কী আছে মিলান কুন্ডেরার কুহক কুণ্ডে?

মাছুম বিল্লাহ

ছবি: আল মাজাল্লা

বিশ্ব সাহিত্যের বুক থেকে ৯৪ বছর বয়সে চেকোস্লোভাকিয়ার নির্বাসিত পন্যাসিক ‘মিলান কুন্ডেরা’ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন ১২ জুলাই ২০২৩। তিনি চেকস্লোভাকিয়ার ব্রানোতে ১৯২৯ সালের এপ্রিল জন্মগ্রহ করেন। চেকস্লোভাকিয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক দখলদারির পর কুন্ডেরাকে ১৯৭৫ সালে ফ্রান্সে চলে যেতে হয়। কুন্ডেরার বাবা লুদভিক কুন্ডেরা পিয়ানোবাদক ও সংগীতজ্ঞ এবং মা মিলাদা হানিসকোভা ছিলেন সংগীতের গুণমুদ্ধ অনুরাগী। কুন্ডেরা শুরু করেছিলেন কবিতা দিয়ে, ১৯৫০-এর দশকে কবিতার বইও বের করেন; ১৯৫৫-এর ‘দ্য লাস্ট মে’ বইটা আবার কমিউনিস্ট নেতার প্রতি নিবেদন করা। চেক রাজনীতিবিদরা আবার কনডেমও করেছিলেন লেখার মধ্যকার যৌন আবেগ ও পরিহাসমূলক সুরের কারণে। ২১ বছর বয়সে কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হলেন, আবার যোগ দিলেন ১৯৫৬ সালে। কুন্ডেরার বেশির ভাগ লেখায় তার চেক জীবনের উপস্থিতি আছে; পরে আছে ফরাসি জীবন। জীবনের ৪০ বছর কাটিয়েছেন চেকস্লোভাকিয়ায়। আর তাই সেখানকার প্রভাব তার উপন্যাসে বিদ্যমান থাকারই কথা। পরে ফ্রান্সে থাকাকালীন ফ্রান্সের বিষয় ঢুকে পড়ে তার উপন্যাসে। তার গ্রন্থগুলোর নামই বলে দেয় মিলান কুন্ডেরা কী বলতে চেয়েছেন। আইডেনটিটি (পরিচয়), দ্য আনবেয়ারেবল লাইটনেস অ বিয়িং, দ্য জোক (ঠাট্টা), লাফঅ্যাবল লাভস (হাস্যকর ভালোবাসা), ইগনরেন্স (মূর্খতা), দ্য ফেস্টিভ্যাল অ ইনসিগনিফিক্যান্স (গুরুত্বহীনতার উৎসব), লাইফ ইজ এলসহোয়ার (জীবন অন্যত্র), এনকাউন্টার (মুখোমুখি), এ কিডন্যাপড ওয়েস্ট- দ্য ট্রাজেডি অ সেন্ট্রাল ইউরোপ (অপহৃত পশ্চিম-কেন্দ্রীয় ইউরোপের কান্না)। কুন্ডেরা জানতেন যে লেখা মানেই ডায়ালগ, কনভারসেশন। সেটি হতে পারে নিজের সঙ্গে, অন্যেসঙ্গে, জনপ্রিয়তা, সাফল্য, খ্যাতিসহ কিংবা এর বাইরে। তার প্রতিটি সৃজনধর্মী লেখা সমকালীন গণস্তর, রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে প্রাণবন্ত তর্ক-বিতর্ককে উসকে দিয়েছে।

কুন্ডেরা মনে করতেন, জীবন একটা ইররেশনাল ব্যাপার বা অযৌক্তিক ঘটনা। তার মার্কিন লেখক বন্ধু ফিলিপ রথকে কুন্ডেরা জানিয়েছিলেন, ‘আমি যখন ছোট ছিলাম তখন প্যান্ট পরে ঘুরতাম, তখন আমি একটি অলৌকিক মলমের কথা ভাবতাম যা শরীরে মাখলে তা আমাকে অদৃশ্য করে তুলবে। তারপর আমি প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছি, লিখতে শুরু করেছি এবং সফলও হতে চেয়েছিলাম। এখন আমি সফল এবং আমি এখনো এমন মলম পেতে চাই যা আমাকে অদৃশ্য করে তুলবে।’ এখানে কাফকার মেটাফরফেসিস-এ পোকা হয়ে যাওয়া যেমন একটি উদ্ভট স্বপ্ন, কুন্ডেরার অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার ইচ্ছাসঙ্গে একটি মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তার ওই অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার ইচ্ছাটাও অযৌক্তিক, কিন্তু মানুষের মনে এটি ক্রিয়া করে। ১৯৮৫ সালে জেরুজালেম সাহিত্য পুরস্কার গ্রহণের সময় কুন্ডেরা এক অভিভাষণে বলেছিলেন, উপন্যাস কী? একটি ইহুদি প্রবাদ আছে, মানুষ ভাবে আর ঈশ্বর হাসেন। সেই প্রবাদে অনুপ্রাণিত হয়ে আমি কল্পনা করতে চাইফ্রাঁসোয়া রাবেলাই যিনি ফরাসি রেনেসাঁর সময়ের লেখক একদিন ঈশ্বরের হাসি শুনেছিলেন এবং এভাবে প্রথম মহান ইউরোপীয় উপন্যাসের ধারণার জন্ম হয়। তিনি মনে করতেন যে উপন্যাসের শিল্প ঈশ্বরের হাসির প্রতিধ্বনি হিসেবে পৃথিবীতে এসেছিল। মানুষকে ভাবতে দেখে ঈশ্বর হাসেন কেন? কারণ মানুষ যখন চিন্তা করে এবং সত্য তার থেকে পালিয়ে যায়। একজন ব্যক্তি যত বেশি চিন্তা করে, আরেকজনের চিন্তার সঙ্গে তার তত বেশি বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়, দূরত্ব তৈরি হয় এবং পরিশেষে মানুষ কখনো নিজেকে নিয়ে সে যা ভাবে তা নয়। প্রথম ইউরোপীয় ঔপন্যাসিকরা মানুষের সেই নতুন পরিস্থিতি দেখেছিলেন এবং উপলব্ধি করেছিলেন এবং তার ওপর তারা নতুন শিল্প, উপন্যাসের শিল্প নির্মা করেছিলেন।

মানুষের জীবন কুন্ডেরার কাছে মনে হতো একটি ফাঁদ। একটি শরীরের ভেতর আমরা নিজেদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আটকা পড়ে আছি এবং যার গন্তব্য হচ্ছে মৃত্যু। তিনি অবশ্য বোহেমিয়ান বা উদাসী কোনো চরিত্রের ছিলেন না। কুন্ডেরা যখন চেকোস্লোভাকিয়ায় নাৎসিদের আক্রম চলে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। তখন তিনি সমাজতন্ত্রের পক্ষে স্লোগান ধরেন। তাদের পক্ষে গান-কবিতা লেখেন। এরপর যখন চেকোস্লোভাকিয়ায় সোভিয়েত আগ্রাসন শুরু হয়, তিনি তখন লেখেন তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘‌দ্য জোকস’। সেখানে তিনি জোসেফ স্তালিনের বিরুদ্ধে এবং লিও ট্রটস্কির পক্ষে অবস্থান নেন। এ উপন্যাস লেখার জেরে তিনি অধ্যাপনার পদ হারান। তার স বই বাজার থেকে তুলে নেয়া হয়। পরে নির্বাসিত হতে হয় ফ্রান্সে। ১৯৭৫ সালে দেশ ছাড়ার পর বাতিল হয় তার নাগরিকত্ব। তখন থেকেই ফ্রান্সে বসবাস করেন। এরপর চেক ভাষায় লেখালেখিও ছেড়ে দেন কুন্ডেরা। কুন্ডেরার মতে, উপন্যাস হচ্ছে উভলিঙ্গ স্বত্বা; যার ভেতর জগতের একটি মেয়েলি এবং একটি পুরুষ দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে। আর শারীরিক মানুষ হিসেবে লেখকদের যৌনতা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। চরিত্র ফুটিয়ে তোলার ব্যাপারে তিনি বলেন, আমার উপন্যাসের কোনো চরিত্রই ছদ্মবেশি আত্মজীবনী পছন্দ করে না। আমি লেখকদের হঠকারিতাকে ঘৃণা করি। আমার জন্য হঠকারিতা একটি মূল পাপ। যে অন্য কারো অন্তরঙ্গ জীবন প্রকাশ করে তাকে চাবুক মারা দরকার। কুন্ডেরার এ বিষয় আমাদের বর্তমান যুগের কথা স্মর করিয়ে দেয়, এমন এক যুগে বাস করছি যখন জীবনে ব্যক্তিগত বলে আর কিছু থাকছে না। এটি সমাজ ও রাষ্ট্রের কারণে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় অবাধ প্রসারের কারণে। কমিউনিস্ট দেশগুলোতে পুলিশ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে ধ্বংস করে, গণতান্ত্রিক দেশগুলো কি এ থেকে মুক্ত? অবশ্যই নয়, বরং আরো পরে। রাষ্ট্রীয় আইনের মারপ্যাঁচে ব্যক্তিগত জীবনের স্বাদ এবং তাদের অনুভূতি মানুষ হারিয়ে ফেলেছে। এ যেন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নিয়ম, এখানে ব্যক্তিগত বলে কিছুই নেই। এভাবে কুন্ডেরা বরাবরই নিজের ব্যক্তিগত জীবনকে আড়ালে রাখতে চাইতেন। তার লেখালেখি, সাহিত্য, জীবনচর্চা ছিল তেমনই। আধুনিক দুনিয়ায় মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য, জীবন সব উন্মুক্ত হয়ে পড়েছেএটা তিনি মানতে পারতেন না। কারণে ইউরোপের যে মতাদর্শ, জীবনযাপন তাতে তিনি ছিলেন বিরক্ত। এসব কারণে উপন্যাস নেই হয়ে যেতে পারে বলেও তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন।

কুন্ডেরার শিক্ষাজীবন শুরু সংগীত দিয়ে। পরে তিনি চার্লস বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ১৯৫৬ সালে ভর্তি হন সংগীত ও নাট্য একাডেমিতে। এ দু প্রতিষ্ঠানই চেক রাজধানী প্রাগে অবস্থিত। মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি বুঝতে পারেন সংগীত তার পেশা হয়ে উঠতে পারবে না। কিন্তু সংগীতের প্রতি তার ছিল প্রবল অনুরাগ তার উপন্যাসের গঠনশৈলী ও বিষয়বস্তুতে সংগীতের প্রভাব পড়েছে। সংগীতের শৈলী হয়ে উঠেছে তার উপন্যাসে শৈলী। কুন্ডেরার লেখকজীবন শুরু হয় ১৯৫৩ থেকে, চলে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত। এ সময়ের মধ্যে তিনটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের মধ্য দিয়ে তিনি প্রকাশিত হন। কুন্ডেরার প্রথম উপন্যাস ‘‌ঠাট্টা’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে। এ উপন্যাস রচনার নেপথ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আছে। ১৯৫০ সালে তিনি এবং আরেকজন চেক লেখক হান ত্রেফুলকা পার্টি-বিরোধী কাজের অভিযোগে কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হন। হাস্যকৌতুকময় পৃথিবীর অভাবে জীবন যে কতটা নীরস ও অর্থহীন হয়ে উঠতে পারে সেটিই হচ্চে এ উপন্যাসের বিষয়বস্তু। উপন্যাসটির সূত্রে তিনি পার্টির নেতৃত্বে চলে এসেছিলেন।

‘দ্য আনবেয়ারেবল লাইটনেস অ বিয়িং’ বা ‘অস্তিত্বের অসহনীয় নির্ভারতা’ উপন্যাসে কুন্ডেরা দেখিয়েছেন যে জীবনের পুনরাবৃত্তি ঘটে না। ফলে মানুষ যে ভুল করে, অতীতে ফিরে গিয়ে সেই ভুল সংশোধন করার সুযোগ সে পায় না। কোনো কিছুই তখন তার করার থাকে না। এ অনুভূতিই মানুষকে পরে নির্ভার করে। দায়িত্বহীনতার বিষয়টি সে বুঝতে পারে। জীবনের এই যে নির্ভার অনুভব, কুন্ডেরা এর দার্শনিক সূত্রটি পেয়েছিলেন গ্রিক দার্শনিক পারমেনডিসের কাছ থেকে। পারমেনডিস বলেছিলেন, ‘জীবন হচ্ছে প্লেফুলনেস বা ক্রীড়াশীলতা। জীবনে কোনো কিছুকে খুব বেশি গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজন নেই কার জীবন অর্থহীন ও শূন্য।’ জার্মান লেখক হেরমান ব্রচের ভাবনাকেও কুন্ডেরা গ্রহ করেছেন, আর সেটি হলো ‘‌কিউচ’। এ জার্মান শব্দটির অর্থ হচ্ছে ‘‌সুন্দর মিথ্যা’। এ মিথ্যাই জীবনের নেতিবাচক দিকগুলোকে লুকিয়ে রাখে এবং উদ্দেশ্যমূলকভাবে মৃত্যুর উপস্থিতিকে অস্বীকার করে। দ্য আনবেয়ারেবল লাইটনেস অব বিয়িং’-এ অনন্ত প্রত্যাবর্তনকে যিনি রহস্যময় বলেছেন।’ যেই মুহূর্তে আমরা কোনো কিছু অভিজ্ঞতা লাভ করি, তখন থেকেই সেটির পুনরাবৃত্তিও শুরু হয়। আর পুনরাবৃত্তি নিজেই অনন্তকাল ধরে হতে থাকে। ‘এ অনন্ত প্রত্যাবর্তনের ধারণা এমনই এক দৃষ্টিদান করে যে র ফলে কোনোকিছুকে আমরা সাধারণত যেভাবে দেখে বুঝি থাকি তার বাইরে ভিন্ন ধারণা দিতে পারে। ফলে আমরা আর সিদ্ধান্ত দিতে পারি না, সমাধানে পৌঁছতে পারি না। কার যা রূপান্তরে আছে তাকে আমরা কীভাবে সিদ্ধান্তে আটকাই?’ ১৯৮৪ সালে প্রকাশ হয় তার এ বিখ্যাত উপন্যাস ‘‌দ্য আনবেয়ারেবল লাইটনেস অ বিয়িং’। নানা দার্শনিক প্রসঙ্গএকদিকে প্রেম, মৃত্যু, দুর্বহ স্মৃতিকে বয়ে চলার অনুভব এবং অন্যদিকে ভুলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে ভারমুক্তির অনুষঙ্গ নিয়ে উপন্যাসটি লেখা।

ছবি: রয়টার্স

কুন্ডেরা বলতে চেয়েছেন, একজন লেখক আসলে এক্সপ্লোর করেন। তার আশপাশের চরিত্র, ঘটনার সঙ্গে এদের সম্পর্ক, যোগাযোগের ধরন, বিনিময়, এসব একজন লেখক দেখেন এবং তুলে আনেন। লেখক নিজেকে কোনো ঘটনা থেকেই বিযুক্ত করেন না, আবার কোনো ঘটনায় নিজেকে গুলিয়েও ফেলেন না। চোখে দেখাটা তার কাজ। প্রত্যক্ষ করায় তিনি যা কিছু তুলে আনতে পারবেন তা দিয়েই পাঠকের সঙ্গে তার যোগাযোগ তৈরি হবে। কার পাঠক অনেক। হাস্যরসের অনুভূতিও থাকতে হবে সেখানে, কারণ হাস্যরস হলো বিশ্বস্ততার প্রতীক। এর বাইরে কুন্ডেরার উপন্যাসের আরেক স্বভাব যৌনতা। নিজের উপন্যাসের প্লট খুব আলাদা করা বিষয়েও তার অনাগ্রহ ছিল। যৌনতার ক্ষেত্রেও দ্রুত কিছু করে ফেলার বিরোধী ছিলেন তিনি। যৌনতার ক্ষেত্রে তিনি ফ্রয়েডীয় ধারার অনুসারী। তার উপন্যাসে অবশ্য যৌনতা নারীদের বিরুদ্ধে বলে অভিযোগও রয়েছে। যেমন জোকস’ উপন্যাসে এক নারীর স্বামীর সঙ্গে শত্রুতার কারণে ওই নারীর ওপর অত্যাচারের ঘটনা ঘটে। তাছাড়া তিনি ছিলেন এরোটিক’। তিনি মনে করতেন প্রেমময় বিষয় ও কামোত্তজেনা জীবনেরই এক রূপ। এটি মানুষের থাকবেই, লেখকদের লেখায় তা নিয়ে আসতেই হবে।

১৯৬৯ সালে লিখলেন লাইফ ইজ এলসহোয়ার, সেটি ১৯৮৯ পর্যন্ত নিজের দেশেই নিষিদ্ধ ছিল। তার নির্বাসনে থাকার সময়কার উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। বইটি প্রকাশ হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। অভিনব এর বিষয়বস্তু। বিপ্লবী রোমান্টিকতার সঙ্গে গীতিকবিতাকে মিশিয়ে দিয়ে বইটি রচনা করেছেন কুন্ডেরা। অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে এক দম্পতির বিবাহিত জীবন কেমন দাঁড়ায় তা নিয়ে নিরীক্ষা করেছেন।

তার পরবর্তী রচনা ‘‌ফেয়ারওয়েল পার্টি’। এটিও যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশ হয়। ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত এ উপন্যাসে হাস্যকৌতুকের মধ্য দিয়ে সরকার পরিচালিত ‘‌স্পা’ বা স্নানের বিনোদন ও অবসরযাপন প্রকল্পের সমালোচনা করা হয়েছে। তিনি একটি নৈতিক প্রশ্ন তুলেছেন, নারী সন্তান উৎপাদনের কৃত্রিম পদ্ধতির সমস্যা নিয়ে। এর পরের রচনা হাস্যকৌতুক ও ভুলে যাওয়া গ্রন্থ (১৯৮০) শীর্ষক উপন্যাসটি মার্কিন কথাসাহিত্যিক ফিলিপ রথের সঙ্গে তার আলাপচারিতাসহ প্রকাশ হয়। ব্যক্তিক আত্মসংরক্ষণের জন্য যে স্মৃতির প্রয়োজন, বইটি সে বিষয় নিয়ে লিখিত। কুন্ডেরার সফল উপন্যাসগুলো রচিত হ ১৯৭০ ও ১৯৮০-র দশকে। সেসব উপন্যাসের বিষয়-আশয় হচ্ছে প্রাগকেন্দ্রিক গৃহকাতরতা, নির্বাসন ও নির্বাসিত জীবনের বিচ্ছিন্নতাবোধ। ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হলে প্রাগ ও চেকস্লোভাকিয়া বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যুক্ত হয়। কুন্ডেরার তখন সুযোগ ছিল প্রাগে ফিরে যাওয়ার, কিন্তু তিনি প্যারিসেই থেকে যান আর প্যারিসেই তার মৃত্যু হলো। ১৯৭৬ সালে ফরাসি দৈনিক লে মন্ডকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, রাজনৈতিকভাবে চিহ্নিত করে তার লেখার ভার কমিয়ে দেয়া হচ্চে। এতে উপন্যাসের প্রকৃত তাৎপর্য অস্পষ্ট হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান থেকে ১৯৮০-এর দশক পর্যন্ত পূর্ব ইউরোপ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের কঠোর নিয়ন্ত্রণে। কেউ সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরোধিতা করলেই কঠোরভাবে তা দমন করা হতো। প্রাগ বসন্তের দিনগুলো কমিউনিস্ট চেক সরকার লেখক ও শিল্পীদের একটি স্তর পর্যন্ত বাকস্বাধীনতা দিয়েছিল। কিন্তু লেখক-শিল্পীরা এ স্বাধীনতা পেয়েছিলেন খুব অল্প সময়ের জন্য। কিছুদিনের মধ্যে সোভিয়েত ট্যাংকবহর শহরগুলোর রাস্তায় রাস্তায় নামে এবং পুরনো পদ্ধতি আবার লেখক-শিল্পীদের ওপর চেপে বসে। অন্য সংস্কারবাদী নেতাদের মতো কুন্ডেরাও অবদমনের শিকার হন। তার বইগুলো পাঠাগার ও বইয়ের দোকান থেকে উধাও হয়ে যায়। তিনি একাডেমির চাকরি হারান এবং স্বদেশে লেখালেখি ও বই প্রকাশ নিষিদ্ধ হয়ে যায়। তার প্রথম দুটি উপন্যাসের অনুবাদ বিদেশী পাঠকদের জন্য বিদেশ থেকে প্রকাশ হয়। স্বদেশে এ অনুমোদন ছিল না। বিদেশে তাকে যেতে দিত না। শুধু ফ্রান্স থেকে শিক্ষকতা করার আমন্ত্রণ পেলে কমিউনিস্ট সরকার তাকে বিদেশে অর্থাৎ ফ্রান্সে যাওয়ার অনুমতি দেয়। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত তিনি ফ্রান্সের রেনে বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যে অধ্যাপনা করেছেন। ১৯৮০ সালে তিনি অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন প্যারি ইকোল দে হুতে এতুদে অসায়েন্সে সোসিয়ালে। পরের বছর ফ্রান্সের স্বাভাবিক নিয়মে তিনি ফরাসি নাগরিকত্ব পান।

ছবি: এপি

১৯৮৪ সালে ‘‌দ্য আনবেয়ারেবল লাইটনেস অব বিয়িং’ উপন্যাসটি প্রকাশ হলে সাহিত্য মহলে আলোড়ন পড়ে যায়। কুন্ডেরা পরিচিত হতে শুরু করেন ‘‌দার্শনিক লেখক’ হিসেবে। তার পূর্ববতী রচনা ‘‌দ্য বুক অ লাফটার অ্যান্ড ফরগেটিং’ থেকেই রেনেসাঁস লেখক জভান্নি বোকাচ্চিও বা রাবেলাইয়ের প্রভাব তার রচনায় স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। এশিয়ার লেখকদের মধ্যে লিও টলস্টয়কে বেশি পছন্দ করতে কুন্ডেরা। তিনি বলেছিলেন, আমি টলস্টয়কে খুব পছন্দ করি। তিনি দস্তয়ভস্কির চেয়ে অনেক আধুনিক। টলস্টয়ই প্রথম, সম্ভবত মানুষের আচরণে অযৌক্তিক ভূমিকা উপলব্ধি করেছিলেন। ‘আন্না কারেনিনা’ উপন্যাসে কারেনিনা যে আত্মহত্যা করে তা নিয়ে কুন্ডেরার মন্তব্য হলো, কেন সে সত্যিই না চাইলেও আত্মহত্য করল? কীভাবে তার ভেতর এ সিদ্ধান্তের জন্ম হয়েছিল? অযৌক্তিক এবং অধরা এ কারণগুলোকে ধরতে টলস্টয় আন্নার চেতনার প্রবাহকে ধরতে চেয়েছেন।

মিলান কুন্ডেরার সাহিত্য বিচিত্র পথগামী। প্রাথমিক পর্বে তার লেখালেখিতে রাজনৈতিক উচ্চারণ প্রকট থাকলেও পরে তিনি সেই ধারা থেকে বেরিয়ে আসেন এবং ইউরোপীয় নগজাগরণ পর্বের সাহিত্যের উত্তরাধিকার তিনি বহন করছেন বলে জানান। সরাসরি রাজনীতি লেখকদের কাজ নন। তবে রাজনীতি যেহেতু মানুষের জন্য, লেখকরাও মানুষের আত্মিক জগতের পুষ্টি সরবরাহ করেন, সেখানে রাজনীতির সমালোচনা থাকবে। কিন্তু সেটিকে সরাসরি রাজনীতির নামে চালিয়ে দিলে সাহিত্যের গুরুত্বকে ছোট করে দেখা হয়। সাহিত্য অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্তভাবে সেটিকে প্রকাশ করে। তাই কুন্ডেরার সূক্ষ্ম রসবোধ, তির্যক বাচনভঙ্গি আর এক আপাত নির্লিপ্ততাই তাকে সবা চেয়ে আলাদা করে রেখেছিল। তার এ বিশেষ দর্শন ও ভঙ্গিমা একুশ শতকের বিশ্বসাহিত্যের একটা বড় অংশকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। গোপনীয়তা একটা অধিকার। গোপনীয়তা কেড়ে নেয়াকে কুন্ডেরা বলেছেন ধর্ষণের তুল্য। আমরা এমন একটা সময়ে বসবাস করছি যে আমাদের প্রতিনিয়ত নিপীড়ন করা হচ্ছে গোপনীয়তার অধিকার কেড়ে নিয়ে। কুন্ডেরার উক্তি ‘আমি তোমাকে সতর্ক করছি যে গুরুগাম্ভীর্য তোমাকে রক্ষা করে আসছে। তুমি যদি গাম্ভীর্য কমিয়ে দাও, তাহলে তুমি ক্ষুধার্ত নেকড়েদের সামনে পড়ে যাবে। তুমি জানো, তারা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। নেকড়েরা।’ এ তো দেখছি একবিংশ শতাব্দীর তথাকথিত রাজনীতি ও সভ্যতার প্রতিফলন।

মাছুম বিল্লাহ: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক, প্রেসিডেন্ট-ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন