সমাধানের পথ দুটো হয় আলোচনা নয় রাজপথ —ড. আলী রীয়াজ

ড. আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট। ২০১৩ সালে উড্রো উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর স্কলার্সে দায়িত্ব পালন করেন পাবলিক পলিসি স্কলার হিসেবে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে নিয়মিত লিখছেন, কথা বলছেন স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। সম্প্রতি বণিক বার্তাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের রাজনীতির বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোকপাত করেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বদরুল আলম

গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পালাবদলের কালে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সংকট তৈরি হয়। সেই সংকট থেকে দীর্ঘস্থায়ী কোনো সমাধানের রূপরেখা পাওয়া যায় না। এক্ষেত্রে কোনো বিদেশী বন্ধু, মিত্র বা জোটকে প্রভাবক হয়ে ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়। দেশের নিজস্ব সক্ষমতার মাধ্যমে এ সংকট সমাধানের কোনো সম্ভাবনা আছে?

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট সমাধানের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো সংবিধান। সংবিধানের সবচেয়ে বড় সংকট—শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের কোনো ব্যবস্থা বাংলাদেশের সংবিধান তৈরি করতে পারেনি। একটা অস্থায়ী ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছিল, শেষ পর্যন্ত সেটাও বাতিল করে দেয়া হয়েছে। আপনি বিদেশীদের কথা বলছেন, বন্ধু বলুন বা উন্নয়ন সহযোগী বলুন—তারা কখনো কোনো সমাধান দেয়নি। তারা সাহায্য করেছে, চেষ্টা করেছে, শেষ পর্যন্ত সমাধানের পথ বাংলাদেশের মানুষকে তৈরি করতে হয়েছে। এ সমাধান সবসময় সঠিক তা নয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সঠিক হয়নি। সমাধান রাজপথে হয়েছে নাকি আলোচনার মাধ্যমে হয়েছে, সেটা আপনি বিবেচনা করতে পারেন।

 শেষ পর্যন্ত সংকটের সমাধান হয় না, সংকট তৈরি হয়। শুধু তা-ই নয়, গত ৫০ বছরে আমরা প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে পারিনি। প্রতিষ্ঠান তৈরি না করলে সংকট মোকাবেলা করবে কে? ব্যক্তি কখনো সংকট মোকাবেলা করে না। প্রতিষ্ঠান তার শক্তি দিয়ে সংকট মোকাবেলা করে। বাংলাদেশ যখন থেকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে প্রবেশ করেছে, তার পর থেকে প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়নি। 

সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশে এক ব্যক্তির ক্ষমতার অভাবনীয় কাণ্ড ঘটেছে। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ যখন রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থা থেকে প্রধানমন্ত্রী শাসিত ব্যবস্থায় পদার্পণ করল, সবাই অত্যন্ত উৎসাহী হলো, তখন আমি একটা উদ্বেগের কথা বলেছিলাম। সে সময় যে অভাবনীয় ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতের তুলে দেয়া হলো, সেটা সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছে। অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করেছে, আপনি কি সংসদীয় ব্যবস্থা চান না? আমি বললাম, অবশ্যই চাই। আমি রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থার পক্ষের লোক নই। আমি বলেছিলাম, এ অভাবনীয় ক্ষমতা—রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা, দলের ক্ষমতা, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা সব এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত। প্রধানমন্ত্রী শাসিত ব্যবস্থা এবং সংসদীয় ব্যবস্থার মধ্যে একটা সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। এর পর থেকে বাংলাদেশে কোনো প্রতিষ্ঠান দাঁড়াচ্ছে না। কোনো প্রতিষ্ঠান দাঁড়ালে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা সংকুচিত হবে। 

তারপর একটা ভয়াবহ জিনিস ঘটেছিল। বাংলাদেশের মানুষ আশা করেছিল ২০০৯ সালে হয়তো প্রতিষ্ঠান তৈরি হবে। কিন্তু আমাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা হলো। প্রতিষ্ঠান তৈরি করার বিপরীতে উল্টো পথে গেল। আরো বেশি প্রধানমন্ত্রী শাসিত শাসন ব্যবস্থা, এক ব্যক্তির ওপর নির্ভরতা তৈরি হয়েছে। এটাই হচ্ছে বাংলাদেশের সংকটের জায়গা। 

দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের বড় অংশীদার দেশ ভারত। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বন্দোবস্ত নিয়ে সামনের দিনগুলোয় ওয়াশিংটন-নয়াদিল্লির অবস্থান একই দেখতে পাব আমরা?

দীর্ঘমেয়াদে এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের স্বার্থগত অভিন্নতা থাকার কথা। দীর্ঘদিন ধরে সেটা থেকেছে। ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সেই অভিন্নতা এখনো আছে। চীনকে মোকাবেলা করা, এ অঞ্চলে অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি, অর্থনীতির জন্য ভারতকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন। 

অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজন। অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতি না হলে যুক্তরাষ্ট্র তার স্বাধীন বাণিজ্য চালিয়ে যেতে পারে না। উত্তর কোরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য করতে পারে না, মিয়ানমারেও খুব স্বল্প পরিমাণ। বেসরকারি খাতে সে হয়তো খানিকটা যুক্ত থাকে, কিন্তু বড় বিনিয়োগ করতে পারে না। এখানে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র অভিন্ন স্বার্থের জায়গা আছে। 

আবার ভারতের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। ভারত মনে করছে বৈশ্বিক মঞ্চে তার একটা অবস্থান প্রয়োজন, অবস্থান তৈরি করতে ভারত আচরণ পরিবর্তন করছে। এ অবস্থানে এসে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের কিছু মতপার্থক্যের জায়গা তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র যে তাকে ওই জায়গাটুকু দিতে চায় না তা নয়। ভারতকে তার এলাকায় যে আস্থা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন, সেটা ভারত করতে পারেনি। 

দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ছাড়া ভারতের কোনো বন্ধু নেই। ভারত যখন ভাবছে বৈশ্বিক মঞ্চে যাবে, তার আঞ্চলিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সেই কর্তৃত্বটা শক্তি, ধমক, ভীতির কর্তৃত্ব নয়, গ্রহণযোগ্যতার কর্তৃত্ব তৈরি করতে হবে। 

বাইডেন প্রশাসন মনে করছে, তাদের আদর্শিক অবস্থান হচ্ছে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। এ গণতন্ত্র নিখুঁত তা কিন্তু বলতে পারবে না। সৌদি আরবের ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের কথা বলা হচ্ছে না, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে। কারণ এর সঙ্গে ভূরাজনীতি যুক্ত হয়েছে। তার সঙ্গে এর অবস্থান যুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশের অবস্থান মিয়ানমারের পাশে, বাংলাদেশের পাশে বঙ্গোপসাগর বলে যদি কিছু না থাকত তাহলে বাংলাদেশ এত গুরুত্ব পেত কিনা আমি সন্দিহান নই, আমি নিশ্চিত এটা পেত না। ইন্দো-প্যাসিফিক নীতি, সিতাওয়াতে চীনাদের উপস্থিতি, মিয়ানমার চীনা প্রভাবে দীর্ঘদিন, এখন একদম মুঠোয় চলে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র এগুলোকে বিবেচনা করতে গিয়ে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার এক ধরনের টানাপড়েন তৈরি হয়েছে। শুধু বাংলাদেশ প্রশ্নে নয়, মিয়ানমার প্রশ্নেও ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মতপার্থক্য রয়েছে। 

শেষ পর্যন্ত ভারতকে অ্যালাইন করতে হবে। ভারত যদি সত্যি সত্যি বৈশ্বিক মঞ্চে যেতে চায়, তার দৃষ্টি প্রসারিত করতে হবে। মায়োপিক পলিসি থেকে ভারত যদি বের হতে না পারে, দীর্ঘমেয়াদে ভারতেরই স্বার্থ মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হবে। 

র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং সাম্প্রতিক সময়ের ভিসা নীতির প্রভাব কোথায় কোথায় দেখতে পাচ্ছেন? যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রশাসন সামনের দিনগুলোয় আর কী পদক্ষেপ নিতে পারে? আপনার পর্যবেক্ষণ কী বলে?

র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার পর সংখ্যাগত দিক থেকে হলেও গুম এবং বিচার-বহির্ভূত হত্যার সংখ্যা কমেছে। র‌্যাবের অবস্থানে এখন হয়তো অন্যান্য সরকারি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে সক্রিয় হতে দেখা যাচ্ছে। সামগ্রিকভাবে কিন্তু কমেছে। কমেছে এটা প্রমাণ করছে যে এটা কমানো যেত। সরকারের ওপর এক ধরনের চাপ তৈরি হওয়ায় এটা করেছে সরকার। 

ভিসা নীতির দুটো দিক আমি দেখতে পাই। বাংলাদেশের ‘পলিটিক্যাল ক্লাস’-এর মধ্যে মিডল ক্লাস আছে, যাদের সন্তানরা বাইরে যায়, পড়তে যায়, নিজেরা বাইরে যান, সম্পদ বাইরে আছে। তারা এটার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছে। তারা ভাবছে, সরকার কেন এদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে আমার স্বার্থটা রক্ষা করে না। ফলে সরকারের বিষয়ে একটা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। এটা একটা দিক। দ্বিতীয় আরেকটি দিক হলো—একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছে। গত জুলাই-আগস্টের পর থেকে বিরোধী দলগুলো বিভিন্ন সভা-সমাবেশ করেছিল। তখন বেশ চাপ ছিল। ভিসা নীতির ফলে সেই চাপটা অনেকটা কমেছে। ভবিষ্যতে আর কী পদক্ষেপ নিতে পারে, তা নির্ভর করবে বাংলাদেশের রাজপথের ওপর। 

যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা কতটুকু? ট্রাম্প ফিরলে বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের পরিবর্তন আসতে পারে কী?

সম্ভাবনা আছে। এটাকে আমি একেবারে নাকচ করে দিচ্ছি না। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ এবং রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে। এখন পর্যন্ত আমার ধারণা, ট্রাম্পের বিজয় নির্ভর করবে ডেমোক্রেটিক পার্টির ওপর। বিশেষ করে বাইডেনের অভ্যন্তরীণ সফলতাগুলো। করোনার মতো পরিস্থিতির মধ্যেও শিশু দারিদ্র্য কমেছে, এগুলোকে যদি তারা প্রজেক্ট করতে পারেন। গর্ভপাতের প্রশ্নকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের বিরাট সংখ্যক নারী ভোটারকে আকর্ষণ করতে পারেন কিনা। 

বাইডেন প্রশাসন না থাকলে বৈশ্বিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির একটা পরিবর্তন ঘটবে। তার একটা প্রভাব বাংলাদেশের ওপরও পড়বে। 

ঢাকা-১৭ আসনের নির্বাচনে স্বতন্ত্র পদপ্রার্থী আশরাফুল আলমের ওপর হামলায় পশ্চিমা দেশগুলোর কূটনীতিকদের সরব হতে দেখেছি। এ ঘটনা আগামী দিন নিয়ে কোনো বার্তা দেয়? 

অবশ্যই দিচ্ছে। আগামী সাত মাস সংসদ টিকে থাকবে। এ সাত মাস স্থায়ী একটি সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনে যে আচরণ করা হয়েছে, সেটা লক্ষ্য করার অর্থ হচ্ছে ৩০০ আসনে এমন হওয়ার আশঙ্কাকে নাকচ করে দেয়া যাচ্ছে না। তারা উদ্বেগ জানিয়ে রাখছেন, লক্ষ্য করা হচ্ছে। তারা এরপর কী করতে পারবেন সেটা অন্য আলোচনা। এটার মধ্যে একটা বার্তা আছে। 

বাংলাদেশের একটা উপনির্বাচন, যেখানে বিরোধী দল অংশগ্রহণ করেনি। দলগতভাবে বাংলাদশের বড় বিরোধী দল অংশগ্রহণ না করা সত্ত্বেও আমরা দেখতে পাচ্ছি কী পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। 

নির্বাচনে কে প্রার্থী সেটা বিষয় নয়, সব প্রার্থীই সমান। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন একজন প্রার্থীকে প্রার্থী হিসেবে বিবেচনা করলেন না। যখন নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, একজন প্রার্থী কয়েকজন টিকটকার নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন। একজন নাগরিক, যিনি প্রার্থী হয়েছেন, তিনি ৫০ জন নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন কিনা তা আমরা ভিডিওতে দেখি। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য সমর্থনযোগ্য নয়। নাগরিকের পরিচয় টিকটকার হতে পারে না। নির্বাচনের দিন একজন প্রার্থীর পরিচয় ‘একজন প্রার্থী।’ এ বিবেচনা যে নির্বাচন কমিশন করতে পারে না, সেই নির্বাচন কমিশন একটা সুষ্ঠু, অবাধ, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিতে পারবে—এ বিশ্বাস যারা রাখেন ‘তাদের ধন্যবাদ।’ 

বাংলাদেশ কি সত্যিই ব্রিকসে যোগ দিতে চায়? ব্রিকসে যোগ দিলে এর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আসপেক্টগুলো কী?

বাংলাদেশের ব্রিকসে যোগ দেয়ার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া তথ্যগুলো পরস্পরবিরোধী। পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রথমে বললেন, আমরা যোগ দিচ্ছি। পরবর্তী সময়ে বললেন, আমন্ত্রিত হলে আবেদন করবেন। তাহলে প্রথমবার কেন বলা হলো? কারণ হচ্ছে রাজনৈতিক। এক ধরনের রাজনৈতিক হাইপ তৈরি করা, পশ্চিমা বিরোধিতার ধারণা দেয়া। 

এখন প্রশ্ন হলো, ব্রিকসে যোগদান করলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে কতটা লাভবান হবে। ব্রিকসের পাঁচটি দেশের মধ্যে এ পর্যন্ত কতটুকু সহযোগিতা বিস্তৃত হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি হিসেবে এখন পর্যন্ত লাভবান হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। ব্রিকসে যোগদানের অর্থ হলো, যেকোনো ধরনের মাল্টিল্যাটারাল অ্যালাইনমেন্টে বাংলাদেশ যাবে, যেখান থেকে সরকার লাভবান হবে সেখানে যাবে। এটা যেকোনো সরকারের কাছ থেকে আমরা আশা করি। ব্রিকস থেকে এখন পর্যন্ত সুবিধা পাওয়ার কিছু নেই। এটা এক ধরনের রাজনৈতিক বয়ান তৈরি করা। এগুলো বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক লক্ষণ নয়। 

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছেন। এ সফরে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উঠে এসেছে কিনা? সফরের কোনো প্রভাব দেখতে পাচ্ছেন? 

যতটুকু আমরা দেখতে পেরেছি, বুঝতে পেরেছি—নরেন্দ্র মোদি ও বাইডেনের মধ্যে বাংলাদেশ বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। তার কারণ হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্কের মধ্যে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে। কিছু ক্ষেত্রে টানাপড়েন আছে, কিছু ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক স্বার্থের বিষয় আছে। সেগুলোই গুরুত্ব পাওয়ার কথা এবং পেয়েছে। 

দ্বিতীয় বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্র তার নীতির অনুসরণ করার জন্য নয়াদিল্লির অনুমতির প্রয়োজন হয় না, জানানোরও প্রয়োজন হয় না। এ রকম ধারণাই প্রতিষ্ঠিত। র‌্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং ভিসা নীতি করার সময় ভারতকে জানানো হয়েছিল বলে কোনো লক্ষণ নেই। ভারত এ কথা তুলতে পারত এবং তুলবে বলে অনুমান করেছিল। যতটা না অনুমান, তার চেয়ে বেশি ভারতের মিডিয়াগুলো হাইপ তৈরি করেছে। তারা বলতে চেয়েছেন, এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, মোদি তুলবেন। 

আংশিকভাবে অজিত দেবালের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনায় আঞ্চলিক প্রসঙ্গ উঠেছিল, বাংলাদেশ প্রসঙ্গ সুস্পষ্টভাবে উঠেছে এমন কোনো তথ্য আমার জানা মতে ওঠেনি। আঞ্চলিক ক্ষেত্রে ভারতের যে অবস্থান, ভারত সেটা ব্যাখ্যা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রকে বলার চেষ্টা করেছে, তাদের নীতি যাতে এমন না হয়, যা ভারতের বিপরীতে যায়। এ অঞ্চলে যে স্থিতিশীলতা আছে, সেটা যাতে কোনোভাবে অস্থিতিশীল না হয়। সেটা যুক্তরাষ্ট্র শুনেছে, বলেছে আমরা আমাদের নীতি অনুসরণ করব। এটি তাদের বিবেচনায় এমনিতেই আছে। 

তত্ত্বাবধায়ক প্রশ্নে প্রধান দলগুলোর মতের কোনো মিলের ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে না। সামনের দিনগুলোয় এর বিকল্প কী হতে পারে?

এখন যে নির্বাচনী ব্যবস্থা আছে, প্রশাসন যেভাবে তৈরি করা হয়েছে, সরকারি দলের কর্মীদের যে আচরণ, নির্বাচন কমিশনের যে আচরণ, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর আচরণ অক্ষুণ্ন থাকলে একটা গ্রহণযোগ্য, অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো সম্ভাবনা নেই। নির্বাচন ব্যবস্থাকে কোনো না কোনোভাবে একটা কারেকশন করতে হবে। এ কারেকশনটাকে বিরোধী দল বলছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। আপনাকে কোনোভাবে এ কারেকশনটা করতে হবে, নির্বাচনকালীন সরকার তৈরি করতে হবে।

আমি একটা ক্রাইটেরিয়ার ভিত্তিতে নির্বাচনকালীন সরকারকে বিবেচনা করি। সরকারে যারা থাকবেন, নির্বাচনে তাদের কোনো অংশীদারত্ব থাকবে না। কেউ পরাজিত হলে তারা উত্ত্যক্ত হবেন না, বিজয়ী হলে তারা আনন্দিত হবেন না। তাদের কোনো স্বার্থ থাকবে না। এ রকম কোনো সরকার ছাড়া অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়। 

২০১৪ ও ২০১৮ সালের মডেলে নির্বাচন হলে পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া কী হবে?

২০১৪ ও ২০১৮ সালের মডেলে নির্বাচন হবে না। অন্য মডেলে হবে। ২০১৪-এর মডেল ২০১৮-তে নির্বাচন হয়নি, ২০১৮-এর মডেল ২০২৩-২৪-এও হবে না। নতুন মডেল তৈরি হবে। সেই মডেল কোথাও না কোথাও তৈরিও হয়ে থাকতে পারে। মূল জায়গাটা হচ্ছে—এর প্রতিক্রিয়া কী হবে? অন্যান্য জায়গায় দেখেছি, এ ধরনের নির্বাচনের পর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। সেসব ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি—যুক্তরাষ্ট্র এসব ব্যবস্থা নিতে দেরি করেছে। নির্বাচন হওয়ার আগে তারা মনেই করেনি এ ধরনের বিষয়ে তাদের ইন্টারজেক্ট করা দরকার। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সাত মাস আগেই সেই ইন্টারজেক্ট শুরু হয়েছে। 

নির্বাচনের আগেই অনেক ঘটনা ঘটতে হবে, তফশিল ঘোষণা করা হবে। যে হারে গায়েবি মামলা হচ্ছে...। মামলাগুলো গায়েবি, মানুষগুলো নয়। মানুষগুলো রক্তে-মাংসের মানুষ। এ মানুষগুলোকে হেনস্তার অধিকার কোনো রাষ্ট্র বা কোনো সরকারের থাকতে পারে না। 

বার্মা অ্যাক্টটা কী? এর সঙ্গে বাংলাদেশের কি প্রাসঙ্গিকতা আছে?

মিয়ানমারের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে যেসব দল লড়াই করছে তাদের নৈতিক এবং নানাভাবে সাহায্য করার জন্য বার্মা অ্যাক্ট কংগ্রেস প্রশাসনকে ক্ষমতা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে সেটা করতে শুরু করেছে। কারণ সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে মিয়ানমারের জনগণের গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা, সংগ্রাম সফল করা অ্যাক্টের উদ্দেশ্য। কেউ আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম নয়, রাষ্ট্র তার স্বার্থ রক্ষা করবে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রও তা-ই করবে, অন্য রাষ্ট্রও তা-ই করবে। বাংলাদেশ পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র হিসেবে তার একটা প্রভাব থাকবে। এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের বড় কারণ হচ্ছে মিয়ানমার। 

বাংলাদেশের রাজনীতির বিরাজমান পরিস্থিতির সর্বোত্তম সমাধান কোন পথে?

পথ দুটো। হয় আপনাকে আলোচনা করে সমাধান করতে হবে, নয়তো রাজপথে সমাধান করতে হবে। রাজপথের সমাধানে রক্তপাতের আশঙ্কা থেকেই যায়। রক্তপাত নাও হতে পারে, যদি বড় সংখ্যক মানুষ চায়। আলোচনার জন্য এজেন্ডা ঠিক করতে হবে, আর নয়তো রাজপথেই সমাধান করতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন