মায়ায় মিশেছে সব সম্ভাবনা

ওয়াহিদ সুজন

দ্ব্যর্থক এক শব্দ ‘মায়া’। এ বস্তু বিশ্বের রূপান্তরের অবস্তুগত শর্ত মায়া। মানুষ আশা হারানোর কালে যার ভেতর স্বস্তি পেতে চায়। আমরা জানি যে এ প্রকৃতি ও পরিবেশ স্রেফ দৃশ্যমান জগতের অনুমানে আটকে নেই। প্রতি মুহূর্তে তার রূপান্তর ঘটছে অনিঃশেষ শক্তির সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায়। মানবজগতে এ মিথস্ক্রিয়া ক্রমান্বয়ে তার স্বপ্ন, কল্পনা মিলিয়ে উত্থিত হয়। মানুষ এক ফিনিক্স, যে ছাই হতে হতে আবার ডানা মেলার প্রস্তুতি নেয়। আর সমূহ বিপর্যয়কে নতুন ইশারা ও নতুন আলোর দিকে নিয়ে যেতেই তার প্রস্তুতি। সেখানে যা মায়া, তা-ই সত্যি। যা মায়া, তা-ই অপার ভালোবাসা। আমরা যে এ জগৎকে মায়া করি, তার সব অপূর্ব নিদর্শন আছে আমাদের চারপাশে।

প্রতিদিন আমরা আবিষ্কার করি, পৃথিবী প্রতিদিন আরো বেশি বেশি করে মানুষের জন্য, প্রাণের জন্য, প্রকৃতির জন্য অনাত্মীয় হয়ে উঠছে। মানুষের বেহিসেবি, লাগামহীন ভোগ ও দায়িত্বহীন কর্মকাণ্ড এর কারণ। সাম্প্রতিক প্রাকৃতিক বিপর্যয়গুলো তার উদাহরণ। ক্রমেই আরো উষ্ণ হয়ে ওঠা, তার সংক্ষুব্ধ পৃথিবীর সেই গল্প উঠে এসেছে সৈয়দ মোহাম্মদ জাকিরের ‘মায়া’ শিরোনামের প্রদর্শনীতে, যেখানে অনিঃশেষ রূপান্তরের গল্প বলেছেন তিনি, যা দেখা, দেখানো ও দেখানোর মাধ্যম হিসেবে ভিন্ন।

সচরাচর গ্যালারির নিয়ন্ত্রিত পরিবেশকে শিল্পকর্ম প্রদর্শনের জন্য আমরা বেছে নিই। জাকির বেছে নিয়েছেন রাজধানীর বেঙ্গল শিল্পালয়ের খেলামেলা একটি ফ্লোর। ‘প্রকৃতি-গতি পর্যবেক্ষণ ও সামঞ্জস্য অনুসন্ধান’ উল্লেখ করে নিজের কাজ সম্পর্কে তিনি বলছেন, ‘এ প্রদর্শনী আমার সমসাময়িক চিন্তা, পর্যবেক্ষণ, দীর্ঘদিনের শিল্পচর্চা ও শিল্পভাবনার কিছু বিষয়ের দৃশ্যরূপ। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন মাধ্যমে করা কাজ ও কাজের বিষয়, ফর্ম, ও চিন্তার সূত্র মূলত প্রকৃতি, মানুষ, দৈনন্দিন যাপিত জীবন, আশপাশের নানাবিধ বস্তু, প্রতিচ্ছবি ও গল্প থেকে পাওয়া অনুপ্রেরণা।’

তার কাজের মধ্যে আছে আধুনিক মানুষের আধ্যাত্মিক ভাবনা। প্রাণ ও প্রতিবেশ নিয়ে সাম্প্রতিক বিশ্বের যে সচেতনতা, যা মানুষের দেহগত অস্তিত্ব ধরে টান দিয়েছে, তার গল্প। যার সূত্র অধিজগতে বলেই মনে হয় জাকিরের কাজে। সময়টা এমন নয় যে প্রাণ-প্রকৃতিকে বাঁচানোর এ লড়াই একরৈখিক। প্রকৃতি আর পণ্য নয়। প্রকৃতির পণ্যায়ন মূলত মানুষের রক্ত-মাংসের বিকিকিনি। মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক শরীরী। তারা একই আত্মার ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা। জাকির বলছেন, ‘প্রকৃতি-গতি, মহাজাগতিক মহাযাত্রা, সময় ও স্পেসের রহস্য থেকে উদ্ভূত জিজ্ঞাসা ও এসবের সঙ্গে মানুষের আন্তঃসংযোগ বিষয়ে আমার অনুসন্ধান ও ভাবনা আমার কাজের অনেকটা জুড়ে।’ প্রদর্শনী দৃশ্যগত ও ভাবনাগতভাবে তার সেই অনুসন্ধানের সাক্ষী।

নিরীক্ষাপ্রবণ সৈয়দ মোহাম্মদ জাকির শিল্প-সৃষ্টিতে ভীষণ স্বতঃস্ফূর্ত ও সমসাময়িক। ফেলে দেয়া, কুড়িয়ে পাওয়া, সহজলভ্য বস্তুকে উপাদান হিসেবে গ্রহণ করেছেন তিনি। যার সঙ্গে কখনো কখনো রেখাচিত্র যুক্ত করেছেন। কিন্তু গতি হারায়নি কল্পনা। আবার কখনো বাস্তব অভিজ্ঞতার মিশেলে আধ্যাত্মিকতা, জাগতিক ও মহাজাগতিক সময়ের স্বরূপ, গতিশীলতা, বস্তুজগতের অনিত্যতায় ভর করে অনুসন্ধিৎসু মন শিল্পকে আধার হিসেবে গ্রহণ করেছে।

প্রদর্শনীস্থল জুড়ে থাকা শিল্পকর্মগুলো দর্শকদের অপরিচিত ঠেকে না। বরং নতুন চোখ খুলে দেয়। আমরা দেখা থেকে অদেখায় যাত্রা করি। একটা ভাঙাচোরা ফুলের টব বা কুড়িয়ে পাওয়া গাছের ডাল ও গাড়ির বিভিন্ন অংশ দেখলে ভিন্ন ধারণা আসতে পারে মনে। ভাঙা ট্রাক নিয়েই বলি। হলিউডের জনপ্রিয় ফ্র্যাঞ্চাইজি ‘ট্রান্সফরমার্স’-এ আমরা আধুনিক কৃৎকৌশলের মারণঘাতী এক রূপ দেখি; যেখানে মানুষের নির্মিত যন্ত্রগুলো প্রাণবান হিসেবে আবির্ভূত হয়ে মানুষকেই ধ্বংস করছে, যা এর দর্শনগত গভীরতা বা মানুষের ভোগাকাঙ্ক্ষাকে শেষ পর্যন্ত প্রশ্নের মুখে ফেলে না। বরং ভোগের নতুন সম্প্রসারণ হলো নিজের বিলোপ দেখা। কিন্তু মোহাম্মদ জাকিরের স্তূপ করে রাখা দুর্ঘটনাগ্রস্ত ট্রাকের বিভিন্ন অংশ এ ভোগের অসারতা দেখিয়ে দেয়। প্রতিদিন বাংলাদেশের সড়কে মরতে থাকা মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয়। আরো বড়ভাবে দেখলে, দেখিয়ে দেয় আমাদের সামষ্টিক বিপন্নতা, যাকে চাকচিক্যের আড়ালে, বিজ্ঞাপনের আড়ালে রেখে আমরা এড়িয়ে যাই। নিশ্চিন্তে ঘুমানোর চেষ্টা করি। কিন্তু দুঃস্বপ্নে ভেঙে যায় আরাধ্য ঘুম। বরং এই ধ্বংস আমাদের নতুন বোধ দেয়, তৈরি করে একাত্মের অনুভূতি।

সৈয়দ মোহাম্মদ জাকিরের বয়ানে, এখানে পৃথিবীর ক্রমেই নিঃশেষ হয়ে যাওয়া সম্পর্কিত সংকেত আছে। আমি সময়ের মাত্রাকে এড়িয়ে কিছু দৃশ্যকল্প অবতারণার চেষ্টা করেছি। গুরুত্বহীন বস্তুকে গুরুত্ব দিয়েছি, পরিচিত ফর্মকে অপরিচিত আঙ্গিকে উপস্থাপন করেছি।

বিপজ্জনক পরিবেশে পাওয়া উপাদানে গড়া শিল্পকর্মের মাধ্যমে এক মায়াময় শহরকে উপস্থাপন করেছেন শিল্পী। সেই কাল্পনিক শহরের নাম ‘বাঘরেব’। একরৈখিক কোনো সত্তা নয় এ শহর। স্থান-কালের ধারাবাহিকতার অন্তর্গত কিছু। আপন আবাসের সঙ্গে ‘যুদ্ধরত’ অসংখ্য জীবন আর প্রকৃতির বিনাশের চিত্র এ শহরের আরেক বাস্তবতা। যেখানে প্রতিটি শিল্পকর্ম একটি আরেকটির সঙ্গে আন্তঃসম্পর্কিত। এ আন্তঃসম্পর্ক নির্মাণের মাধ্যম হলো ‘মায়া’। ঠিক যেন এ শব্দটির প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সব সম্ভাবনাকে এক সূত্রে গাঁথলেন সৈয়দ মোহাম্মদ জাকির। আর সেখানে ছিন্ন হয় ‘মায়া’র সব মায়াপ্রবণ সংজ্ঞা ও কল্পনা। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন