বিশ্ব মশা দিবসের বিশেষ আয়োজন লার্ভা

যেভাবে মশা নিয়ন্ত্রণে সফল হওয়া সম্ভব

ড. কবিরুল বাশার

বাংলাদেশে ১২৬ প্রজাতির মশার রেকর্ড রয়েছে। তার মধ্যে বর্তমানে ঢাকায় ১৬ প্রজাতির মশা পাওয়া যায়। মশার প্রতিটি প্রজাতির প্রজনন, আচরণ রোগ বিস্তারক্ষমতা ভিন্ন। এদের সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে মশার প্রজাতি আচরণভেদে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আলাদাভাবে নিতে হবে।

মশাকে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে তা সম্ভব হবে। সমন্বিত ব্যবস্থাপনার নিম্নলিখিত চারটি অংশ রয়েছে:

. পরিবেশগত নিয়ন্ত্রণ: পরিবেশের বিভিন্ন সমস্যার কারণে মশার জন্ম হয়। পরিবেশগত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মশার প্রজননস্থল কমানো এবং ধ্বংস করে মশাকে সহজভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। উদাহরণস্বরূপ জলাধার পরিষ্কার এবং বিভিন্ন পানির পাত্র পরিষ্কার রাখা।

. জীবজ নিয়ন্ত্রণ: উপকারী প্রাণীর মাধ্যমে মশাকে নিয়ন্ত্রণ করার বিভিন্ন পদ্ধতি পৃথিবীতে প্রচলিত আছে। উদাহরণস্বরূপ গাপ্পি মাছের কথা আমরা জানি যার মাধ্যমে পরিবেশগতভাবে অল্প খরচে টেকসই মশা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কপিপোড এবং এক ধরনের ব্যাকটেরিয়ার ব্যবহারও পৃথিবীতে প্রচলিত আছে। জাতীয় জীবজ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন।

. রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ: মশা নিয়ন্ত্রণে লার্ভিসাইড এবং অ্যাডাল্টিসাইড কীটনাশক ব্যবহার করা হয়ে থাকে। প্রতিটি কীটনাশকের একটি নির্দিষ্ট ডোজ এবং কত দিন পর পর কোন মাত্রায় ব্যবহার করতে হবে তারও একটি নির্দেশনা রয়েছে। নির্দেশনা অনুযায়ী বিজ্ঞানভিত্তিকভাবে কীটনাশকের ব্যবহার করলে অবশ্যই মশা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।

. মশা নিয়ন্ত্রণে জনগণের অংশগ্রহণ: জনগণের সম্পৃক্ততা ছাড়া মশা নিয়ন্ত্রণে সফল হওয়া দুষ্কর। তাই প্রক্রিয়ায় জনগণকে সম্পৃক্ত করার জন্য নানা ধরনের উদ্যোগ নেয়া দরকার। বিশেষ করে সামাজিক সংগঠনগুলোকে উদ্বুদ্ধ করে কাজ করানো যেতে পারে।

সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য সিটি করপোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ডকে দশটি ব্লকে ভাগ করে কার্যক্রম চালাতে হবে। প্রতিটি ব্লকে নিম্নলিখিত জনবল থাকতে পারে।

. এন্টোমোলজি টেকনিশিয়ান: একটি ব্লকের জন্য একজন এন্টোমোলজি টেকনিশিয়ান থাকবে। যিনি তার ব্লকে প্রতিটি বাড়ির মশাবাহিত রোগের খবরাখবর রাখবেন। তার ব্লকে কোথায় মশা জন্মানোর স্থান আছে সেটি কিউলেক্স মশা না এডিস মশা তার রেকর্ড তার কাছে থাকতে হবে। পাশাপাশি তার ব্লকের জনগণকে সচেতন করা এবং মশা নিয়ন্ত্রণে জনগণকে সম্পৃক্ত করার দায়িত্ব তার থাকবে।

. স্প্রেম্যান: প্রতিটি ব্লকে দুজন করে স্প্রেম্যান থাকবে, যারা সকালে লার্ভিসাইড এবং বিকালে অ্যাডাল্টিসাইড স্প্রে করবে। প্রতি তিনদিন পর পর অবশ্যই একটি এলাকায় লার্ভিসাইড অ্যাডাল্টিসাইড স্প্রে নিশ্চিত করতে হবে। আর এর দায়িত্বে থাকবে একজন ওয়ার্ড সুপারভাইজার। ওয়ার্ড সুপারভাইজার আঞ্চলিক কীটতত্ত্ববিদকে রিপোর্ট করবেন।

. ক্লিনার: প্রতিটি ব্লকে একজন করে ক্লিনার থাকবে। ক্লিনারের কাজ হচ্ছে আটকে যাওয়া ড্রেন, ডোবা, নর্দমার পানি প্রবাহিত রাখা। কারণ আবদ্ধ পানিতে মশা জন্ম হয়। পাশাপাশি তার ব্লকের বিভিন্ন স্থানে পড়ে থাকা পাত্র যেখানে এডিস মশা জন্মানোর আশঙ্কা আছে সেগুলো পরিষ্কার রাখা।

কাজগুলো বাস্তবায়নের জন্য অভিজ্ঞ কীটতত্ত্ববিদ দিয়ে আধুনিক এবং সময় উপযোগী গাইডলাইন তৈরি করে নিতে হবে। মশা নিয়ন্ত্রণের আধুনিক সরঞ্জামাদি এবং আধুনিক কীটনাশক নির্দেশিকা গাইডলাইনে থাকবে।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সারা দেশের মশা এবং অন্যান্য বাহক নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি স্বতন্ত্র সেন্টার তৈরি করতে পারে। যেটির নাম হতে পারে বাংলাদেশ ভেক্টর কন্ট্রোল রিসার্চ সেন্টার। সেন্টারের মাধ্যমে সারা বাংলাদেশের মশা এবং অন্যান্য বাহক নিয়ন্ত্রণ হতে পারে। সেন্টারটিতে সারা বছর মশা, অন্যান্য বাহক কীটনাশক নিয়ে গবেষণা হবে এবং তারাই নির্দেশনা দেবে কখন কোন কীটনাশক কোন বাহকের জন্য ব্যবহৃত হবে। বাহকের আচরণ এবং নতুন নতুন বাহকের ক্ষেত্রে কী ধরনের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে সেটির দায়িত্ব তাদের ওপর থাকবে। সেন্টারে অভিজ্ঞ কীটতত্ত্ববিদ নিয়োগ দিতে হবে। সেন্টার দেশব্যাপী মশা অন্যান্য বাহক নিয়ন্ত্রণের অভিভাবক হিসেবে কাজ করবে। প্রতিষ্ঠান অভিজ্ঞ কীটতত্ত্ববিদদের মাধ্যমে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন সেক্টরের জনপ্রতিনিধি কর্মকর্তাদের বাহকের আচরণ, প্রজনন এবং নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সম্পর্কে ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ প্রদান করবে। পাশাপাশি মশা নিয়ন্ত্রণের আধুনিক সরঞ্জাম কীটনাশক সরবরাহ করবে।

আইন প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন: পৃথিবীতে কোনো নাগরিকের সম্পৃক্ততা ছাড়া মশা নিয়ন্ত্রণ করা কখনই সম্ভব নয়। নাগরিকদের মশা নিয়ন্ত্রণে সম্পৃক্ত করার জন্য পৃথিবীতে বিভিন্ন দেশে আইন রয়েছে। সে রকম একটি আইন বাংলাদেশে তৈরি করে তার বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। কোনো ব্যক্তি যেন তার নিজ জায়গায় মশার প্রজননক্ষেত্র তৈরি করে অন্যের ক্ষতি করতে না পারে তা রোধ করাই আইনের উদ্দেশ্য।

মশা নিয়ন্ত্রণে কীটনাশকের পর্যাপ্ততা: মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত কীটনাশক জনগণের হাতের নাগালে আনতে হবে। তেলাপোকা ইঁদুর মারার কীটনাশকের মতো মশা নিয়ন্ত্রণের কীটনাশক মানুষের কাছে সহজলভ্য হতে হবে। যেন মানুষ সহজেই কীটনাশক কিনে তার বাড়ি এবং আশপাশে ব্যবহার করতে পারে।

কীটনাশক রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া সহজীকরণ: আমাদের দেশে একটি কীটনাশক বাজারজাত করতে গেলে যে রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া রয়েছে সেটিতে দীর্ঘসূত্রতা দেখা যায়। একটি কীটনাশক রেজিস্ট্রেশনের জন্য আবেদন করার পরে সর্বোচ্চ তিন মাসের মধ্যে রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা প্রয়োজন।

যেহেতু সিটি করপোরেশনগুলোতে কীটতত্ত্ববিদের পদ রয়েছে তাই অতিসত্বর অভিজ্ঞ কীটতত্ত্ববিদদের দিয়ে পদগুলো পূরণ করা প্রয়োজন। মশা নিয়ন্ত্রণ যেহেতু একটি চ্যালেঞ্জ। তাই এটিকে সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে আলাদা করে স্বতন্ত্র মশা নিয়ন্ত্রণ বিভাগ করা যেতে পারে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের প্রতিটি জোনে একজন করে কীটতত্ত্ববিদের পদ সৃষ্টি করা প্রয়োজন।

প্রতিটি জেলায় জেলা কীটতত্ত্ববিদের একটি পদ রয়েছে। কোনো কোনো  জেলায় পদে কর্মকর্তা থাকলেও ফাঁকা থাকা পদগুলো পূরণ করে মশা নিয়ন্ত্রণকাজ জোরদার করা প্রয়োজন।

লেখক: কীটতত্ত্ববিদ; অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন