মোহাম্মদ কিবরিয়া: বিমূর্ততার বয়ানে ক্যালিগ্রাফিক আঁচড়

আহমদ শাকিল

মোহাম্মদ কিবরিয়ার ‘সাঁতার’, ১৯৫৯। সূত্র: সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

শিল্পের বিভিন্ন শৈলী নিয়ে নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা শিল্পীর কাজ। একজন শিল্পী কখনই বিশেষ কোনো রীতিতে নিজেকে আটকে রাখেন না। শিল্পের পথে তার যে ভ্রমণ, তা মূলত অন্তর্মুখী। শিল্পী আদতে ভাবুক। নিজের মনের গহিনে ডুব দিয়ে তিনি যা অবলোকন করেন, তা-ই তিনি রঙ-তুলির আঁচড়ে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলেন। এমনকি তিনি যদি ছবিতে নিছক আমাদের চারপাশটাই ফুটিয়ে তোলেন, তাতেও এক অভূতপূর্ব ব্যঞ্জনা তৈরি হয়। আর তিনি যখন তার তৃতীয় নয়ন দিয়ে দেখা প্রতিচ্ছবিটি ক্যানভাসে উপস্থাপন করেন, তখন দর্শকদের চোখে তা দুর্বোধ্য ঠেকে। দর্শক কিছু একটা দেখেন, কিন্তু তার মর্মার্থ অনুধাবন করতে পারেন না। অনেকটা ধরি ধরি করেও ধরতে না পারার মতো অনুভূতি। এ ধরনের কাজই চিত্রকলায় ‘অ্যাবস্ট্রাক্ট’ তথা ‘বিমূর্ত’ চিত্র নামে পরিচিত। তবে শিল্পীর ভ্রমণ যতই অন্তর্মুখী হোক না কেন, রসদ কিন্তু তাকে পারিপার্শ্বিক জগৎ থেকেই সংগ্রহ করতে হয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, শিল্প আন্দোলন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি, সাংস্কৃতিক বিনিময় ইত্যাদি বিষয় তার কাজকে প্রভাবিত করে। এ কারণে একজন শিল্পীর জীবনে বিভিন্ন পর্ব দেখা যায়। তার কাজের মূল ফোকাসটা একটি জায়গায় হলেও বিভিন্ন কালপর্বে সেখানে নানা চিত্রশৈলীর সমারোহ দেখা যায়। সব মিলিয়ে একজন শিল্পীর সম্পূর্ণ ক্যারিয়ারে তার একটি স্বাতন্ত্র্য তৈরি হয়। 

একজন প্রকৃত শিল্পী যে নির্দিষ্ট একটি জায়গায় স্থির থাকেন না, তার বড় প্রমাণ মোহাম্মদ কিবরিয়া। তার মধ্যে উপরোল্লিখিত বৈশিষ্ট্যগুলোর সার্থক প্রতিফলন ঘটেছে। ১৯২৯ সালের ১ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমে জন্ম নেয়া এ শিল্পী বিমূর্ত চিত্রকলাকেই নিজের অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। চিত্রকলা ও ছাপচিত্রে অনবদ্য অবদান রাখা বাংলাদেশের এ শিল্পী ১৯৫৯ সালে বৃত্তি নিয়ে জাপানের টোকিও ইউনিভার্সিটি অব ফাইন আর্টস অ্যান্ড মিউজিকে পড়তে যান। সেখানে তিনি পেইন্টিং ও গ্রাফিকসে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। ১৯৬২ সাল পর্যন্ত জাপানে ছিলেন তিনি। মোহাম্মদ কিবরিয়ার কাজ নিয়ে সার্বিক আলোচনা করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। জাপানে থাকাকালীন জাপানি ক্যালিগ্রাফির প্রভাবে তার চিত্রভাষায় পরিবর্তন আসে। তার জাপানে যাওয়ার আগের ও পরের কাজগুলোর মধ্যে তফাত স্পষ্ট। জাপানের চিত্রকলার যে দিকটি তাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছিল, তা হলো জাপানের ক্যালিগ্রাফিক আর্ট। এ লেখায় আমরা মোহাম্মদ কিবরিয়ার চিত্রকলা ও ছাপচিত্রে জাপানি ক্যালিগ্রাফিক আর্টের প্রভাব নিয়ে প্রয়াস চালানোর দুঃসাহস দেখিয়েছি। ‘অ্যালফাবেটস’ ও ‘সুইমিং’ নামে শিল্পীর দুটি কাজকে যথাসাধ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে এ লেখা এগিয়ে যাবে।

মোহাম্মদ কিবরিয়া যখন জাপানে পড়তে যান তখন বাংলাদেশ এক ক্রান্তিকাল পার করছে। তার আগেই এশিয়ার শিল্পজগতে ‘প্যানএশিয়ানিজম’-এর জোয়ার শুরু হয়ে গিয়েছিল। এর প্রভাবে এশিয়ার বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে ভারত ও জাপানের মধ্যে শুরু হয়েছিল সাংস্কৃতিক বিনিময়। জাপানের শিল্পীরা ভারতে আসছিলেন, ভারত থেকেও শিল্পীরা জাপানে গিয়েছিলেন। সেই ধারাবাহিকতায় যুক্ত হলেন বাংলা মুলুকের শিল্পীরাও। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু ও মুকুল দে জাপানে গিয়েছিলেন। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনও জাপান ভ্রমণ করেছিলেন। জাপানের শিল্পজগতে তখন নতুন এক ধারা শুরু হয়েছে। ক্যালিগ্রাফিকে নিছক বর্ণের শৈল্পিক উপস্থাপনের মধ্যে আটকে না রেখে ফিগার ড্রয়িংয়ের ক্ষেত্রে ক্যালিগ্রাফির পদ্ধতি অনুসরণ করা। বিমূর্ত চিত্রকলায় এ ধারার সূচনা করেছিলেন ‘বোকুজিনকাই’ নামে জাপানের এক শিল্পীগোষ্ঠী। এ ধারার প্রবক্তারা ক্যালিগ্রাফিকে এর দুর্বোধ্যতার জন্য বেছে নিয়েছিলেন। তাদের মতে, ফিগারকে ক্যালিগ্রাফিক পদ্ধতিতে উপস্থাপনের মাধ্যমে তার বিমূর্ত রূপ দেয়া সম্ভব। এ ধারা বাংলায়ও জনপ্রিয় হয়। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসুরা তখন ক্যালিগ্রাফিক আর্ট নিয়ে কাজ করেছেন। পরবর্তী সময়ে জয়নুল আবেদিনের ‘দুর্ভিক্ষ’ সিরিজ ও নবান্নের মতো কাজেও জাপানি ক্যালিগ্রাফির প্রভাব আছে। তাদের পর বাংলার যে শিল্পী জাপানের এ ক্যালিগ্রাফিক আর্টকে আত্মস্থ করে বিমূর্ত চিত্রকলায় তার সার্থক প্রতিফলন ঘটিয়েছেন, তিনি মোহাম্মদ কিবরিয়া।

জাপানে যাওয়ার প্রথম বছরেই মোহাম্মদ কিবরিয়া ‘সুইমিং’ শিরোনামের ছবিটি এঁকেছিলেন। জাপানি ক্যালিগ্রাফির অনুকরণে একরঙা কালি দিয়ে রাইস পেপারে তিনি অনুভূমিকভাবে সন্তরণরত দুটি মূর্তি এঁকেছেন। ক্যালিগ্রাফির সঙ্গে এর পার্থক্য হলো এখানে তিনি টেক্সটের পরিবর্তে ফিগারকে ফুটিয়ে তুলেছেন। প্রথম দেখায় মনে হবে, ব্রাশ দিয়ে নয়, কলম দিয়ে আঁকা হয়েছে এ চিত্র। এখানে শরীরগুলো স্পষ্ট, কিন্তু সেগুলো দর্শকদের মধ্যে বিভ্রম তৈরি করে। তার চেয়ে বরং এগুলোকে মনে হবে টানা হাতের লেখা, যেগুলো ছন্দোবদ্ধভাবে ক্যানভাসে ওঠানামা করছে। সাঁতারুদের পায়ের কাছে এসে ফর্মটি ভেঙে গিয়ে সমতল হয়ে গেছে। সন্তরণরত মূর্তি দুটির নিচে পুরু ব্রাশ দিয়ে দাগ দেয়া। এর দ্বারা পানি বোঝানো হচ্ছে, যেখানে মূর্তি দুটি সাঁতার কাটছে। পুরু ব্রাশের জমাট কালো এ দাগ যেন দর্শককে ওপরের ফিগার দুটিকে টেক্সটের মতো করেই পড়তে উদ্বুদ্ধ করছে। ‘সুইমিং’ শিরোনামের এ চিত্রে একই সঙ্গে বিমূর্তবাদ, কিউবিজম ও ক্যালিগ্রাফির সম্মিলন ঘটিয়েছেন মোহাম্মদ কিবরিয়া। চিত্রটি ১৯৫৯ সালে আঁকা। এর সঙ্গে শিল্পীর ১৯৫৩ সালে আঁকা ‘ওয়াটার স্পোর্ট’ শিরোনামের চিত্রটির তুলনা করা যেতে পারে। এ তুলনা থেকে জাপানে যাওয়ার পর মোহাম্মদ কিবরিয়ার কাজে কী ধরনের প্রভাব পড়েছে তা আরো স্পষ্ট হবে। ‘ওয়াটার স্পোর্ট’ একটি তৈলচিত্র। এখানেও দুটি মূর্তিকে সাঁতার কাটতে দেখা যায়। তবে চিত্রটি সুইমিংয়ের চেয়ে অন্তত তিন গুণ বড়। তবে এখানে ফিগারগুলো সুইমিংয়ের মতো হালকাভাবে সংযুক্ত নয়। কিন্তু শিল্পী যে তখন থেকেই বিমূর্তবাদ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন, তা ফিগারগুলোর একে অন্যের ওপর জড়িয়ে থাকা এবং চ্যাপ্টা আকার থেকে বোঝা যায়। ‘ওয়াটার স্পোর্ট’ শিরোনামের চিত্রে মোহাম্মদ কিবরিয়া বিভিন্ন রঙ ব্যবহার করেছেন। কিন্তু ‘সুইমিং’-এ তিনি কেবল কালো কালি ব্যবহার করেছেন। এ দুটি ছবি পাশাপাশি রেখে দেখলে যেকোনো দর্শকই বুঝতে পারবে যে শিল্পী তার জীবনের দুটি পর্যায়ে একই থিমের চিত্র দুভাবে এঁকেছেন। শিল্পীজীবনের শুরু থেকেই তার কাজে বিমূর্তবাদের প্রকাশ ছিল। জাপানে যাওয়ার পর তার সঙ্গে যুক্ত হলো ক্যালিগ্রাফি। অর্থাৎ জাপানের শিল্পশৈলীর প্রভাবে মোহাম্মদ কিবরিয়া ক্যালিগ্রাফিক আর্টের মাধ্যমে বিমূর্তবাদের প্রকাশ ঘটানোয় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। 

ক্যালিগ্রাফিক আর্টের মাধ্যমে বিমূর্তবাদের এ উপস্থাপনের আরেকটি অনন্য উদাহরণ হলো মোহাম্মদ কিবরিয়ার ১৯৬৫ সালের লিথোগ্রাফ ‘অ্যালফাবেটস’। ক্যালিগ্রাফির টেক্সচুয়াল ও নন-টেক্সচুয়াল ফর্মের মাঝামাঝি একটি জায়গায় এ লিথোগ্রাফের অবস্থান। এখানে ফিগারগুলো স্বতন্ত্র নয়। এখানে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো বর্ণও বোঝা যায় না। দেখে মনে হবে যে এখানে বর্ণ আছে, কিন্তু কী বর্ণ, তা হলফ করে বলার কোনো উপায় নেই!

‘প্যানএশিয়ানিজম’-এর প্রভাবে বাংলা ও জাপানের শিল্পীদের মধ্যে যে সাংস্কৃতিক বিনিময় ঘটেছিল, সে ধারার প্রভাব মোহাম্মদ কিবরিয়ার কাজে স্পষ্ট। জাপানে যাওয়ার পরবর্তী সময়ে তার কাজে বিমূর্তবাদ ও জাপানি ক্যালিগ্রাফিক আর্টের সমন্বয় ঘটেছে। ক্যালিগ্রাফিক আর্টের মাধ্যমে বিমূর্ত চিত্রকলার চিত্রণে বাংলাদেশের শিল্পীদের মধ্যে সার্থক উদাহরণ হয়ে আছেন মোহাম্মদ কিবরিয়া। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন