আমাদের রক্তের মধ্যে নিহিত বৃষ্টির অর্কেস্ট্রা

মইনুদ্দীন খালেদ

সিটি ইন রেইন শিল্পী শাহনূর মামুন, সৌজন্যে: গ্যালারি কায়া

বৃষ্টিপ্রধান এ দেশের মানুষ মেঘের শব্দ শুনে আনমনা হয়ে পড়ে; উৎকর্ণ হয়ে থাকে বৃষ্টির শব্দের অপেক্ষায়। আমাদের এ উন্মনা হওয়ার অভিজ্ঞতা বহু যুগের, দূর অনাদি অতীত থেকে প্রবাহিত। হয়তো আদি মানব বৃষ্টির শব্দে প্রথম যে শিহরিত হয়েছিল তারই স্পন্দন কাজ করে যায় আজও আমাদের মনে। পৃথিবীর অনেক অংশেই মেঘ ও বৃষ্টি নিয়ে অনেক পুরাণকল্প গল্প রচিত হয়েছে। মানুষ বৃষ্টিকে প্রার্থনা করে সংকীর্তনে; মেঘকে পরমাত্মীয় জ্ঞানে আবাহন জানায়। বৃষ্টিকীর্তন আর মেঘকাহনের সমগ্রটা বিচিত্রভাবে বিপুল। কালিদাসের যক্ষ মেঘের দূতিয়ালিতে তার প্রেম সম্প্রচারিত করেছিল। রাধার বর্গাভিসারেই প্রেম সবচেয়ে তীব্র ও রক্তিম। আমাদের লোকছড়ায় বৃষ্টিকে নানা সম্বোধনে ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। বনবাসের দুঃখের মধ্যে বর্ষা প্রকৃতি রামকুলকে বিকশিত সবুজের শুশ্রূষা দিয়েছিল। জয়দেব তার গীত গোবিন্দে বর্ষার যে রূপ বর্ণনা করেছেন তা তার শব্দের রসায়নে জারিত।

যক্ষ বা রাধার পৌরাণিক আখ্যান অনেকবারই ভারতের বা সুনির্দিষ্টভাবে বাংলার শিল্পীরাও রূপায়িত করেছেন। বিশেষ করে নব্য বঙ্গরীতির উদ্‌গাতা অবনীন্দ্রনাথ ও তার শিষ্য নন্দলাল যথাক্রমে মেঘ ও বিদ্যুচ্চমকিত রাত্রির ব্যঞ্জনা জানান দিয়ে বিরহী যক্ষ ও প্রেম-উদ্ভিন্ন রাধাকে রূপায়িত করেছেন। তবে ঋতু যেখানে নিজেই কুশীলব বা স্বয়ং প্রকাশিত সেই সুখ্যাত ‘‌রাগমালা’ চিত্রধারায় বর্ষার রূপ-বর্ণে বিভূষিত হয়ে প্রকাশ পেয়েছে। মোগল চিত্রকলায়ও ঋতুর রঙ ও রূপ স্পষ্ট।

আমাদের রক্তের মধ্যে নিহিত আছে বৃষ্টির অর্কেস্ট্রা। বাংলাদেশ জলের দেশ। এত নদীর দেশ পৃথিবীতে আর নেই। এত জল স্বভাবতই রহস্যের আবেশ তৈরি করে। বৃষ্টির জল আর অনেক রকমের জলধারার জলের সমন্বয়ে সেই আবেশ আরো বেশি করে আমাদের কুহকের পথে চালিত করে। জলের শব্দে আমরা অন্তরে প্রবেশ করি এবং নিজেরই সত্তার কোনো গভীরতর দেশে গিয়ে নিজেই নিজের আয়নায় যেন একা হয়ে যাই। জল মূলত আমাদের এমনই এক নির্জনলোকে প্রেরণ করে।

বাংলাদেশের গুরু শিল্পীরা এবং পরবর্তী প্রজন্মের অনেক প্রধান শিল্পী এই জলের দেশকে জল দিয়েই মাপতে চেয়েছেন। এ পথেরই উত্তরসাধক মুস্তাফা মনোয়ার, বীরেন সোম, মনিরুল ইসলাম, তরুণ ঘোষ, অলকেশ ঘোষ, কাজী গিয়াসউদ্দিন, শাহনূর ইসলাম, রশীদ আমিনরা। ক্যানভাসে তারা বাংলাদেশের বর্ষার রূপ চিত্রার্পিত করেছেন। 

মেঘলা আকাশ, ব্যাপ্ত নদী, ভেজা উদ্ভিদ প্রকৃতি এসবই ছিল মূলত এ দেশের জলরঙের ছবির লক্ষ্য। জলরঙে দর্শক মূলত জলের স্বভাবটাই নিবিড় মনোযোগে পাঠ করে। প্রকৃতি অবলোকনের একটা চোখ-চেনা-রূপ ধরে জলরঙকে যথেচ্ছ বিচরণের পথ উন্মুক্ত রাখাই এ ধারার চিত্রের বৈশিষ্ট্য। বর্ষায় জলের শব্দে অনেক রাগ-অনুরাগে আপ্লুত হয়ে যায় মন। জলের বিচিত্র শব্দ, শব্দের ভারের তারতম্য, শব্দের তরঙ্গ ও গতিপ্রকৃতিকে শিল্পীরা মানুষের হৃদয়ের সারণির মতো বুঝতে চেয়েছেন। তাদের মনে বর্ষার সিক্ততা ও বিচিত্র শব্দ যে অনুভূতিজাল বুনেছে, সেই বুননকে প্রক্রিয়ারত ও সচলভাবে প্রদর্শন করতে চেয়েছেন। রঙের সঞ্চরণশীলতায় বাংলার প্রকৃতির এই রোদ, এই বৃষ্টির দোলাচলে অনুভবকাতর হৃদয়ের সমীকরণ পরিস্ফুট করেছেন।

আমরা শিল্পীমনের অন্তর্লোকের নিগূঢ় প্রদেশে প্রবেশ করতে পারি না। তবে শিল্পীদের রেখাময়ী, বর্ণময়ী রূপ দেখে বুঝি যে এতে ইন্দ্রিয়ের অনুভূতির নিবিড় চাপ রয়েছে। বলা যায় ইন্দ্রিয়ঘনত্ব একটা অবস্থারই রূপায়ণ তাদের চিত্রকর্ম। এ ছবির অভিজ্ঞতা স্বভাবতই হৃদয়ের রক্তে পরিশ্রুত হয়ে এসেছ। তারা যে মেঘডুম্বুর করে বর্ণকে অভিসারে প্রশ্রয় দিয়েছেন কিংবা রেখার কম্পমান ও ললিত বিস্তার ঘটিয়েছেন তাতে আমরা এ কথা স্বচ্ছভাবে অনুভব করি যে বর্ষা বা বৃষ্টিরমুখরতা আমাদের একাকী একটা পরিধির মধ্যে দাঁড় করিয়ে দেয়। প্রথমত, চোখে দেখি ও কানে শুনি, কিন্তু পরিণামে আমরা একটি একান্তভাবে নিজস্ব মনোভূমিতে দাঁড়িয়ে নিজের সঙ্গে নিজেই কথা বলি। 

ঢেউ খেলানো রেখা, যা মেঘ ও বৃষ্টির শব্দজাত এবং যা অবিশ্রাম ও অননুমেয় বোধের অনন্ততা নির্দেশ করে চলেছে আর বর্ণের বিভূতিরাশি যা কখনো উজ্জ্বল চিক্কন এবং যা বিমূর্ত ভাষায় লাবণ্য ছড়ায় এবং কখনো যা আলোহীন মেঘলা দিনের সন্ধ্যার মতো কালো চোখের মতো গভীর জলের প্রবঞ্চ তৈরি করে, সেসব বোধের স্মারক যেন শিল্পীদের ক্যানভাসে বর্ষাকীর্তন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন