সৌরভ চৌধুরীর খোদাইকর্মে মহাকাল ও শাশ্বত বাংলার চিত্র

আলম খোরশেদ

সম্প্রতি তরুণ দৃশ্যশিল্পী সৌরভ চৌধুরীর পঞ্চম একক প্রদর্শনী Eternal Existence অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ঢাকা আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের লা গ্যালারিতে। এটি ছিল মূলত ছাপচিত্রের প্রদর্শনী, ইংরেজিতে যাকে এচিং বলা হয়ে থাকে। তবে সৌরভ এক্ষেত্রে গতানুগতিক এচিংয়ের পরিবর্তে অ্যাকুয়াটিন্ট পদ্ধতি অবলম্বন করেন, যেখানে মোমের পরিবর্তে এক বিশেষ ধরনের অ্যাসিড প্রতিরোধী রেজিন ব্যবহার করা হয়। এতে তার ছাপচিত্রে এক নতুন মাত্রা যুক্ত হয় এবং সেগুলো অনেকটাই জলরঙের চরিত্র ধারণ করে। সৌরভের চিত্রকর্মের বিষয় ও আঙ্গিকের কারণে সেই বাড়তি প্রচ্ছায়া কিংবা প্রগাঢ়তাটুকুর দরকারও ছিল খুব। কেননা তার চিত্রগুলোর মূল উপজীব্য ছিল বাংলার অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্য, তার বিচিত্র প্রকৃতি, লোকজীবনের বিবিধ অনুষঙ্গ, তার উপকথা, কিংবদন্তি ইত্যাদি মিলিয়ে পুরো বাংলার চালচিত্রটুকু। এবং তার চিত্রকর্মের পরিসরও ছিল বেশ বৃহদায়তন, যার পুরো পশ্চাদভূমিটুকুই তিনি খোদাই করে ভরিয়ে দিয়েছিলেন অজস্র আকর্ষণীয় উপাদানে। অবশ্য প্রদর্শনীর সব কাজই যে এচিং অ্যাকুয়াটিন্টের ছাপচিত্র ছিল তা নয়, তাতে কয়েকটি উডকাট ও লিথোগ্রাফির কাজও ছিল। পাশাপাশি কয়েকটি ত্রিমাত্রিক শিল্প তথা ভাস্কর্য, ধাতু ও সিরামিকের তৈরি; কয়েকটি মিশ্র মাধ্যমের কাজ; এমনকি একটি অ্যালুমিনিয়ামের কাইনেটিক তথা গতিশীল শিল্পকর্মও অন্তর্ভুক্ত ছিল।

কারিগরি দিক থেকে সৌরভের শিল্পকর্মগুলো এককথায় নিখুঁত ও বিশুদ্ধ শিল্পের দৃষ্টান্ত হলেও এ প্রদর্শনীর আসল গুরুত্ব নিহিত তার শিল্পচিন্তা ও জীবনবীক্ষার গভীরতায়। সৌরভ তার জীবন ও অস্তিত্বকে একদিকে যেমন নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য, শেকড় ও সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে নিবদ্ধ ভাবেন, তেমনি নিজেকে বৃহৎ বিশ্বের অপরাপর সভ্যতার মানুষ, পুরাণ ও প্রকৃতির পরিপূর্ণ উত্তরসূরি হিসেবেও স্বীকার করেন। তাই তার কাজে ও কল্পনায় মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় একদিকে বাংলার রূপকথার জগৎ, ঠাকুরদার ঝুলির গল্পের পৃথিবী, গ্রামীণ কিস্সাকাহিনী আর অন্যদিকে পারস্যের বীরগাথা, আরব্য রজনীর গল্প, মিসরীয় পুরাণ, মেসোপটেমিয়ার নিসর্গচিত্র। এ স্থানিকতা ও বৈশ্বিকতার মেলবন্ধনের মধ্য দিয়ে সৌরভ তার যে শিল্পীসত্তাকে নির্মাণ করেন সেটি বাংলার হয়েও বিশ্বের, সেটি বর্তমানের হয়েও অতীতের অম্লরসে জারিত এবং ভবিষ্যতের স্বপ্নকল্পনায় সমৃদ্ধ।

বস্তুত সৌরভের পুরো প্রদর্শনীটির ভেতর দিয়ে একবার এক নিবিষ্ট ও নিবিড় পর্যটন সেরে আসা গেলে মনে হবে বুঝি দূর অতীতের ঊষালগ্ন থেকে মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশের পথ বেয়ে আমরা অবশেষে চিরায়ত বাংলার শাশ্বত অস্তিত্বের অংশভাক হয়ে উঠলাম। কী নেই সতত কৌতূহলী ও কল্পনাপ্রবণ শিল্পী সৌরভের তিল তিল করে খোদাই করা এই বাংলাবিশ্বের মানচিত্রে? আমাদের ভাষা ও বর্ণমালা; আমাদের নদী ও নৌকো; কৃষিজীবনের যাবতীয় অনুষঙ্গ ও গ্রামীণ গেরস্থালি; প্রাণ ও প্রকৃতি; প্রবাদ, প্রবচন, শ্লোক, ছড়া ও কবিতার মায়াবী জগৎ; অতীতের রাজরাজড়া ও তাদের হাতিঘোড়ার জৌলুস; লক্ষ্মীপ্যাঁচা, কানাবগির ছা, ময়ূরপঙ্খী, সপ্তডিঙা, পালকি ও পুতুল; এমনকি সেই ঢেউখেলানো নান্দনিক নকশার প্রিয় পাঁচ পয়সার মুদ্রাটিও! প্রদর্শনীর এক কোণে একটি অভিনব চিত্রলেখায় আমরা শিল্পীর একটি চমৎকার কথাকে উৎকীর্ণ দেখি: Through my kaleidoscopic artistic journey, I timetravel and discover my eternal existence from time to time.  নিজের শাশ্বত অস্তিত্বকে আবিষ্কার ও আস্বাদন করার লক্ষ্যে তিনি প্রায়ই সময়যানে চড়ে পেছনের দিকে যাত্রা করেন। তার সেই স্বপ্নযাত্রারই একটি বিশদ ও বিস্তৃত দৃশ্যরূপ এ প্রদর্শনী, যার সুবাদে আমরাও সঙ্গী হতে পারি শিল্পীর সেই অসামান্য সময়ভ্রমণের।

সৌরভের কৌতূহল বহুবিধ বিষয়ে। প্রাচীন গুহাচিত্র থেকে শুরু করে মিসরের হায়ারোগ্লিফিক লিপিচিত্র, ভারতীয় পৌরাণিক চিত্রকলা, মোগল মিনিয়েচার, ইউরোপের পরাবাস্তববাদী ছবি সবকিছুর প্রতিই রয়েছে তার নিবিষ্ট মনোযোগ, যার প্রভাবে তার চিত্রকর্মগুলো কোনো একটা নির্দিষ্ট গণ্ডিতে আটকে না থেকে বহুমাত্রিকতায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। দর্শক হিসেবে আমরাও ক্রমে সমৃদ্ধতর হতে থাকি বাংলা ও বিশ্বের নানাবিধ শিল্পঐশ্বর্যের সংস্পর্শে। আঙ্গিকের দিক থেকেও সৌরভ বৈচিত্র্যের অভিসারী। আয়তাকার ও বর্গাকার চিত্রপটের পাশাপাশি তিনি গোলাকার এমনকি কয়েকটি অসম ও বিষমাকৃতি ছবিও নির্মাণ করেন। একটি ছবির চিত্রতল তো বড়সড় একখানি টেপা পুতুলের আদলেই গড়া, যার গাত্রজুড়ে আরো কিছু পুতুল, নৌকা, কুলা, সাপ, পাখি, মাছ, পদ্ম, ব্যাঘ্র, পুষ্প, বৃক্ষ, বাদ্যযন্ত্র ইত্যাকার অসংখ্য লোকজ উপকরণের শিল্পিত উপস্থিতি। এ রকম আরো কয়েকটি উল্লম্ব স্তম্ভাকৃতি চিত্রকর্ম রয়েছে প্রদর্শনীতে যেগুলোকে আসলে একধরনের লোকপুরাণ, ইতিহাসের খেরোখাতা কিংবা মানবসভ্যতার ঠিকুজি হিসেবেই হয়তো আখ্যায়িত করা যায়। আর প্রদর্শনী কক্ষের ঠিক মাঝখানে সিরামিকের তৈরি যে ত্রিমাত্রিক শিল্পকর্মটি রয়েছে, তাতে দেখা যায় একটি শামুক ধীরে ধীরে ঘোরানো-প্যাঁচানো বন্ধুর ও কষ্টকর পথ পেরিয়ে যখন একপর্যায়ে চূড়ায় উপনীত হয় তখন তার মাথায় এসে বসে শুভ ও সুন্দরের প্রতীক, এক সুদর্শন, ত্রিকালদর্শী প্যাঁচা। পুরো প্রদর্শনীর মর্মবাণীটুকু যেন এই একটি শিল্পকর্মেই সুচারু ও সম্পূর্ণরূপে বিবৃত, বিধৃত হয় সৌরভের সৃজনশীল দূরদর্শিতায়।

সব মিলিয়ে তরুণ সৌরভ চৌধুরী তার এ প্রদর্শনীর মাধ্যমে শিল্পের প্রতি তার যে দরদ ও নিষ্ঠা, নিজস্ব শেকড়ের প্রতি টান ও ভালোবাসা, সর্বোপরি বিশ্বসভ্যতা ও সংস্কৃতির জন্য যে গভীর শ্রদ্ধাবোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন, তা এককথায় অতুলনীয় ও অভাবিতপূর্ব।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন