সুলতানের মানুষ ও সম্পর্কশাস্ত্র

ওয়াহিদ সুজন

এস এম সুলতান, হত্যাযজ্ঞ, তেলরঙ, ১৯৮৬ ছবি: বেঙ্গল ফাউন্ডেশন

‘সুলতানের প্রথম যে জিনিসটা, সেই বিস্ময়কর ব্যাপারটা হচ্ছে, এই যে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের জীবনের সম্পর্ক এবং একটা কসমোলজি, এইটা আবিষ্কার করা, এইটা ফিল করা। এটা খুব আশ্চর্যের ব্যাপার’—নাসির আলী মামুনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ১৯৯৮ সালে এ কথাগুলো বলেছিলেন আহমদ ছফা।

টুকরো আকারে কথাটা সামনে আসায়, এটা স্পষ্ট হয় না যে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক আবিষ্কার ও অনুভব করা কেন আশ্চর্যের ব্যাপার। অন্তত এস এম সুলতানকে আমরা যেভাবে দেখি। যে শিল্প তিনি করেছেন তা তার যাপন থেকে আলগা কোনো বিষয় নয়। সারা জীবন তিনি যা করেছেন বা এঁকেছেন সেটা এই সম্পর্কশাস্ত্রনির্ভর। এখানে মানুষ প্রকৃতি থেকে উত্থিত। তার অপরাপর বাসনায়ও আছে প্রকৃত সংলগ্নতা। 

প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক ও সংলগ্নতার ধারণা মানুষের ইতিহাসে নানান পর্যায়ে বদলে গেছে। বিশেষ করে প্রকৃতির ওপর মালিকানা আরোপের মাধ্যমে মানুষ তার সভ্যতার ধারণাকে খোলনলচে পাল্টে দিয়েছে, যার সঙ্গে আমাদের চাষাবাদের ইতিহাস জড়িত। কিন্তু বিষয়টি এখানেও থেমে নেই; সামন্তবাদ ও পুঁজিবাদে গিয়ে মানুষের কর্তৃত্ব হয়ে ‍উঠেছে বিধ্বংসী। এস এম সুলতানের ছবিতে এ সম্পর্কের বিবর্তনের একটা পর্যায় পর্যন্ত আমরা দেখি। এরপর তিনি আর যাননি। এমন নয় যে সুলতান একজন দর্শক হিসেবে এ চিত্রকর্মগুলো এঁকেছেন। বরং তার পূর্বানুমান তৈরি হয়েছে দীর্ঘকাল একের পর এক জনপদের মানুষের সঙ্গে মেলামেশা, তাদের পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে। যাকে একজন সাধকের বিশ্ববীক্ষা বলা যায়। সুলতানের নানা সময়ের কথোপকথন সেই সাক্ষ্য দেয়। তবে বড় সাক্ষী হলো তার চিত্রকলা। যেখানে মানুষকে পরম মমতায় স্থান দিয়েছেন তিনি। তাদের বাইরের দিক নয়, অন্তরের শক্তিকে ছবিতে ফুটিয়ে তুলেছেন। শক্তির এই স্ফুরণ সরল ও প্রাকৃতিক।

আমাদের দর্শনে প্রকৃতি ও পুরুষের ধারণা খুবই ভাইটাল। তাদের বাহ্যিক রূপ বা ভেদজ্ঞানবিশিষ্ট বিবেচিত হলেও সম্পর্কের হারানো সূত্রে গুরুত্বের সঙ্গে জোর দেয়া হয়, যা মানুষের জীবনের লক্ষ্য ঠিক করে দেয়। সুলতানের বিখ্যাত ‘প্রথম বৃক্ষরোপণ’ শিরোনামের যে ছবি, সেখানে বাংলার গড়পড়তার মানুষের সঙ্গে শক্তিমান যে অবয়ব, সেখানে শক্তিমান্যতাকে প্রকৃতির লালন-পালনের সঙ্গে যুক্ত করেছেন। শক্তিমান নারীরা যুক্ত হয়েছে জল নিয়ে। আজকের বৈশ্বিক উষ্ণতা বা দুনিয়াব্যাপী দুর্যোগের সে পরিস্থিতি তাতে এ লালন-পালন অনুপস্থিত। এখানে শক্তি আপতিক কোনো ধারণা নয়, মানুষ আসলে প্রকৃতিতে এভাবে উপস্থিত।

সুলতান যে গল্প বলতে চান বা যে বিশ্বতত্ত্ব নিয়ে হাজির হন, তার সঙ্গে ক্যানভাসের আকারের সম্পর্ক তো আমরা বুঝতে পারি। এটা তার দর্শনগত হাজিরা। বড় করে দেখানোর মাধ্যমে বড় চিন্তাকে হাজির করেন। একই সঙ্গে বেশির ভাগ ছবি বিষয়বস্তুতে কোনো চরিত্রে নির্দিষ্টতা আরোপ করেননি তিনি। এই যে মানুষের বিবর্তন বা হত্যাযজ্ঞ এমন সব চিত্রের মধ্যে মানুষের কাজ বা পরিপ্রেক্ষিত স্পষ্ট করে তুলেছেন। তার আবহও স্পষ্ট। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক কীভাবে মালিকানায় বিবর্ধিত হয়েছে সে প্রশ্নটা তার ছবিতে আছে। 

বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিকে তিনি ডিটেইলস আকারে উপস্থাপন করেছেন এবং এ চিত্রকর্মগুলো আজ এলিট গ্যালারিতে স্থান পেলেও লক্ষ্য ছিল গ্রামের মানুষ। সুলতান মনে করতেন, ক্ষমতার পালাবদল, যুদ্ধ-বিগ্রহ সত্ত্বেও এ মানুষগুলো তাদের ক্ষমতা হাতে পায়নি। তাদের সঙ্গে যোগাযোগের দিক থেকে উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে আছে চর দখলের ছবিগুলো। এ ধরনের ছবির ক্ষেত্রে খুব বেশি বিমূর্ত না হয়েও গল্পটা অনুধাবন করা যায়। চর দখলের মাঝে প্রাণঘাতী, ক্ষেত্রবিশেষে আত্মঘাতী বিষয় তো আছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো ভূমির মালিকানার মাধ্যমে মানুষ যে সভ্যতাকে পুরো পাল্টে দিচ্ছে, তার একটা বয়ান। চাষাবাদ তার ছবির বিষয় হয়েছে বারবার। কথা হলো ভূমির মালিকানা কার? ন্যায্যতার ভিত্তিতে সেটা এখনো আমরা সুরাহা করতে পারিনি।  

কৃষকদের শোষণের ওপর ভিত্তি করে ঐতিহ্যগত ‘‌সামন্ত’ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে এ ভূখণ্ডে। জমিদারি প্রথা বিলোপের মাধ্যমে এর পরিবর্তন ঘটলেও চাষীর হাতে জমির মালিকানা যায়নি, বরং বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ইতিহাসে এর একটি বিকৃত রূপ আমরা দেখছি। রাষ্ট্র বদল হলেও সামন্ত মনোভঙ্গি আজও বিদ্যমান। দেশ স্বাধীন হলেও প্রান্তিক মানুষ তার প্রাপ্য বুঝে পায়নি। সেই মানুষকে সামগ্রিক উন্নয়নের ল্যান্ডস্কেপের বিপরীতে স্থাপন করেছেন সুলতান। তুলে ধরেছেন গ্রামীণ সমাজের অর্থনীতি। সেখানে স্বাধীনতা ও অধিকারের ধারণাগুলো বিমূর্ত হওয়ার সুযোগ নেই। কথার কোনো আড়াল নেই। সম্পদের ধারণাও স্পষ্ট। মুক্তিযুদ্ধে যে কৃষক, তাঁতি বা অন্য পেশাজীবীরা সবচেয়ে বেশি প্রাণ দিয়েছেন তাদের অধিকার ও মালিকানা প্রতিষ্ঠার। 

সুলতানের বিদ্রোহের দৃশ্য খুবই প্রিমেটিভ হতে পারে, কিন্তু তিনি মানুষের আদি লড়াইটা তুলে ধরেছেন। জমি পুনরুদ্ধারের লড়াই, যেখানে তলোয়ার ও বর্শা নিয়ে প্রতিরোধ করেছেন কৃষকরা। শত শত বছরের শোষণেও তাদের অদম্য শক্তির ক্ষয় হয়নি। যুদ্ধ দৃশ্যে প্রতীকীভাবে জনগণের শক্তিকে তুলে ধরেছেন। অদ্ভুতভাবে এসব দৃশ্যে পুরাণের তেমন কোনো রেফারেন্স নেই। সাধারণত এ ধরনের প্রতীক ব্যঞ্জনা আমরা খুঁজে থাকি। যেমন পাই ‘প্রথম বৃক্ষরোপণ’ ছবিতে। বরং বাস্তব অবস্থাকে রূপায়ণের মাধ্যমে বিদ্রোহ, মালিকানা ও অধিকারের ধারণা সুস্পষ্ট করেন তিনি। সুলতান বসবাসের জন্য গ্রাম বেছে নিয়েছিলেন। সঙ্গে সেই মানুষকে অধিকারের ধারণা দিতে চেয়েছিলেন। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও।  

প্রাণ, প্রতিবেশগত সম্পর্কের নিরিখে পুঁজিপতি ও বুর্জোয়ারা প্রকৃতিকে একইভাবে দেখেন না, যেখানে উৎপাদনের সঙ্গে উৎপাটনের ধারণা যুক্ত। এ কারণে আধুনিকতাবাদী ধারণার বিপরীতে যেতে হয়েছে সুলতানকে। দুনিয়া ঘোরার অভ্যাস তাকে এই তুলনার সক্ষমতা দিয়েছে। সুলতানের কৃষকের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক প্রতিপালনের, পারস্পরিক নির্ভরতার। গ্রামের দুপুর, জমি কর্ষণ, জমি কর্ষণে যাত্রা, ধান মাড়াই, অবসর সময়ে, পানি ভরা বা আমার গ্রাম—এ চিত্রকর্মগুলো সাধারণ গ্রামীণ পরিবেশ তুলে ধরলেও সেখানে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কটা স্পষ্ট হওয়া যায়। এখানে জন্ম-মৃত্যু. হাসি-কান্না, ভালোবাসা-নিষ্ঠুরতা প্রকৃতির অংশ। সুলতান পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরে নিম্নবর্গের বিদ্রোহকে ভাষা দিয়েছেন। এ বিদ্রোহের সঙ্গে তার সম্পর্ক শুধু মালিকানা ও ভোগদখলের নয়, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের বণ্টন ও একাত্মের সম্পর্ক। এভাবেও হয়তো খানিকটা পড়া যায় এস এম সুলতানকে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন