৩২টি স্যুপের ক্যান ও পপ আর্ট

এস এম রশিদ

ব্লু মেরিলিন, ডায়মন্ড ডাস্ট সুজ, মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টে ‘ক্যাম্পবেলস স্যুপ ক্যানস’

ষাটের দশকে আমেরিকাকে ভাসিয়ে নিয়েছিল এক নতুন সাংস্কৃতিক ঝড়। পপ আর্ট, সিকাডেলিয়া, বব ডিলান কিংবা আন্ডারগ্রাউন্ড ফিল্ম মেকিং। আর নিউইয়র্কে এর কেন্দ্র ছিল একজন মানুষ—অ্যান্ডি ওয়ারহল। ম্যানহাটনে তার স্টুডিও পরিচিত ছিল ফ্যাক্টরি নামে। অনেকে বলেন, ষাটের দশকের আমেরিকার সাংস্কৃতিক মনোজগৎ ছিল এ ফ্যাক্টরিতে। পপ আর্টের সংজ্ঞা তৈরি করেছিল যে শিল্পকর্মগুলো তা এখানে বসেই তৈরি করেছিলেন ওয়ারহল।

পপ আর্ট আসলে কী? ওয়ারহলের কথায়, ‘‍পপ আর্টিস্টরা সেই সব জিনিসের ছবি তৈরি করেন, যেগুলো ব্রডওয়ে দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষ সেকেন্ডের ভগ্নাংশ সময় দেখলেই চিনতে পারেন—কমিকস, পিকনিক টেবিল, ছেলেদের ট্রাউজার, সেলিব্রিটি, শাওয়ার কার্টেইন, ফ্রিজ, কোকের বোতল। অর্থাৎ সব আধুনিক দুর্দান্ত জিনিসপত্র যেগুলো এক্সপ্রেশনিস্টরা খুব চেষ্টা করেছেন চোখ বন্ধ করে রেখে না দেখতে।’ 

অ্যান্ডি ওয়ারহলের জন্ম ৬ আগস্ট ১৯২৮। তিনি ছিলেন আন্দ্রে ও জুলিয়া ওয়ারহলের তিন ছেলেন কনিষ্ঠজন। তারা বর্তমান স্লোভাকিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসিত হয়েছিলেন। বাবা আন্দ্রে ছিলেন শ্রমিক। মা জুলিয়া অন্য মানুষের ঘরে গিয়ে কাজ করতেন। কাজ না থাকলে ঘুরে ঘুরে পিচ ক্যান দিয়ে তৈরি ডেকোরেটিভ ফুল বিক্রি করতেন। স্কুলে থাকতে ওয়ারহল একটা বেবি ব্রাউনি স্পেশাল ক্যামেরা পেয়েছিলেন। সেটা আর হাত থেকে নামাননি। ভাইয়েরা তাকে একটা ডার্করুম তৈরি করে দিয়েছিলেন। সিনেমার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন। জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন, মানুষকে সিনেমা দেখিয়ে জীবিকা নির্বাহ করবেন। মা জুলিয়া তার নয়দিনের কাজের পারিশ্রমিক ৯ ডলার দিয়ে ছেলেকে একটা প্রজেক্টর কিনে দেন। সেটা দিয়ে অ্যান্ডি তাদের ঘরের দেয়ালে মিকি মাউস কার্টুন দেখাতেন। 

গরিবের সন্তান হলেও শিক্ষার সুযোগ পেয়েছিলেন কার্নেগি ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির মতো বিশিষ্ট আর্ট কলেজে। ১৯৪৯ সালে পাস করে একটা পেপার ব্যাগে নিজের সব জিনিসপত্র ভরে রওনা হন নিউইয়র্কের পথে। অ্যান্ডির বয়স তখন ২০। তার হাতেই বদলে গিয়েছিল নিউইয়র্কের সাংস্কৃতিক দুনিয়া।

পপ আর্ট ঐতিহ্যবাহী চিত্রকলা ও শিল্পে অন্য রূপকে একেবারে ওলটপালট করে দেয়। আসলে তাদের নয়, বরং বলা ভালো শিল্পের ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে বসে। প্রতিকৃতি, প্রকৃতি, যুদ্ধের দৃশ্য কিংবা আরো যতসব ঐতিহ্যবাহী বিষয়কে শিল্প হিসেবে গণ্য করা হতো সেগুলোকে বাদ দিয়ে ওয়ারহলের মতো পপ আর্টিস্টটা আধুনিক সমাজের নিত্যদিনের নানা অনুষঙ্গকে শিল্প করে তুললেন। সুপের ক্যান থেকে সেলিব্রিটির মুখ। ভ্যান গগের আ পেয়ার অব বুটস থেকে ওয়ারহলের ডায়মন্ড ডাস্ট সুজ—রাজনৈতিক বার্তাবহ শিল্পকর্ম থেকে অর্থহীন শিল্প, এমনটাই বলেছেন তাত্ত্বিক ফ্রেডরিখ জেমিসন। ভ্যান গগের চিত্রটি ছিল কৃষকের চিরকালীন দুর্দশার স্মারক। সে অর্থে ওয়ারহলের চিত্রে কোনো বার্তা নেই, আছে কনজিউমার সোসাইটির উত্তুঙ্গ বাসনা, পণ্যের আধিপত্যের নিশানা। আর এটাই ছিল পপ আর্টের দর্শন। কমিক বুক, বিজ্ঞাপনচিত্র, জুতা, স্যুপের ক্যান—সবকিছুই আর্ট। তবে এসবে তারা জুড়ে দিতেন সূক্ষ্ম হিউমার। ওয়ারহল সমাজের জনপ্রিয় স্রোতটিই শিল্পে তুলে আনতে চেয়েছিলেন। আর সেটা কোকা-কোলা, ক্যানের স্যুপ, মেরিলিন মনরোর মতো সেলিব্রিটি কিংবা পোশাককে বাদ রেখে সম্ভব ছিল না। কনজিউমার সমাজের প্রতিবিম্ব পপ আর্ট। ক্যাম্পবেল’স স্যুপ ক্যানস অ্যান্ডির জনপ্রিয় আর্ট ওয়ার্কগুলোর একটি। সে সময়ের আমেরিকার জনপ্রিয় ক্যান স্যুপ ছিল ক্যাম্পবেল’স স্যুপ। অ্যান্ডি প্রতিদিন দুপুরে এটা খেতেন। তার কাজের বিষয়ও হয়ে উঠল এ স্যুপের ক্যান। ৩২টি ক্যানভাসে কোম্পানির ৩২ রকমের স্যুপের ক্যান আঁকলেন তিনি। দুনিয়ার জনপ্রিয় পপ আর্টের একটি নিদর্শন হয়ে আছে স্যুপের ৩২টি ক্যান। এটাই পপ আর্ট।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন