রাজনৈতিক ও পরিচালকদের হস্তক্ষেপের দরুন ব্যাংক খাতের আজকের দুর্দশা

মামুন রশীদ প্রথিতযশা ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন অর্থনীতি ও ব্যবসায় প্রশাসনে। ২৫ বছরের অধিক সময় কাজ করেছেন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় তিনটি আন্তর্জাতিক ব্যাংকে—দেশে ও বিদেশে। ছিলেন সিটিব্যাংক এনএ বাংলাদেশের প্রথম স্থানীয় প্রধান নির্বাহী এবং বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকিংয়ের ইতিহাসে এ পর্যন্ত কনিষ্ঠতম প্রধান। ব্যাংকিংয়ে অভিনবত্ব ও উৎকর্ষের জন্য পেয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের ‘‌করপোরেট এক্সিলেন্স’ অ্যাওয়ার্ড। ব্যাংকিংসহ ব্যবসায় প্রশাসনের বিভিন্ন বিষয়ে পড়াচ্ছেন প্রায় ৩০ বছরের অধিককাল। দেশে-বিদেশে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও প্রকাশনায় ব্যাংকিং এবং সামষ্টিক অর্থনীতি নিয়ে ছাপা হয়েছে তার অনেক লেখা ও সাক্ষাৎকার। সম্প্রতি তিনি বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট ও আর্থিক খাত নিয়ে বণিক বার্তার নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাবিদিন ইব্রাহিম

সারা বিশ্বেই ব্যাংক ও আর্থিক খাত রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের ভবিষ্যৎ কোন পথে?

যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার পাশাপাশি সুইজারল্যান্ডের দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যাংক ক্রেডিট সুইসের পতনে প্রকাশ পাচ্ছে বিশ্বের আর্থিক খাতের দুরবস্থার চিত্র। শেষ মুহূর্তে প্রতিদ্বন্দ্বী ইউবিএস এজির কাছে বিক্রি করে দেয়ার মাধ্যমে ব্যাংকটির দেউলিয়াত্ব ঠেকানো গেলেও তা খাদের কিনারায় থাকা পশ্চিমা ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে কতটা উদ্ধার করবে তা এখনো পরিষ্কার নয়। অনেকটা আকস্মিকভাবেই সিলিকন ভ্যালিসহ তিন ব্যাংকের পতনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে মার্কিন আর্থিক ব্যবস্থায়। যার ধাক্কা অনুভূত হয় এশিয়া, ইউরোপের প্রধান সব পুঁজিবাজারেই। দেশের অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো এখনো দেউলিয়া না হলেও আসলে সেগুলোয় অনেক সমস্যা রয়েছে। আর এসব সমস্যার অনেকগুলো এরই মধ্যে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমেও চোখে পড়েছে। অর্থনীতিবিদরা মোটা দাগে কয়েকটি সমস্যা চিহ্নিত করেছেন। যার মধ্যে অন্যতম বড় সমস্যা হচ্ছে অনাদায়ী বা খেলাপি ঋণ। বাংলাদেশে এ সমস্যা আসলে নতুন কিছু নয়। বছরের পর বছর ধরে এটি চলে এলেও এ সমস্যার সমাধানে খুব একটা ব্যবস্থা নেয়া হয় না। এর আগে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলেছিল যে বাংলাদেশে বিতরণকৃত ঋণের এক-তৃতীয়াংশই খেলাপি। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রকাশিত পরিসংখ্যান বলছে, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা, যা মোট প্রদত্ত ঋণের ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী, কোনো দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২-৩ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত নয়। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এ হিসাব অনুযায়ী, এক বছরের ব্যবধানে দেশে খেলাপি ঋণ বেড়েছে সাড়ে ৩২ হাজার কোটি টাকা। শতকরা হিসাবে এটি ৩২ দশমিক ৮৭ শতাংশ। ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এসব ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের ২৩ শতাংশই খেলাপি। একই সময়ে দেশের বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৬৬ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকা, যা কিনা এসব ব্যাংকের মোট ঋণের ৬ দশমিক ২০ শতাংশ।

ব্যাংক খাতের আরেকটি অন্যতম বড় সমস্যা হচ্ছে ব্যালান্স শিট বা স্থিতিপত্র। এখানে অনেক তথ্য ভুলভাবে প্রদর্শন করা হয়। ব্যাংকের সম্পদগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় অংশ হচ্ছে ব্যাংক থেকে বিতরণ করা ঋণ। এ ঋণের মধ্যে ভালো ঋণ কতটা আর মন্দ ঋণ কতটা সে হিসাব প্রায়ই ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। কোনো ঋণ সুদে-আসলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফেরত পাওয়া না গেলে তাকে মন্দ ঋণ বলা হয়। কোনো ব্যাংকে যদি মন্দ ঋণ বা নন-পারফর্মিং লোন বেশি থাকে, তাহলে বলা হয় যে সেই ব্যাংকের সম্পদের মান ভালো নয়। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক এখন আর কোনো ব্যাংকের দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ কত তা প্রকাশ করে না। দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ সামাল দেয়ার মতো সক্ষমতা যে সূচক দিয়ে নির্দেশ করা হয় সেটা হচ্ছে ক্যাপিটাল অ্যাডিকোয়েসি রেশিও বা পর্যাপ্ত মূলধনের পরিমাণ কেমন। আরেকটি হচ্ছে, যে ঋণগুলো দুর্দশাগ্রস্তের তালিকায় রয়েছে সেগুলো ঠিকমতো প্রভিশন করা হচ্ছে কিনা। বাংলাদেশের অনেক ব্যাংকেই পর্যাপ্ত মূলধন নেই। এটি ব্যাংক খাতের একটি বড় সমস্যা। বর্তমানে ব্যাংকগুলোয় তারল্যের ওপর চাপ বাড়ছে। আর তারল্যের ওপর চাপ বাড়লে মানুষের মনে শঙ্কা তৈরি হয়। 

ব্যাংকগুলোয় সুশাসনের অভাব এবং দুর্নীতির অভিযোগ সামনে আসার পর কঠোর ব্যবস্থা না নেয়াও ব্যাংক খাতের অন্যতম একটি বড় সমস্যা। সুশাসনের অভাব, বেপরোয়া দুর্নীতি, ব্যাংক পরিচালনায় রাজনৈতিক ও পরিচালকদের হস্তক্ষেপ এবং খেলাপি ঋণের মাত্রাতিরিক্ত ঊর্ধ্বগতির কারণেই মূলত এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। করোনা ও বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব এ দুর্বলতাকে আরো গভীরে নিয়ে গেছে। বিশেষ করে নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক গতিতে বৃদ্ধি পাওয়ায় তা প্রকাশ্যে চলে আসে। এতে মানুষ নতুন করে সঞ্চয় করতে পারছে না। বরং আগের সঞ্চয় ভেঙে সংসারের ব্যয় নির্বাহ করছে। ঋণ পরিশোধ কমে গেছে। বিশেষ ছাড়ে ঋণকে নিয়মিত রেখে কোনো সুদ আদায় না করেও কাগুজে মুনাফার মাধ্যমে আয় বাড়ানো হয়েছে। বিশেষ ছাড়ের পরও খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। খেলাপির মধ্যে আদায় অযোগ্য বা কুঋণের পরিমাণই অনেক বেশি। বড় ঋণগ্রহীতাদের ঋণের বড় অংশই এখন কুঋণে পরিণত হয়েছে। সংকটের স্বীকৃতি দিয়েই সমাধানের পথে এগোতে হবে। সংস্কার করতে হবে, যে পদ্ধতিতে আমরা ঋণ ঝুঁকি পর্যালোচনা করছি, ঋণ বিতরণ করছি, ঋণ আদায় করছি এমনকি খাতওয়ারি ঋণ প্রদানের বিষয়েও। ব্যাংক খাতের সাফল্য কিন্তু ধীরে ধীরে রাষ্ট্রের সুশাসনের সঙ্গেও সম্পৃক্ত হয়ে গেছে। তাই বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রাঙ্গণে স্বচ্ছতা আর জবাবদিহি নিশ্চিত না করতে পারলে ব্যাংক খাতেও সুশাসন নিশ্চিতকরণ সম্ভব নয়।

বলা হচ্ছে, প্রযুক্তিনির্ভরতা ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে ব্যাংক খাতের অনেক পদই বাতিল হয়ে যাবে। বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে এর প্রভাব আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআইয়ের প্রয়োগ নিয়ে গোটা পৃথিবীতে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। ক্রমে এর ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমীক্ষা জানাচ্ছে, আগামী পাঁচ বছরে বিশ্বজুড়ে কাজ হারাতে পারে ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষ। এমনই জানাচ্ছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম বা ডব্লিউইএফের রিপোর্ট। যেভাবে প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে, বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার উন্নয়ন ঘটছে, তাতে কর্মক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত খুলছে। একই সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে বিভিন্ন সংস্থায় কর্মী সংকোচন হবে বলে মনে করছেন গবেষকরা। তারা এ-ও জানাচ্ছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বহুল ব্যবহারের ভালো দিক যেমন আছে, তেমনই রয়েছে নেতিবাচক কিছু বিষয়। তার মধ্যে অন্যতম হলো কর্মী ছাঁটাই। 

আগামী পাঁচ বছরে কোন কোন পেশায় এআইয়ের প্রভাব পড়তে পারে সম্প্রতি তার একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। ব্যাংকের চাকরির ক্ষেত্রে এআইয়ের একটি বড় প্রভাব পড়তে পারে। ‘অনলাইন ব্যাংকিং’-এর সুবিধা থাকায় এমনিতেই এখন ব্যাংকের কর্মীদের কাজ অনেকটাই কমেছে। তবে কয়েক বছরে এআইয়ের কল্যাণে সশরীরে ব্যাংকে গিয়ে প্রয়োজন মেটানোর আর দরকার হবে না। এর ফলে গোটা বিশ্বজুড়ে কাজ হারাতে পারেন অসংখ্য ব্যাংক কর্মী। এআইয়ের কারণে আগামী পাঁচ বছরে পোস্টাল সার্ভিস ক্লার্ক, ডাটা এন্ট্রি কর্মী, ক্যাশিয়ার, হিসাবরক্ষক এ ধরনের পদগুলো প্রায় এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি হ্রাস পেতে পারে। সম্প্রতি এআইয়ের কার্যকারিতা নিয়ে একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে উঠে এসেছে, ২০২৭ সালের মধ্যে ৬ কোটি ৯ লাখ নতুন কর্মের সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং ৮ কোটি ৩ লাখ মানুষ কর্মহীনও হয়ে পড়বে। এর অর্থ, আগামী ছয় বছর শুধু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বহুল ব্যবহারে প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষের কাজ চলে যাবে, যা বর্তমান কর্মসংস্থানের প্রায় ২ শতাংশ।

রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করার চেয়ে হুণ্ডি-হাওলা নির্ভরতা বেশি। ব্যাংক কেন আস্থার জায়গা অর্জন করতে পারছে না?

প্রবাসী শ্রমিকরা যখন টাকা পাঠান, তখন তারা তিনটি বিষয় বিবেচনা করেন। সেগুলো হলো—কত টাকা পাওয়া যাবে, কত সহজে পাঠানো যাবে এবং কমিশন কত। প্রবাসী শ্রমিকরা কিন্তু অনেক সাবধান। তারা জানেন, কোথায় বেশি টাকা পাবেন। প্রবাসীদের আয়ে যে বছর প্রণোদনা দেয়া হলো, সে বছরই রেমিট্যান্স বেড়েছিল। প্রবাসী শ্রমিকদের তেমন সুবিধা দেয়া হচ্ছে না। এ অবস্থায় তারা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে বৈধ মাধ্যমে টাকা পাঠাবেন—এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। যদি আমরা চাই, তারা বৈধ পন্থায় টাকা পাঠাক, তাহলে তাদের সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। এ মুহূর্তে যদি সেবা বাড়ানো হয়, তাহলে কিছুটা হলেও রেমিট্যান্স বাড়বে। যারা বিদেশে যাচ্ছেন, তাদের ‘বেনিফিশিয়ারি’ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, অর্থাৎ যাদের টাকা পাঠানো হবে, তাদের কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে কিনা দেখা দরকার। আবার রিক্রুটিং এজেন্টকে বলতে হবে, যারা যে দেশে যাবেন, তার বেতন ওই দেশের কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্টে যেন দেয়া হয়। এই অ্যাকাউন্ট থেকে যেন একটা অংশ দেশে তার পরিবারের কাছে চলে যায়, সে ব্যবস্থাও করতে হবে। প্রয়োজনে ব্যাংক কর্মীরা প্রবাসীদের উৎসাহী করতে তাদের ও তাদের পরিবারের কাছে যেতে পারেন, যাতে তারা ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠান। 

সম্প্রতি ৯ শতাংশ সুদহার সীমা তুলে দেয়া হয়েছে। এ সিদ্ধান্তকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?

সুদহার বাড়লে চাহিদা কমবে, এমন ধারণা থেকেই এ মুদ্রানীতির নীতিগত অবস্থান নেয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট অনেকে বলছেন। বিদ্যমান ৯ শতাংশ সুদহারের সীমা তুলে দিয়ে জুলাই থেকে নতুন পদ্ধতি চালু হয়েছে। এতে বাজারে সামগ্রিকভাবে সুদহার বাড়বে। অবশ্য নতুন ব্যবস্থায় বড় ঋণের তুলনায় ছোট ঋণে সুদ বাড়বে বেশি। তবে সুদের হার বাড়ার কারণে ব্যাংকগুলো আরো বেশি বিনিয়োগে আগ্রহী হবে এবং একই সঙ্গে শিল্পক্ষেত্র তাদের পরিচালনার জন্য আরো বেশি মূলধন পাবে। এটা অর্থনীতির ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে ব্যাংক খাতে আমানত বেড়েছে ৮৬ হাজার কোটি টাকা। আর একই সময়ে ঋণ বেড়েছে ১ দশমিক ৭২ লাখ কোটি টাকা। তার মানে হচ্ছে, ব্যাংক খাতে ঋণ যে হারে বেড়েছে সেই হারে আসলে আমানত বাড়েনি। ফলে তারল্য সংকটের সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। তবে শুধু ঋণ বাড়ার কারণে নয়, বরং মূল্যস্ফীতি ও মানুষের আয় না বাড়ার কারণে গ্রাহকদের সঞ্চয় কমে যাওয়া আমানত কমার একটি বড় কারণ। অনেকেই পুরনো সঞ্চয় ভেঙে খরচ করেছেন বা করছেন।

সুদের হার বাড়াতে ব্যাংক লাভজনক হবে। কারণ এর ফলে আমানতের সুদহারও বাড়বে বিধায় ব্যাংকের আমানত বা নগদ অর্থের প্রবাহ বাড়বে। এখন ৯ শতাংশ সুদহার সীমা তুলে দেয়ার ফলে ডিপোজিট বা আমানতের ওপর বেশি সুদ দেয়া যাবে। ফলে মানুষ ব্যাংকে আমানত রাখবে এবং বেশি সুদের আশায় অন্য বিপজ্জনক বিকল্প উপায়ের দিকে ঝুঁকবে না। এতদিন সুদের হার ৯ শতাংশ রাখায় শুধু ব্যাংক নয়, বরং আমানতকারীরাও সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলেন। শুধু লাভবান হচ্ছিলেন ঋণগ্রহীতারা। এখন সুদের হার বাড়াতে ডিপোজিট বা আমানত আরো বাড়বে এবং একই সঙ্গে এটি ব্যাংক খাতকে উজ্জীবিত করবে।

আমাদের নতুন মুদ্রানীতিতে খেলাপি ঋণ ঠেকাতে পর্যাপ্ত কর্মসূচি দেখছেন কি? খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলোর ব্যর্থতাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?

খেলাপি ঋণ কমানোর বিষয়ে নির্দিষ্টভাবে মুদ্রানীতিতে কিছু বলা দরকার ছিল। বরং তা না করে আমরা দেখতে পাচ্ছি, বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন সার্কুলারে আবারো ঋণখেলাপিদের সুবিধা দেয়া অব্যাহত রাখা হয়েছে। তাছাড়া আমি মনে করি, খেলাপির জন্য মোটাদাগে দায়ী কতিপয় ব্যাংকারও। ব্যবসায়ীদের ঋণ পাস করার কোনো ক্ষমতা নেই এবং ব্যাংকারের তুলনায় অনেক বেশি ব্যবসায়ী বর্তমানে জেলে কিংবা পলাতক আছেন। তবে এটার জন্য তথ্য-উপাত্তের সমর্থন প্রয়োজন। সরকারি ব্যাংকে রাজনৈতিক চাপ আছে, কিন্তু বেসরকারি ব্যাংকে তো রাজনৈতিক চাপ নেই, তাহলে কেন বেশ কয়টি বেসরকারি ব্যাংকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষক বসাতে হলো! গত নভেম্বরে তিন ইসলামী ব্যাংক থেকে কীভাবে ঠিকানাবিহীন মজুর-কর্মচারীদের নামে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খুলে শত শত কোটি টাকা লোপাট হলো?

জনতা ব্যাংক ও অগ্রণী ব্যাংকের দুই এমডির প্রস্থানের পর দুই ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে, কিন্তু কোনো এমডি তো রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে ঋণ বিতরণে অপারগতা প্রকাশ করে পদত্যাগ করেননি। রাজনৈতিক প্রভাবে ব্যাংক খাত ধীরে ধীরে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ধাবিত হচ্ছে। আর্থিক খাত হলো দেশের প্রাণ, এটাকে নষ্ট করা মানে নিজেদের দুর্ভোগ ডেকে আনা। জনগণের বাজেটের টাকা দিয়ে ব্যাংকের মূলধন জোগান দেয়া হচ্ছে, কিন্তু ব্যাংক খাতকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা হচ্ছে না। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের চাপে কখনো কখনো এ খাতে কিছু সংস্কার দেখা গেলেও স্থায়ী কোনো সংস্কার এ পর্যন্ত চোখে পড়েনি। তবু আশায় আছি, সরকার কোনো না কোনো সময় ব্যাংকগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে সংসদে আইন পাসের উদ্যোগ গ্রহণ করবে।

ইপিবির সাম্প্রতিক উপাত্তে দেখা গেছে, রফতানি কমলেও অর্থমূল্য বেড়েছে। আমাদের আমদানি-রফতানি তথ্যের ফারাককে আপনি কীভাবে বিশ্লেষণ করবেন?

আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে (আমদানি মূল্য প্রকৃতের চেয়ে কম দেখানোর কৌশল) ব্যবসায়ীদের অনেকেই শুল্ক ফাঁকি দিচ্ছেন। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েসিংয়ের (মূল্য বাড়িয়ে দেখানো) মাধ্যমে চীন হয়ে তৃতীয় কোনো দেশে অর্থ পাচারের অভিযোগও মিলছে। ব্যবসায়ীদের এ দাম বাড়িয়ে-কমিয়ে দেখানোর প্রবণতাকেই এখন দুই দেশের বাণিজ্য পরিসংখ্যানে গরমিলের মূল কারণ হিসেবে দায়ী করা হচ্ছে। আমদানি-রফতানি পণ্যের দাম বাড়িয়ে-কমিয়ে দেখানোর কারণে দুই দেশের তথ্যে গরমিলের অভিযোগটিকে উড়িয়ে দিতে পারছেন না নীতিনির্ধারকরাও। পাশাপাশি বন্ড সুবিধা ও আমদানিকে হিসাবে না নেয়াও তথ্যগত ব্যবধানের কারণ হতে পারে।

চলতি অর্থবছরে ৭২ বিলিয়ন ডলার পণ্য ও সেবা রফতানি লক্ষ্যমাত্রার কথা জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ সম্ভব হবে কি?

বিদায়ী অর্থবছরে রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আয় হয়েছে ৬৪ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এবার রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা গত বছরের অর্জিত আয়ের চেয়ে ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ বাড়িয়ে ৭২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার নির্ধারণ করা হয়েছে।

বাংলাদেশের রফতানি থেকে আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা অর্জন করতে হলে অন্যান্য রফতানিকারক দেশ থেকে ২০-২৫ শতাংশ রফতানি অর্ডার বাংলাদেশকে আনতে হবে। ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপে চীনের রফতানি কমায় সরবরাহের যে ঘাটতি তৈরি হচ্ছে, তা পূরণ করার সুযোগ বাংলাদেশের সামনে রয়েছে। কিন্তু গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের কারণে যদি শিল্প-কারখানাই অচল থাকে এবং ডলারের অভাবে যদি প্রয়োজনীয় পণ্য বা কাঁচামাল আমদানি ব্যাহত হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে সৃষ্ট সুযোগ কাজে লাগাতে ব্যর্থ হবেন রফতানিকারকরা। জ্বালানি ও ডলার সংকটের সমাধান না করলে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যাবে না। ডলার সংকটের কারণে যদি এলসি খোলা না যায়, গ্যাস সংকটের কারণে যদি শিল্প চালানো না যায়, তাহলে এ লক্ষ্য অর্জন করা শুধু যে কঠিন হবে তা-ই নয়, বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় এটি উচ্চাভিলাষী।

রাশিয়া রুপিতে লেনদেন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এমন পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে রুপিতে লেনদেনকে কীভাবে দেখছেন?

ভারতের সঙ্গে রুপিতে লেনদেনের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে মার্কিন ডলারের পাশাপাশি অন্য কোনো মুদ্রাকে গ্রহণ করেছে। বলা হচ্ছে, রুপিতে শুরু হলেও উভয় দেশের বাণিজ্য ব্যবধান একসময় কমে এলে বাংলাদেশী মুদ্রা টাকায়ও হবে এ বাণিজ্য। ফলে ভারতের সঙ্গে আমদানি-রফতানির বেলায় বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা রুপিতে এলসি খুলতে পারবেন। ভারতীয় রুপিতে লেনদেন হলে সুবিধা স্পষ্ট না হলেও অসুবিধার যথেষ্ট কারণ আছে। কারণ আমরা রফতানি করি কম, আমদানি করি বেশি। আমরা তো আমদানিনির্ভর দেশে পরিণত হচ্ছি। রফতানি করলে তারা রুপিতে শোধ করবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমদানির এত রুপি কোথা থেকে পাওয়া যাবে? এটা তো পরিষ্কার, ডলার ভাঙিয়ে আমদানি দায় শোধ করতে হবে। অথবা ভারতকে আমদানি ব্যয় ডলারে দিতে হবে। তাতে আমাদের বিশেষ কোনো লাভ নেই। আবার ভারতও টাকা নিতে চাইবে না। কারণ তারা টাকা কোথায় খরচ করবে? যেমন ভারত রাশিয়া থেকে রুপিতে অনেক কিছু কিনেছে। এখন জানা যাচ্ছে, রাশিয়া বলছে ভারতীয় রুপি তারা খরচ করতে পারছে না। ফলে রাশিয়া আর এখন রুপিতে লেনদেন করতে রাজি হচ্ছে না। বাংলাদেশ ঠিক কোন বিবেচনায় এটি করতে সম্মত হয়েছে সরকারের তরফ থেকে সুফলের দিকটা জনগণের সামনে পরিষ্কার করার দরকার এখনই। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ডলার সংকটে রয়েছে উভয় দেশ। ফলে উভয় দেশ রুপিতে লেনদেন করলে লাভবান হতে পারে। ডলার পরিহার করায় আমদানি-রফতানিকারকদের মুদ্রা বিনিময় খরচ কমবে। পারস্পরিক লেনদেন সম্পন্ন করতে সময় বাঁচবে। কিন্তু যেটি আগেই উল্লেখ করেছি, বৈশ্বিক মুদ্রা হিসেবে এখনো স্বীকৃত মুদ্রা নয় ভারতীয় রুপি। তাই রুপিতে বাণিজ্য করার ক্ষেত্রে ঝুঁকির বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে। বিষয়টি যে একেবারেই ঝুঁকিমুক্ত তা বলা যাবে না। এর অন্যতম ঝুঁকি হচ্ছে বিনিময় হার। এটা প্রথমে নির্ধারিত হতে হবে। আমরা জানি, বাংলাদেশী মুদ্রা টাকা বর্তমানে অবমূল্যায়িত হয়ে আসছে। দিন দিন টাকার মূল্য কমছে। আমরা ইতিবাচকভাবে আশা করতে চাই, এটি ভবিষ্যতে হয়তো শক্তিশালী হতে পারে। লক্ষ রাখতে হবে, তখন যেন ভারতীয় মুদ্রার সঙ্গে বিনিময় হারে সামঞ্জস্য আনা হয়। এর প্রতিফলন ঘটাতে হবে। কিছু বিষয় নিয়ে তাই সতর্কতা জরুরি বলে মনে করি। প্রথমত, মুদ্রা বিনিময় হার নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে। বাংলাদেশ যেন ক্ষতির ভাগীদার না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন