মৃৎশিল্পে জীবনের বয়ান

ওয়াহিদ সুজন

প্রদর্শনীতে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরীর সঙ্গে বিদেশী দর্শনার্থী

সহজিয়া অর্থে ‘মানুষ’ হলো ‘মাটির মানুষ’। সেই মানুষ আবার মাটিকে নানান আকার ও রূপ দেয়। এ বদলকে শুধু বস্তুগত রূপান্তর দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। বরং সেখানে মিলেছে ভাব-কল্পনা ও দক্ষতার মেলবন্ধন। এমন কিছু গল্প সেখানে আছে, যা সচরাচর আমাদের দেখা বা লেখায় ধরা পড়ে না। এ ভাবনা তো বটে, আয়োজকদের উদ্দেশ্য বিচারে বেঙ্গল শিল্পালয়ে চলমান ‘বাংলাদেশের লোকশিল্প: চিত্রিত মৃৎশিল্প’ প্রদর্শনী ঐতিহ্যবাহী শিল্প নিয়ে নানান ভাবনা উসকে দেয়ার মতো কাজ।

বাঙালির উৎসব বলতে চৈত্রসংক্রান্তির রমরমা দিন আর নেই। তাকে হটিয়ে নববর্ষ সর্বব্যাপী স্থান করে নিয়েছে। যেখানে বাঙালিত্বের ধারণা তার যাপনের পাশাপাশি নানান প্রতীকী ব্যঞ্জনা নিয়ে হাজির থাকে। এর মধ্যে টেপা পুতুলের প্রতিকৃতি বা মুখোশ আমাদের সামনে ক্ষয়িষ্ণু কারুশিল্পকে মনে করিয়ে দেয়। আবার বৈশাখী মেলার বিকিকিনির অন্যতম পণ্য হলো মাটির তৈরি বিভিন্ন ধরনের পুতুল। যেখানে মানুষ-প্রাণীর প্রতিকৃতি বা দেব-দেবীর রূপায়ণ থাকে। আবার সমাজের একটি শ্রেণীর উপাসনার উপকরণও বটে। সচরাচর এর ঐতিহ্যিক মূল্য বা বৈচিত্র্য নিয়ে আমরা সচেতন থাকি না। অথচ এটি যেমন-তেমন নির্মাণ নয়। উঁচুতলার শিল্পের মতো স্বজ্ঞান মনের সাড়া রয়েছে। অধরার বসত আছে। দুনিয়াকে দেখার ভঙ্গিও তো রয়েছে, রয়েছে উপাসনা ও প্রার্থনার বসতি।

প্রদর্শনীর গবেষণা ও নির্দেশনাগত দায়িত্ব পালন করেছেন অধ্যাপক নিসার হোসেন। তার মতে, ‘মৃৎশিল্পের পেছনের গল্প বা ভাবনা বাদ দিয়ে আমরা শুধু অবজেক্ট নিয়ে থাকি। এ প্রদর্শনীতে আমরা অবজেক্টের পেছনের গল্প, প্রসেস ও ভাবনা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। তাছাড়া আরো একটি উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে জানানো যে এখনো বাংলাদেশে মৃৎশিল্প চর্চা ও সংগ্রহ অনেক বড় পরিসরে হয়ে থাকে।’

সাধারণভাবেই স্থান ও সময়ের প্রেক্ষাপটে যেকোনো গল্প ও বয়ান পাল্টে যায়। এমনকি আদিকল্পের ধরন খুঁজতে গিয়ে পড়তে হয় বিপত্তিতে। সেদিক থেকে ‘পেছনের গল্প, প্রসেস ও ভাবনা’ যতটা জানা যায়, ততটাই আমরা ঋদ্ধ হই। খোলা চোখে অঞ্চলভিত্তিক সংগ্রহকে আমরা যখন দেখি ঠিক আজকের মতোই ঢাকার গল্পটা চট্টগ্রামের মতো নয়, আবার চট্টগ্রামের গল্পটা বরিশালের নয়। দুটো একই রকমের পুতুলের নির্মাণও এক নয়। এটা শুধু নির্মাণ উপকরণ বা নির্মাতার অভীপ্সা, এমনই নয়। বৃহত্তর জনসমাজ ও জনশ্রুতি, তার আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে যুক্ত। যেমন বাংলাদেশে অতিপরিচিত মাটির পুতুলের মধ্যে রয়েছে বাঘ। এই বাঘ প্রাচীন সমাজের কোথাও কোথাও ভীতিকর স্বভাবের কারণে সমীহ পায়। কিন্তু এ বাঘ অপ্রতিরোধ্য নয়, পীর বা ফকির তার পিঠে চড়ে দুনিয়ার ওপর ছড়ি ঘোরানোর মতো কর্তৃত্বপরায়ণ ছিল। বাঘকে জয়ের মাধ্যমে মানুষ শুধু প্রাণিজগৎ নয়, প্রকৃতির ওপরও কর্তৃত্ব করে। আবার যে জনপদে বাঘ নেই, আছে শুধু তার শক্তির বর্ণনা। হয়তো বাঘ বাঘেরও অতীত। অনির্ণিত এক ভয়ের প্রতীক। তবে শক্তির প্রতীক হিসেবে ধরে নিতে আপত্তি নেই। কিন্তু দুই জনপদেই বাঘের কল্পনা আছে, সেই কল্পনার সঙ্গে মানুষের ভাবের আদান-প্রদান আছে, যা ধরে রাখা হয় মাটির রূপান্তরে। এরা কোন মানুষ? সেই মানুষ যাদের আমরা হাল কেতায় হয়তো পিছিয়ে পড়া মানুষ হিসেবে দেখি। একইভাবে একেক অঞ্চলের নারী-পুরুষকে গড়া একেক রকম ঠেকে। ঘোড়ার মধ্যে তেমন বৈচিত্র্য নেই, সম্ভবত বাংলা অঞ্চলের ঘোড়ার প্রচলন এ অঞ্চলের বাইরে থেকে বলে! আবার হাতির রাজকীয়তা অঞ্চলভেদে পার্থক্য করা যায়।

প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া সরায় পার্থক্যটুকু স্পষ্ট করা যায় দারুণভাবে। যার চমৎকার ব্যাখ্যাও দেন নিসার হোসেন। আমাদের স্থানীয় ও লোকজ ধর্মের অনেক উপাদান পরে বৃহত্তর ধর্মীয় ধারণায় বিশিষ্ট স্থান করে নিয়েছে। সাধারণ গৃহস্থালি ব্যবহার্য ঢাকনা থেকে এ শিল্পকর্মের উদ্ভব। এর ওপর বিভিন্ন ধরনের নকশা বিশিষ্টতা দান করে। অবশ্য একদিক থেকে সর্বজনীনতা বাধাগ্রস্ত হলেও ধর্মীয় যোগ এর শিল্পমূল্য আরো বাড়িয়ে দেয়। যেখানে অঞ্চল ও শিল্পীর পার্থক্যে একই গল্পের রূপায়ণ হয় ভিন্নভাবে। একই দেব-দেবীর সরাকে আমরা ভিন্নভাবে পাই। তাদের চেহারা যেমন আলাদা, দেখানোর ঢঙও আলাদা। আদিকল্প এক হলেও জনপদের বৈষয়িক অবস্থার সঙ্গে সরার আকার, রূপ ও দেব-দেবীর আভিজাত্য পাল্টায়। ‘চিত্রিত মৃৎশিল্প’ প্রদর্শনীতে সরার বিশাল সংগ্রহ সেই পার্থক্য এক জায়গায় দাঁড়িয়ে দেখার সুযোগ করে দেয়। সঙ্গে স্পষ্ট করে, মৃৎশিল্প একসঙ্গে ইতিহাস, অর্থনীতি, মানুষের অধিদৈবিক বাসনা ও তার সঙ্গে একাত্ম হওয়ার প্রয়াস। সেই গল্প আমাদেরই লিখতে হবে। সঙ্গে আফসোসের সুরে বলতে হয়, প্রদর্শনী আরো বিন্যস্ত পরিবেশ ও ব্যাখ্যাসহ উপস্থাপন করা গেলে দর্শনার্থীদের আরো দেখার-জানার সুযোগ করে দিত। এছাড়া এ ধরনের প্রদর্শনে গাইডের অন্তর্ভুক্তি এখন সময়ের দাবি।

পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের মতো বাংলায়ও প্রাচীন পেশাগুলোর অন্যতম মৃৎশিল্প। তবে এ ঐতিহ্য এখনো আমাদের অঞ্চলে যেভাবে টিকে আছে তা অন্য কোথাও আছে কিনা বলা মুশকিল। চাহিদা ও জোগানের নিরিখে একে ‘বিপন্ন’ বলেও চিহ্নিত করছি। প্রয়োজন ও শিল্পের টানাপড়েন স্পষ্ট। এমনকি মাটির ব্যাংকের জায়গায় এসেছে প্লাস্টিকের ব্যাংক। আবার সময়ের সঙ্গে মাটির পুতুলের আধুনিকায়ন ঘটেছে। যেমন আজকাল ব্যবহার হচ্ছে প্লাস্টিক পেইন্ট। এ পরিবর্তন শুধু একটি পেশা আকারে মৃৎশিল্পের বিবর্তন বা পাল্টে যাওয়া বোঝায় না, আমাদের আর্থসামাজিক পরিবর্তন ও উন্নয়নের সূচকও বটে; যে উন্নয়ন গড়ে ওঠে প্রকৃতিবিরুদ্ধ উপকরণ ও ভাবনায়।

শিল্পী কামরুল হাসানের কথায়, ‘হাজার বছরের পুরাতন হলেও সেই শিল্প এবং শিল্পগোষ্ঠীকে বর্তমান অর্থনৈতিক এবং সামাজিক কাঠামোর মধ্যে সমঅধিকার ও মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা গ্রহণের দ্বিতীয় অর্থই হচ্ছে আপনাপন ঐতিহ্যের প্রতি মমত্ব ও শ্রদ্ধাবোধ।’ এ গুরুত্বপূর্ণ কথা নতুন করে এসেছে প্রদর্শনীর আয়োজকদের তরফে। বিষয়টি তত সহজ নয় বলেও উঠে এসেছে আলোচনায়। 

শিল্পমাত্রই জাগ্রত। তাকে নানান দশা অতিক্রম করতে হয়। মৃৎশিল্পেরও জীবন্ত রূপ রয়েছে। চর্চার দিকে জীবন্ত, যেহেতু এর ভাব-কল্পনা ও চেতনা হাজার হাজার বছরের গল্প ও আদিকল্পকে ধারণ করে। আবার অন্যদিকে সংরক্ষণের দিক থেকে এখনো এর মূল্যমান আমরা ঠিক করতে পারিনি। একটি কষ্টিপাথর বা প্রাচীন পাত্র কিংবা ফলকের যে মূল্য তার সঙ্গে বাংলার এই আবহমান পেশা তুল্য হতে পারেনি। বরং শুধু নির্মাণ উপকরণেই নয়, ধারণাগতভাবেও এটি ভঙ্গুর। তৈজসপত্রে আজকাল মাটির ব্যবহার নেই, এর বদলে স্থান করে নিয়েছে ধাতব পাত্র। এর বাইরে ঘর সাজানোর উপকরণ হিসেবে মাটির সামগ্রী ব্যবহৃত হয়। তাও বিলয়মান। ধর্মীয় দিক এর বৃহত্তর অনুষঙ্গ। যেখানে নির্মাণ ও বিসর্জনের ধারণা গুরুত্বপূর্ণ। ফলে বৃষ্টিনির্ভর এই জনপদে শুধু উপাদানগত ভঙ্গুরতা নয়, মৃৎশিল্পের সঙ্গে বিলয় ও বিসর্জনের বিষয় রয়েছে।

জীবন্ত এই কলা হয়তো বিশ্বাস ও ভাবের সাজুয্য ছাড়া বোঝা কঠিন। সেটা সম্ভব না হলেও আমাদের বোঝাপড়ায় দাঁড়াতে পারে নতুন অর্থ। সেদিক সুখের বিষয় হলো, মৃৎশিল্পে ভর করে প্রাগৈতিহাসিক যুগের অনেক সাংস্কৃতিক উপাদান এখনো বিদ্যমান, যা পুরনো দুনিয়াকে চিহ্ন ও গল্পাকারে আমাদের সামনে বয়ান করে। যেভাবে সীমিত পরিসরে হাজির ব্রত, গান, গ্রামীণ খেলা, চৈত্রসংক্রান্তি, খিজিরের ভেলা ভাসানের উৎসব ও অন্যান্য আচার। আমাদের যাপনের বিবর্তনে অনেক চিহ্ন হয়তো অব্যাখ্যাত ও রহস্যময়। কে জানে কোন চিহ্ন কোন মাটিতে আটকে আছে। একদিন কারো সামনে সে ঝাঁপি খুলে বসবে। সেই গল্পটুকু সংরক্ষণ অপরিহার্য।

বাংলাদেশের বেশকিছু জেলার মৃৎশিল্পের নমুনা, সরা, মনসা পূজার বিগ্রহ, তথ্য ও নানান নিদর্শন এ প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে। বেঙ্গলের কামরুল হাসান প্রদর্শনশালা এ প্রদর্শনী রোববার বাদে চলবে ২৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। আয়োজকরা বলছেন, ‘প্রদর্শনীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ঐতিহাসিক মৃৎপাত্র, যা বিভিন্ন ব্যক্তিগত সংগ্রাহকের আনুকূল্যে উপস্থাপন করা সম্ভব হয়েছে। আমরা আশা করছি, এ প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে নানা বর্ণ আকৃতি ও অলংকরণ উজ্জ্বল মৃৎশিল্পের বিপুল বৈচিত্র্য ও শৈলী-ব্যঞ্জনা দর্শকের সামনে তুলে ধরা সম্ভব হবে।’ এ দাবির মধ্যে ভুল নেই। আমরাও আশা করি, এ প্রদর্শনী মৃৎশিল্পকে সংরক্ষণ ও মূল্যায়নে দারুণ এক ঘটনা হয়ে উঠবে।

ছবি: মাসফিকুর সোহান

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন