দেশগুলো থেকে আর বাণিজ্য সুবিধা পাবে না বাংলাদেশ। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) নিশ্চিত করতে হবে কিংবা অন্তত অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি করে ফেলতে হবে। পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনাম এ ধরনের মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি জাপান, চীনের মতো দেশগুলোসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে করেছে। তাই খুব সিরিয়াসলি কাজ করতে হবে আগামী দুই বছর। যেসব দেশের বাজারে আমাদের ভালো সম্ভাবনা আছে, সেখানে যেকোনো উপযুক্ত ফরম্যাটে কান্ট্রি টু কান্ট্রি চুক্তি করে নিতে হবে। রফতানির গ্রোথ ধরে রাখতে জায়গাটায় খুল ভালোভাবে কাজ করতে হবে। যাতে ডিউটি ফ্রি অ্যাকসেস নিশ্চিত করে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বজায় থাকে।
ভূরাজনীতিসহ নানা কারণে চীনের ওপর অতিনির্ভরতা কমাচ্ছে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো। এক্ষেত্রে ইউরোপের বিশাল বাজারে রফতানিতে কেমন সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন?
ইইউর বাজারে চীনকে টপকানো বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব, এটা এক বাক্যে সহজে বলে দেয়া যায় না। এখানে অনেক ফ্যাক্টর কাজ করবে। নতুন প্রডাক্টে আমরা প্রতিযোগী হওয়ার চেষ্টা করছি, আবার আমাদের চলমান মার্কেটে প্রতিযোগিতায় আছি। এক্ষেত্রে আমাদের জন্য এখন সঠিক পণ্য নির্বাচন করাটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। চায়নার মার্কেট সুবিধা নেয়ার বিষয়টি শুধু প্রডাক্টের ওপরই নির্ভর করে না। এটা নির্ভর করে কাস্টমারের সেগমেন্টের ওপর। চায়না থেকে শিফট করলে বাংলাদেশেই আসবে এভাবে জোর দিয়ে বলার সুযোগ নেই। বায়ারদের সোর্সিং স্ট্র্যাটেজি আছে। কোন প্রডাক্ট কোন দেশ থেকে কতটা নেবে, এটা সোর্সিং স্ট্র্যাটেজির ওপর নির্ভর করে। ফলে এ ব্যাপারে আমাদেরও আসলে স্ট্র্যাটেজি লেভেলে স্টাডি করা দরকার। সিজন টু সিজন বিজনেস না করে বরং একটা লং টার্ম ভিশন থাকা জরুরি। চীনের জায়গায় বাংলাদেশকে নিতে হলে সব ধরনের পোশাক উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। এজন্য এক বছর পর বিজনেসের কী হবে এটা চিন্তা না করে লং টার্ম প্ল্যান করতে হবে যে ১০ বছর পরে আমরা নিজেদের কোথায় দেখতে চাই।
রফতানি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প শক্তিশালী করার বিষয়টিও বেশ গুরুত্ব পেয়ে আসছে।
ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজে আমরা কটন প্রডাক্টে বেশ এগিয়েছি। স্থানীয়ভাবে উৎপাদকরা আনুষঙ্গিক পণ্যের কারখানা স্থাপন করছেন। এসব উদ্যোগে বিদেশী মুদ্রার সাশ্রয় হওয়া ছাড়াও স্থানীয়দের জন্য নতুন কর্মসংস্থানেরও সুযোগ তৈরি হয়েছে। এখন ম্যান মেড ফাইবারে (এমএমএফ) অর্থাৎ কৃত্রিম তন্তুর পোশাকে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজে কাজ শুরু করতে হবে। এখানে পলিসি সাপোর্ট লাগবে সরকারের দিক থেকে। ম্যান মেড ফাইবারের ক্ষেত্রে ডিউটি, ভ্যাটসংক্রান্ত বেশকিছু ইস্যু আছে, যেগুলো অ্যাড্রেস করে লং টার্ম পলিসি নেয়াটা জরুরি। নিট পণ্যে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজে সক্ষমতা অনেক ভালো থাকায় বাংলাদেশের লাভও ভালো থাকে। এখন কৃত্রিম তন্তুর পোশাকে আমরা যে খুব বড় পরিসরে পিছিয়ে, এটাকে সঠিকভাবে অ্যাড্রেস করে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। বর্তমানে কৃত্রিম তন্তুর পোশাক যেটুকু রফতানি হচ্ছে, সেটা পুরোপুরিই কাঁচামাল আমদানিনির্ভর। এখানে বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০ বিলিয়ন ডলারের রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা আছে। কিন্তু এ পথ পাড়ি দেয়ার সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা দৃশ্যমান নয়।
যদি সহজ একটা অংক দেখাই, পুরো ওয়ার্ল্ড মার্কেটে আমাদের এখন ৭ দশমিক ৫ শতাংশ হিস্যা। আমাদের হান্ড্রেড বিলিয়নে যেতে হলে এটাকে ১৩ শতাংশে নিতে হবে। এ লক্ষ্যে পৌঁছতে মোটা দাগে দুটি ভাগে ভাগ করতে হবে। যেমন আমাদের কটন বেজড শেয়ার এখন কত আর ম্যান মেড ফাইবারে কত। সারা বিশ্বে যে পরিমাণ পোশাক বিক্রি হয়, তার ৭০ শতাংশেরও বেশি কৃত্রিম তন্তুর (এমএমএফ)। বাকিটা তুলা থেকে তৈরি সুতার। কটনে কিন্তু আমরা এরই মধ্যে ১২ শতাংশে আছি, যেটা ১৬ শতাংশে নিয়ে যেতে হবে। ম্যান মেড ফাইবারে আমরা এখনো ৫ শতাংশের নিচে। এটাকে নিতে হবে ১২ শতাংশে। এজন্যই টার্গেট কাস্টমার, টার্গেট প্রডাক্ট কী হবে এগুলো নিয়ে পরিকল্পিতভাবে কাজ করতে হবে। দেশের প্রধান এ রফতানি খাত এখনো টি-শার্ট, ট্রাউজার ও নিটওয়্যার, সোয়েটার, শার্টস ও ব্লাউজ এবং আন্ডারওয়্যার—হাতেগোনা এসব পণ্যে আটকে থাকলে হবে না।
ব্যবসার প্রসার ঘটাতে শুরু থেকেই আপনি বৈচিত্র্যায়ণের গুরুত্ব তুলে ধরছেন। এটা কীভাবে সম্ভব? নিজ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমেও আপনি কীভাবে বিষয়টি দেখেন?
ব্যবসার প্রসার ঘটাতে বৈচিত্র্যায়ণের বিকল্প দেখছি না। এজন্য মনোযোগ দিতে হবে গবেষণা ও উদ্ভাবন কার্যক্রমে। আমি নিজের প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও সবসময় চেষ্টা করে যাচ্ছি উৎপাদিত পণ্যে বৈচিত্র্য তুলে ধরতে। ব্যবসায়িক ধারণায় আমার মরহুম বাবা ব্লু-ওশান স্ট্র্যাটেজিকে প্রাধান্য দিতেন। ব্যবসার টেকসই সম্প্রসারণে তিনি যথাযথভাবে প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন প্রয়োগ করতেন। আমিও তার দর্শন দিয়েই ব্যবসা দেখার চেষ্টা করি। এজন্য উৎপাদনে বৈচিত্র্য আনতে আমি আবারো বলছি এক্সপোর্ট কম্পিটিটিভনেস, প্রডাক্ট অ্যান্ড মার্কেট ডাইভারসিফিকেশন, এক্সপোর্ট স্ট্র্যাটেজিক ডেভেলপমেন্ট নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে।
রফতানি কার্যক্রমে দেশের বন্দর সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে, এমন অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়।
উৎপাদন ব্যবস্থা ঠিক রাখতে আমাদের সময়মতো শিল্পের কাঁচামাল পাওয়াটা খুবই জরুরি। তেমনি পণ্য প্রস্তুত করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রফতানির জন্য জাহাজে তুলে দিতে হয়। শিল্প-কারখানার কাঁচামাল আমদানি করা হয় সমুদ্রপথে আসা কনটেইনারের মাধ্যমে। আমরা আশাবাদী যে পাঁচ বছরের মধ্যে নতুনভাবে ক্যাপাসিটি অ্যাড হবে। বন্দরে এখন প্রায় তিন মিলিয়ন টিইইউএস (২০ ফুট সমমানের) কনটেইনার হ্যান্ডলিং হচ্ছে। থিওরিটিক্যালি ১০ বছরের মধ্যে এ সংখ্যা এক কোটি টিইইউএসে পৌঁছবে। অর্থাৎ প্রায় তিন গুণ। এ পরিসংখ্যান ধরে বাস্তবায়ন না হলে গ্রোথ ধরে রাখা যাবে না। ক্যাপাসিটি কিন্তু টাইমলাইন অনুযায়ীই করতে হবে। খালাসের অপেক্ষায় থাকা আমদানি পণ্যবাহী কনটেইনার দিনের পর দিন বন্দরের অভ্যন্তরে আটকে থাকা কিংবা রফতানিতব্য পণ্য সময়মতো জাহাজীকরণ না হওয়ায় উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন উদ্যোক্তারা। দেশের আমদানি-রফতানি কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়, এমন কোনো পদক্ষেপ যাতে হুট করে কেউ নিতে না পারে, সেজন্য সংসদে উপযুক্ত আইন প্রণয়ন করা উচিত।
দক্ষ জনশক্তি বিশেষ করে ম্যানেজমেন্ট লেভেলে বিদেশী জনশক্তিনির্ভরতা কতটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে তৈরি পোশাক খাত?
দক্ষ জনবল আসলে ডিমান্ড, সাপ্লাইয়ের সূত্র ধরে চলবে। অর্থাৎ ডিমান্ড অনুযায়ী তৈরি করে নেয়া হয়। দক্ষ জনবল তৈরিতে একতরফা সরকারের সমালোচনা করা ঠিক নয়। এক্ষেত্রে আমরাও দায়িত্ব এড়াতে পারি না। এটা বাস্তবতা যে এ ইন্ডাস্ট্রিতে একদম রেডি লোক পাওয়া যাবে না। এখানে গড়ে নিতে হবে। মধ্যম পর্যায়ের জনবলের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি আমাদের দেশের গ্র্যাজুয়েটরা সহজে পিক করতে পারে। তারা শেখে ও কাজও করতে পারে। তাদের হাত দিয়ে এ খাত আরো অনেক দূর যাবে। হাই ভ্যালু প্রডাক্টে বৈচিত্র্য আনতে আমাদের হয়তো একটা সময় পর্যন্ত বাইরের দেশের সাপোর্ট নিতে হবে, কিন্তু অবশ্যই নলেজ শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে হবে। এভাবেই ইন্ডাস্ট্রি ডেভেলপ করে।