প্রদর্শনী

ত্রম্প ল’ওই: ফারিহা আলমের নবধারার চিত্রকলা

আলম খোরশেদ

ফরাসি ভাষায় Trompe L’oeil বা ত্রম্প ল’ওই বলে একটি শব্দবন্ধ রয়েছে, যার আক্ষরিক অর্থ চক্ষুপতন। চোখ তথা দৃষ্টি যখন কোনো বস্তুর অভিঘাতে পতিত কিংবা প্রতারিত হয়, সেই মুহূর্তের অভিজ্ঞতাটিকে তখন এ শব্দবন্ধ দ্বারা বর্ণনা করা হয়। দৃশ্যশিল্প, বিশেষত চিত্রকলার ক্ষেতেই এর প্রয়োগ লক্ষ করা যায় সবচেয়ে বেশি, যাকে আশ্রয় করে বিশেষ এক ধরন কিংবা ঘরানার চিত্রশিল্পের জন্ম হয়েছে। এ ধারার সবচেয়ে বিখ্যাত শিল্পী বলাই বাহুল্য হল্যান্ডের এম সি এশার, যিনি পরবর্তীকালে বিশ্বময় আরো বহু চিত্রশিল্পীকে অনুপ্রাণিত করেছেন এ বিশেষ আঙ্গিকের জ্যামিতিক, বিভ্রমজাগানিয়া ছবি আঁকায়, যাদের Tesselation artist নামেও প্রায়ই ডাকা হয়। সেই গোত্রেরই কনিষ্ঠতম শিল্পী সম্ভবত চট্টগ্রামের তরুণী ফারিহা আলম, যিনি পেশায় একজন বায়োমেডিকেল প্রকৌশলী, কিন্তু নেশায় নিষ্ঠাবান চিত্রশিল্পী।

এই ফারিহা আলমেরই প্রথম একক চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়ে গেল সম্প্রতি চট্টগ্রামের স্বনামধন্য মৃন্ময় আর্ট গ্যালারিতে। প্রদর্শনীর নামের জন্য তাকে বেশি ভাবতে হয়নি অবশ্য, কেননা তিনি সচরাচর যে ঘরানার ছবি আঁকেন তার প্রধান বৈশিষ্ট্যকে শিরোধার্য করেই তার প্রদর্শনীর নাম রেখেছেন পূর্বোল্লিখিত এ ফরাসি শব্দবন্ধ ত্রম্প ল’ওই। গোটা পঁচিশেক ছবিতে সাজানো এ প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া সব চিত্রকর্মই মূলত সাদা-কালোয় রেখা ও বিন্দুর সমাহারে আঁকা, যা দৃশ্যতই বেশ দুরূহ একটি কাজ। কিন্তু এ দুরূহ কর্মটিই বেশ ধৈর্য ও পারঙ্গমতার সঙ্গে সম্পন্ন করেছেন ফারিহা, যার মধ্য দিয়ে তিনি একদিকে যেমন নানা বিচিত্র আকার ও আঙ্গিকের জন্ম দিতে চেয়েছেন, তেমনি অন্যদিকে চেয়েছেন দর্শকের দৃষ্টিতে একধরনের শৈল্পিক বিভ্রম উৎপাদন করতে। সে লক্ষ্যে তিনি অনেকটাই সফল হয়েছেন বলা চলে।

প্রদর্শিত ছবিগুলোর অধিকাংশই মূলত বিন্দু, রেখা ও আকারের অনুশীলন হলেও এর মধ্য দিয়ে তিনি বস্তুর গঠন, বিন্যাস ও রূপান্তরের প্রক্রিয়াটিকে উপস্থাপনের প্রয়াস পেয়েছেন। এ ধরনের চিত্রকর্মের প্রধান যে উপকরণ: জ্যামিতিক আকার ও বিন্যাস, তার প্রয়োগে তিনি বেশ সিদ্ধহস্ত বোঝা গেল, বিশেষ করে ত্রিভুজ ও বৃত্তের বেলায়। তবে সেসবকে ছাপিয়ে তার যে দক্ষতাটুকু আমাদের দৃষ্টিতে ও চেতনায় অভিঘাত তুলতে সক্ষম হয়, সেটি তরঙ্গসদৃশ, আলুলায়িত রেখাগুলোর সাবলীল গতি ও ছন্দটুকু। প্রায় প্রতিটি চিত্রকর্মেই এ তরঙ্গায়িত রেখারা স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে, সামুদ্রিক ঢেউয়ের উল্লাসে বয়ে যেতে যেতে এমন সব আকৃতি ও বিভঙ্গের জন্ম দেয়, যা দর্শককে এর অন্তরালের আখ্যানটিকে আবিষ্কারের ভাবনায় উদ্বুদ্ধ করে। সবসময় যে সে রকম কোনো আকার কিংবা আখ্যান তার আড়ালে লুক্কায়িত থাকে তা হয়তো নয়, কিন্তু দর্শককে যে ছবিগুলো সহজেই আকৃষ্ট ও সম্পৃক্ত করতে পারছে তাদের সঙ্গে এবং কিছুটা হলেও ভাবাতে পারছে সেটাই শিল্পীর সবচেয়ে বড় সার্থকতা।

তবে সত্যের খাতিরে বলতেই হয়, প্রদর্শনীর নামকরণের সার্থকতা প্রমাণে শিল্পী এম. সি. এশারসুলভ প্রকৃত দৃষ্টিবিভ্রমের চিত্রমালার বিশেষ উপস্থিতি ছিল না এখানে। গোটা তিনেক ছবিতে কেবল এ রকম কিছু একটার আভাস পাওয়া গেছে। এর মধ্যে অন্যতম একটি ছবিতে লক্ষ করা যায় প্রজাপতির একটি পাখা অটুট, কিন্তু অন্যটি যেন অনেকটা দালির সেই ঘড়ির মতোই গলে পড়ে গিয়ে নতুন এক গতিময় আকার ধারণ করছে, আর তার শিরদাঁড়াটির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জন্ম নিচ্ছে একটি সুঠাম জ্যামিতিক রূপবন্ধ। এ রকমই আরেকটি ছবিতে দেখতে পাই, একটি কৃষ্ণকায় অর্ধবৃত্তের সম্মুখে অসংখ্য জট পাকানো, পরস্পরলিপ্ত আলুলায়িত রেখার সমাহার, যার আপাত জ্যামিতিকতাকে ছাপিয়ে ধীরে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে আলিঙ্গনাবদ্ধ এক যুগলের ছবি, যা নিঃসন্দেহে এ প্রদর্শনীর একটি উল্লেখযোগ্য চিত্রকর্ম। অন্য ছবিতে লক্ষ করি, শিল্পীর নিজের শেষ নামের আদ্যক্ষর, ইংরেজি বর্ণমালার প্রথম বর্ণ আ-এর বুদ্ধিদীপ্ত বিন্যাস ও বিভাজনের মধ্য দিয়ে একটি মনুষ্য মুখমণ্ডলের আভাস ফুটে উঠছে, আর তার মস্তক ফুঁড়ে অঙ্কুরিত হচ্ছে পত্র ও পুষ্পশোভিত এক পরাবাস্তব তরুপল্লব।

এ প্রদর্শনীতে ফারিহার বিগত পাঁচ বছরে আঁকা ছবি স্থান পেয়েছে, যার মধ্যে প্রথম দিককার ছবিতে একধরনের জ্যামিতিক সারল্য ও একমাত্রিকতা লক্ষ করা গেলেও সময়প্রবাহে ক্রমেই তাতে গভীরতা, ঘনবদ্ধতা এবং বহুমাত্রিকতার আভাস পাওয়া যায়, বিশেষ করে এ বছর আঁকা তার কয়েকটি ছবিতে রঙের প্রয়োগ, বিবিধ ফর্মের সহাবস্থান ও রেখার ঘনত্ব তাতে নতুন এক মাত্রা ও মননশীলতা যোগ করে। আমরা আশা করব, ফারিহা তার এ নতুন ধারার শিল্পযাত্রা অব্যাহত রাখবেন, নিষ্ঠা ও ক্রমাগত নিরীক্ষায় তাকে অন্যতর এক উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হবেন, সমকালীন বাংলাদেশী চিত্রকলার জন্য যা হবে এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন