উদয়পুরের দরবারি চিত্রে জলবায়ু পরিবর্তন

মাহমুদুর রহমান

বর্ষায় নদী পার হচ্ছেন মহারাণা ফতেহ সিং; দ্য সিটি প্যালেস মিউজিয়াম, উদয়পুর

ভারতের উদয়পুর রীতিমতো শুষ্ক অঞ্চল। কিন্তু অষ্টাদশ থেকে বিংশ শতাব্দীর মধ্যে সেখানে এমন কিছু ছবি আঁকা হয়েছে, যা বর্ষাকালকে ধরে রেখেছে। উদয়পুরের এ দরবারি চিত্রগুলো (কোর্ট পেইন্টিং) ভারতের অন্যান্য দরবারি চিত্র থেকে ভিন্ন। একুশ শতকে এসে দেখা গেল ছবিগুলো তার সময়ের পরিবেশ, প্রতিবেশ, রাজদরবারের পাশাপাশি আবহাওয়ার কথাও বলে, এমনকি সবচেয়ে বড় বিষয়, ছবিগুলো জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কেও নির্দেশ করে। উদয়পুর দরবারের এ চিত্রগুলো নিয়ে একটি প্রদর্শনী হয়েছিল স্মিথসোনিয়ান ন্যাশনাল মিউজিয়ামে। এর কিউরেটর ডেবরা ডায়মন্ড ও দীপ্তি খেরা ছবিগুলোর বিশেষত্বের প্রতি আলোকপাত করেছেন।

এ লেখার আলোচ্য বিষয়, অর্থাৎ ছবিতে জলবায়ু পরিবর্তন প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে অষ্টাদশ শতাব্দীর দরবারি চিত্রকলা সম্পর্কে একটু ভূমিকা দেয়া প্রয়োজন। মোগলদের হাতে ভারতে মিনিয়েচার বিকশিত হয়েছিল এবং তা ছড়িয়ে পড়ে রাজস্থানেও। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীর আগ অবধি রাজস্থানের দরবারি চিত্রে রাজা, রাজপরিবার ও রাজকীয় বিষয়াদিই মূল ছিল এবং এক্ষেত্রে চিত্রকররা একটি ছবিতে একটি সাবজেক্টকে গুরুত্ব দিতেন। যেমন কোনো ছবি হয়তো একটা ময়ূরের কিংবা মেঘের। মহারাণা দ্বিতীয় অমর সিং ক্ষমতায় আসার পর তিনি দৃশ্য, ঘটনা ও মানুষকে ছবিতে আনার বিষয়ে জোর দেন। এ সময় থেকে ল্যান্ডস্কেপে ছবি আঁকা শুরু হয় উদয়পুরে। এর মধ্যে বেশকিছু ছবিতে পানি, বৃষ্টি ও বন্যা প্রসঙ্গ এসেছে।

মিউজিয়ামে প্রদর্শনীতে আনা চিত্রগুলো কাগজ ও কাপড়ে আঁকা। ছবিগুলো আকারে বেশ বড়। এ ছবিগুলোর মধ্যে ডেবরা ডায়মন্ড অমর সিংকে উপস্থাপন করা একটি ছবিতে বিশেষ গুরুত্ব দেন। কালো পটে আঁকা ছবিতে দেখা যাচ্ছে, বালক অমর সিং একটি ছাতা নিয়ে খালি পায়ে হেঁটে যাচ্ছেন। সাধারণত রাজাদের এ ধরনের ছবি আঁকা হতো না। তারা নিজেদের শক্তিশালী দেখাতেই পছন্দ করতেন। কিন্তু অমর সিং তা করেননি এবং এরপর বিচিত্র বিষয়ে ছবি আঁকতে তিনি উৎসাহ দিয়েছেন। এর মধ্যে বর্ষা অন্যতম।

দীপ্তি খেরা নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির আর্ট হিস্টোরিয়ান। তিনি জানাচ্ছেন যে ভারতের সাধারণ রীতি অনুসারে বর্ষাকালকে রোমান্টিক হিসেবে দেখা হয়। রাধা-কৃষ্ণের আখ্যানে বর্ষা ছিল অভিসারের কাল। উদয়পুরের দরবারি চিত্রে সে বিষয়টা রেখে পুরো নগরের মানুষের জীবনকেই আনা হয়েছে। আনুমানিক ১৭৩০ খ্রিস্টাব্দের ‘‌দ্য মুড অব শ্রী একলিঙ্গজি টেম্পল’ নগরজীবনের চিত্র তুলে ধরে। এ ধরনের ছবিই যে একসময় বৈজ্ঞানিক গবেষণার বিষয় হবে তা নিশ্চয়ই মহারাণা জানতেন না। 

ছবির পেছনে থাকা বিভিন্ন লিপি ও ছবিতে থাকা শহর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উদয়পুরের বর্ষাকে বোঝার চেষ্টা করা হচ্ছে। জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির জিওগ্রাফির প্রফেসর মার্ক গিওর্দানো উদয়পুরের এ ছবি থেকে বলেছেন, মহারাণার প্রাসাদের আশপাশে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার নানা ব্যবস্থা ছিল। শুষ্ক মৌসুমে সেখান থেকে পানি সংগ্রহ করা হতো। কৃত্রিম লেক ছাড়াও উদয়পুরে ছিল বাঁধ ব্যবস্থা। গিওর্দানোর মতে, ছবিতে বিষয়টি আসার কারণ চিত্রকরও এর গুরুত্ব বুঝেছিলেন। 

উদয়পুরের জলবায়ুতে যে পরিবর্তন এসেছিল তার প্রমাণও পাওয়া যায় একটি ছবিতে। আনুমানিক ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে আঁকা একটি ছবিতে দেখা যায়, মহারাণা ফতেহ সিং তার দলবল নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে নদী পার হচ্ছেন। ছবিতে বর্ষাকাল ও দুর্যোগ স্পষ্ট। উদয়পুরের জলবায়ু নিয়ে কাজ করতে গেলে বিষয়টি গুরুত্ব রাখবে। দীপ্তি এ বিষয়কে সামনে রেখে বলেন, ‘‌বিজ্ঞান ও শিল্প প্রতিযোগী নয়, বরং সহযোগী।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন