ব্যতিক্রমী সুলতান

হাসনাত আবদুল হাই

ছবি: বেঙ্গল ফাউন্ডেশন

ব্যতিক্রমী তিনি। সবাই একবাক্যে বলবে, ব্যতিক্রমী মানুষ এবং ব্যতিক্রমী শিল্পী এস এম সুলতান। ইতিহাসে এই-ই তার প্রধান ও অনন্য পরিচয়। একে কেন্দ্র করেই তার যত খ্যাতি আর রহস্যময়তার রটনা। শেষ পর্যন্ত তিনি যে কিংবদন্তির চরিত্র হয়ে যান, সেও এ ব্যতিক্রমী হওয়ার জন্যই। মৃত্যুর পর কিংবদন্তি হয়েছেন অনেকে, সুলতান হয়েছিলেন জীবদ্দশায়। মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে তৈরি হয়েছে মিথ। শিল্পের জগতে জনশ্রুতির পর্ব থেকে পর্বে উত্তরিত হয়ে এমন ঐতিহাসিক চরিত্র হয়ে যাওয়া প্রায় বিরল, অন্তত এ উপমহাদেশে।

সুচারুভাবে পরিকল্পিত তো নয়ই, কাঙ্ক্ষিতও ছিল না তার এ খ্যাতি কিংবা তাকে নিয়ে কৌতূহল। আশৈশব তার বাসনা ছিল নিজের অভিলাষ অনুযায়ী জীবনযাপন আর একমাত্র শখ ছবি আঁকা। প্রথাবিরোধী হয়ে তিনি পেরেছিলেন এ দুই ক্ষেত্রেই নিজের বিচারে সফল হতে, ব্যতিক্রমী জীবনাচার এবং অনন্য ভঙ্গিতে শিল্পচর্চা। প্রথমটির জন্য তিনি একসময় প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছেন রক্ষণশীল সমাজের কাছে, দ্বিতীয়টি তাকে এনে দিয়েছে একই সঙ্গে শিখরস্পর্শী খ্যাতি এবং নেহাত সৌজন্যমূলক স্বীকৃতি। সব মিলিয়ে তিনি হয়েছেন অবিস্মরণীয়, মানুষ ও শিল্পী হিসেবে। এস এম সুলতানের জন্মশতবার্ষিকীতে এ দেশে এবং সীমিত পরিসরে দেশের বাইরেও, এ কারণে তার প্রতি শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা জানানো হবে অকুণ্ঠচিত্তে।

দুই.

শৈশব কেটেছে চিত্রা নদীতীরে শ্যামল সবুজ প্রকৃতির মমতাময় স্নিগ্ধ পরিবেশে। তখনই আঁকতে শিখেছেন মাটিতে নকশা রাজমিস্ত্রি জনকের সিমেন্টে ফিলিগ্রির কাজ করা দেখে। কৈশোরে উপনীত হয়ে বাসনা হয়েছে মহানগর কলকাতায় গিয়ে আর্ট স্কুলে ছবি আঁকার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণে। পরপর তিন বছর আর্ট স্কুলের সব পরীক্ষায় প্রথম হয়েছেন ক্লাসে, পেয়েছেন শিল্প রসিক ও সমালোচক শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর স্নেহশিক্ত পৃষ্ঠপোষকতা। খ্যাতি ও বৈষয়িক সাফল্য তাকে যখন হাতছানি দিচ্ছে, খুব কাছে থেকে, সুলতান সব মোহ থেকে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে পড়লেন অজানা অনিশ্চিতের আহ্বানে সাড়া দিয়ে। তার ধমনীর রক্তে যে ছিল সংসার বিবাগীর কলধ্বনি, তা-ই তাকে নিয়ে গেল যাযাবর জীবনের পথে-প্রান্তরে। তারুণ্যের শেষে, যৌবনের অভিষেকের আগেই তার জন্য ‘পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি’। রহস্যাবৃত সেই পথ তাকে নিয়ে গেল স্থান থেকে স্থানান্তরে, অচেনা-অজানা মানুষের সাহচর্যের ঠিকানায়। সরলতা আর শিশুসুলভ নির্দোষিতার জন্য অচিরেই হলেন ক্ষণিকের পরিচিত নর-নারীর অতিপ্রিয়। ছবি আঁকার, প্রকৃতি ও মানুষের প্রতিকৃতি সৃষ্টির যে প্রতিভা তার জন্মগত, সেই গুণে আকৃষ্ট হলেন ব্যতিক্রমহীনভাবে সবাই যারা তার সংস্পর্শে এলেন। এলাহাবাদ, দেরাদুন, লখনৌ শহরে নিবিড় আতিথেয়তা লাভের শেষে সব পিছুটান উপেক্ষা করে একসময় পৌঁছলেন ভূস্বর্গ কাশ্মীরে। এক বিদেশিনী আর্ট কালেক্টরের পৃষ্ঠপোষকতায় কিছুদিন কাটিয়ে যখন অকস্মাৎ যুদ্ধ শুরু হলো সদ্য স্বাধীন দুই দেশে, ভাগ্যই তাকে নিয়ে গেল পাঞ্জাবের শিয়ালকোট নামে এক শহরে। সেখান থেকে লাহোর হয়ে পৌঁছলেন আরব সাগরতীরে, করাচি শহরে। সেখানে থিতু হলেন ক্যাসিনো নামের এক হোটেলে, যে স্থান অচিরেই হয়ে উঠল শিল্পী, সাহিত্যিক, গায়ক এমনকি দার্শনিকদের প্রিয় চারণভূমি। সুলতানের বোহেমিয়ান জীবনদর্শন পূর্ণতা পেল এই কসমোপলিটান শহরে সমমনাদের সান্নিধ্যে এসে। জীবিকার জন্য ছবি আঁকতে হয়েছে তাকে পথে-প্রবাসে, যার জন্য জন্মগতভাবে পাওয়া শিল্পসৃষ্টির গুণের ব্যবহার থেকে কখনই বিচ্ছিন্ন হননি তিনি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার রক্ষাকবচ ছাড়াই শিল্পীর পরিচয়ে পরিচিত হলেন তিনি সহজাত প্রতিভার জন্য, যখন যেখানে থেকেছেন, সব জায়গায়। শিল্পের কাছে তার দায়বদ্ধতা এভাবেই অক্ষুণ্ন রেখেছেন তিনি, খুব সচেতন না হয়েও। এর মধ্যে এক আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে হলো তাকে তার সাবেক পৃষ্ঠপোষক শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর আগ্রহাতিশয্যে। এ সুবাদে দেখা হলো আমেরিকা, ইউরোপের কিছু চিত্রশালা। যাদের শুধু নাম শুনেছেন আর বইতে ছবি দেখেছেন এতদিন, সেসব বিখ্যাত শিল্পীর ছবির অরিজিনাল দেখলেন, কিছুটা বুঝিবা প্রভাবান্বিতও হলেন নিজের মনের সঙ্গে মিলে যাওয়ায়। পিকাসো, মাতিস এসব খ্যাতনামা শিল্পীর সঙ্গে তার ছবিও প্রদর্শিত হলো লন্ডনে। কিন্তু খ্যাতি আর জনপ্রিয়তা তাকে বেঁধে রাখতে পারল না বিদেশের মাটিতে। তিনি ফিরে এলেন করাচি, আবার জমজমাট হয়ে উঠল হোটেল ক্যাসিনোর বোহেমিয়ান জীবন। এক নেশাড়ুর কথায় অতীন্দ্রিয় লোকের মায়াবী আকর্ষণে তিনিও নেশাগ্রস্ত হলেন মাঝে মাঝে, যে সংবেদী অভ্যাস থেকে তার বের হয়ে আসা সম্ভব হলো না দীর্ঘদিন। তারপর একদিন, কলকাতা ত্যাগের প্রায় নয় বছর পর, মাটির ডাকে ফিরে এলেন পূর্ববঙ্গে। কিন্তু ঢাকায় তার বোহেমিয়ান জীবনযাপন দেখে আশ্রয় দিলেন না কেউ, তিনি সেখানে থাকার জন্য লালায়িতও ছিলেন না তেমন। চিত্রা নদীর তীরে ফিরে গেলেন শেকড়ের সন্ধানে। সেই শেকড়ই তাকে আশ্রয় দিল, তিনি পেলেন নিজের মতো করে প্রকৃতি, পশু-পাখি আর শিশুদের সাহচর্যে বেঁচে থাকার অবলম্বন। সেই সঙ্গে আবিষ্কার করলেন তার শিল্পীসত্তা। তার ব্যতিক্রমী বোহেমিয়ান জীবনের জন্য যে নিন্দা ও উপেক্ষা জুটেছিল স্বদেশে আসার পর, তার শিল্পকর্মের বিশালতা এবং অনন্যসাধারণ বৈশিষ্ট্য তাকে নিয়ে এল আলোচনার কেন্দ্রে। ব্যতিক্রমী জীবনযাপনের যে ঔদাসীন্য ও উপেক্ষা, তাকে অতিক্রম করে গেল তার ব্যতিক্রমী শিল্পকর্মের প্রশংসা ও খ্যাতি। ধীরে হলেও স্বীকৃতি পেলেন তিনি। কী ছিল তার সেই ব্যতিক্রমী শিল্প?

 তিন.

পোর্ট্রেট আঁকায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন সুলতান। ছেলেবেলায় নড়াইলে স্কুলে পড়ার সময় শ্যামাপ্রসাদের প্রতিকৃতি এঁকে তাকে অবাক ও চমৎকৃত করেছিলেন। এন্ট্রান্স পাস করেননি বলে যখন কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হওয়া আটকে গিয়েছিল, সে সময় ম্যাডোনার মূর্তি দেখে প্রতিকৃতি আঁকায় ভর্তিচ্ছু অন্য ছাত্রদের মধ্যে প্রতিযোগিতা পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন অনায়াসে। কলকাতা আর্ট স্কুলের পড়া অসমাপ্ত রেখে ভারত ভ্রমণে বেরিয়ে রাস্তায় বিভিন্ন স্টেশনে গোরা সৈন্যদের পোর্ট্রেট এঁকে যে টাকা পেয়েছেন কখনো তা দিয়ে মিটিয়েছেন পথের খরচ। লখনৌ শহরে এক নওয়াব বাড়ির অতি আদরের অতিথি হয়ে ছিলেন কিছুদিন মেয়েদের পোর্ট্রেট আঁকার বিনিময়ে। কাশ্মীরে যে বিদেশিনী কালেক্টরের জন্য ছবি একেঁছেন, তার সবই ছিল নিসর্গ আর মানুষের ড্রয়িং। লাহোর ও করাচিতে থাকার সময় যেসব ছবি এঁকেছেন, সেসব ছিল বাস্তবঘনিষ্ঠ। অপ্রচলিত ভঙ্গি বা আঙ্গিকের কিছু আঁকেননি সুলতান। সত্তর দশকের আগে আঁকলেও সেসব শিল্পরসিক বা সমালোচক কারো চোখে পড়েনি। কিন্তু নড়াইলে দীর্ঘ অনুপস্থিতির পর ফিরে গিয়ে তিনি গ্রামের মানুষকে দেখলেন নতুন দৃষ্টিতে। শীর্ণ দেহের কৃষক তার চোখে দেখা দিল আদিম মানুষের পেশিবহুল স্বাস্থ্যময়তায়। এমনই সবল ও শক্তিময় তারা যে হঠাৎ দেখলে দানবসদৃশ মনে হয়। ১৯৭৬ সালে শিল্পকলায় তার প্রথম একক প্রদর্শনীর জন্য একের পর এক তৈরি বিশাল ক্যানভাসে অতিমানবসদৃশ কৃষকদের পাশে কৃষাণীদের অবয়বে দেখা গেছে একই পেশিবহুলতা। দর্শক-সমালোচক সেসব অসাধারণ মানুষের অবিশ্বাস্য ফিগার দেখে অবাক হয়ে ভেবেছে, এরা কোন দেশের, কোন সময়ের?

শুধু ফিগারের অনন্যতা নয়, প্রচল থেকে ভিন্ন পাসপেক্টিভের ব্যবহার এবং একই ধরনের রঙের প্র‍য়োগে বৈপরীত্যের পরিবর্তে অভিন্নতার সৃষ্টি তার ছবিকে করেছে ব্যতিক্রমী। বিশাল ক্যানভাসে কোথাও স্পেস শূন্য না রেখে যে ডিটেইলের উপস্থাপনা তাও মনে হয়েছে অস্বাভাবিক। ক্যানভাস হিসেবে চটের ব্যবহার এবং ভেষজ উপাদান থেকে বিভিন্ন রঙ তৈরি করে ছবিতে ব্যবহারের জন্যও তিনি চিহ্নিত হয়েছেন ভিন্নধর্মী শিল্পী হিসেবে। কোনো কোনো ছবিতে ফিগারের অংশ স্টাইলাইজড হওয়ার কারণে অনেকে মনে করেছেন, তিনি ড্রয়িংয়ের ব্যাকরণ জানেন না এবং এ নিয়ে তাকে উপহাসও করা হয়েছে। যিনি কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তির সময় ড্রয়িং এঁকে প্রথম হয়েছিলেন, তারপর ক্রমাগত তিন বছর ক্লাসে প্রথম হয়েছেন, তিনি ড্রয়িং জানেন না, এ কথা শুধু হাস্যকর নয়, সংকীর্ণতারও পরিচায়ক। যা-ই হোক, অন্তিমে নয়, একক প্রদর্শনীর সঙ্গে সঙ্গে সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকে এস এম সুলতান শুধু বাংলাদেশের নয়, এ উপমহাদেশের অন্যতম প্রধান শিল্পী হিসেবে গণ্য ও খ্যাত হলেন। তার এ স্বীকৃতি ও খ্যাতির পেছনে ছিল তাঁর ব্যতিক্রমী শিল্প।

সুলতান কি ব্যতিক্রমী ছবি এঁকেছেন চমক দেয়ার জন্য? এ অপ্রচলিত আঙ্গিকের ছবি কি ছিল ইংরেজিতে যাকে বলে গিমিক? না, সরল মনের মানুষ সুলতান তা করতে পারেন না। পেশিবহুল মানব-মানবীর ফিগার এঁকে তিনি প্রকাশ করেছেন তার জীবনবীক্ষা। তিনি বলতে চেয়েছেন, যারা উদয়াস্ত পরিশ্রম করে ঘরে আর বাইরে, তারা হীনবল হতে পারে না, তাদের শরীর জীর্ণ-শীর্ণ দেখাতে পারে না। তার দৃষ্টিতে তারা যেমন, সেভাবেই তাদের দেখানো হয়েছে ক্যানভাসে। আবার এমনও হতে পারে, দীর্ঘ অনুপস্থিতির পর জন্মস্থান, শেকড়ের ঠিকানা নড়াইলে এসে ভগ্নস্বাস্থ্য, হীনবল কৃষকদের দেখে তিনি চমকে উঠেছেন, ভেবেছেন যারা রোদে-বৃষ্টিতে উদয়াস্ত কাজ করে অন্যের মুখের অন্ন জোগায় তারা কেন দুর্বল, স্বাস্থ্যহীন হবে? তাদের তিনি কল্পনা করেছেন অফুরন্ত শক্তির আধার হিসেবে, আদর্শ দেহাবয়বের অধিকারীরূপে। দেখিয়েছেন তাদের সুখী, তৃপ্ত মুখ, সম্পন্ন গৃহস্থালি। এভাবে তৈরি হয়েছে তার বিশাল সব ক্যানভাস, যা তাকে ব্যতিক্রমী শিল্পী করেছে।

ব্যতিক্রমী জীবনের চর্চা করে এবং ব্যতিক্রমী শিল্পের স্রষ্টা হয়ে এস এম সুলতান চিরঞ্জীব হয়ে থাকবেন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন