রঙে বর্ষাযাপন

সিলভিয়া নাজনীন

মেঘমল্লার ১১ শিল্পী রশীদ আমিন, সাউন্ড অব রেইন, শিল্পী কাজী গিয়াসউদ্দিন

আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে--

আসে বৃষ্টির সুবাস বাতাস বেয়ে।

এই পুরাতন হৃদয় আমার আজি

পুলকে দুলিয়া উঠিছে আবার বাজি

নূতন মেঘের ঘনিমার পানে চেয়ে

আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে।

(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)  

বাংলার প্রকৃতিতে মানুষ একাকার হয়ে যায় সৃষ্টিশীলতার মাঝে। দৃশ্যমান যেই জগতের অংশ আমরা, সেখানে অন্যের দৃষ্টির সঙ্গে আমাদের দৃষ্টি মিলেমিশে যায়, দৃশ্যমান রূপকল্প তৈরি হয় এভাবেই। এভাবেই তৈরি হয় মানুষের কালেক্টিভ দেখার স্মৃতি। আমাদের একান্ত অভিজ্ঞতাকে যেমন আমরা খুঁজে বের করি স্মৃতির অতল থেকে, তেমনই আমাদের কালেক্টিভ স্মৃতির রাজ্য তৈরি হয় প্রকৃতিতে আমাদের সম্পর্কময় বিচরণের সাথে সাথে। শিল্পীর আঁকা ছবির সঙ্গে আমাদের স্মৃতির অন্ত্যমিল দেখে আমরা চমকে উঠি প্রায়ই, এ কারণেই। 

আমরা সাধারণভাবে কখনো কখনো শুধু তাকাই, কিন্তু দেখি না। অথচ এই ‘দেখা’ অর্থাৎ চারপাশের সঙ্গে আন্তঃসম্পর্ক তৈরির এ প্রচেষ্টা আমাদের মানসিকভাবে সক্রিয় রাখে, আর এ উপলব্ধিই একজন শিল্পীকে বর্তমান রাখে। মুহূর্তকে ধরে রাখার আকাঙ্ক্ষা তাই আমরা শিল্পীদের ক্যানভাসে দেখতে পাই। দৃশ্যমান সব ইমেজ মানুষ তার মনোজগতে তৈরি করে, আর শিল্পীরা সেটা রঙিন চিত্রজগতে নিয়ে আসেন। দৃশ্যগত পারস্পরিকতা চাক্ষুষ জগতের কেন্দ্র। শিল্পীর দৃষ্টি আমাদের চেতনাকে সমৃদ্ধ আর সজীব করে। 

বাংলাদেশের প্রকৃতির যে রূপ-সৌন্দর্য তা উজাড় করে দেয় বর্ষা ঋতু। আষাঢ়-শ্রাবণ এ দুই মাসে প্রকৃতি হয়ে ওঠে স্নিগ্ধ আর সতেজ। এ সতেজ-সবুজের সমারোহ চিত্রশিল্পীদের আচ্ছন্ন করে রেখেছে যুগ যুগ ধরে। অধরা প্রকৃতিকে অভিব্যক্তিক গুণ, কল্পনা আর চেতনার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করে থাকেন শিল্পী। আমরা যখন কোনো নিসর্গচিত্র দেখি, তা আমাদের দৃশ্যকল্পের ভেতরে নিয়ে যায়, হয়তো কোনো এক নিজস্ব ইতিহাসের ভেতরে। শিল্পীর সেই নিজস্ব গল্প আমাদের জানা না থাকলেও আমরাও সেই জগতে ঘুরে বেড়াই। একটা পাহাড়ের ছবির মধ্য দিয়ে আমরা পাহাড়ের শক্তি, ক্ষমতা আর বিশালত্বকে অনুধাবনের চেষ্টা করি। আবার একটা নদীর বয়ে চলার মধ্য দিয়ে জীবনের প্রবহমানতা অনুভব করি। শিল্প, প্রকৃতি আর জীবনের ত্রিমাত্রিক আস্বাদন। আবার বর্তমান সময়ে বসে অতীতের প্রকৃতিতে ফিরে যাওয়া, শিল্পীর তুলির আঁচড়ের শক্তি এখানে ক্ষমতার সুষম আবহ তৈরি করে। কখনো শিল্পী প্রকৃতির প্রতিলিপি তৈরি করে দর্শককে বাস্তবের সামনেও হাজির করে, এ দেখাটি নিতান্তই সরল। কখনোবা একটি ছবির মধ্য দিয়ে শিল্পী প্রকৃতির রহস্যময়তা নির্মাণেও আগ্রহী হন। শিল্পীরা প্রকৃতির রহস্যময় সৌন্দর্য এবং পৃথিবীর বৈচিত্র্যময় নিসর্গে সীমাহীন অনুপ্রেরণা খুঁজে পেয়েছেন সবসময়। 

বর্ষাকালের অবকাশ, প্রকৃতির সান্নিধ্যে প্রাণশক্তির উদযাপন, জল ও বৃষ্টির উৎসের সঙ্গে যুক্ত ঐশ্বরিক শক্তির প্রতি বন্দনা প্রাচীনকাল থেকে আমাদের সাহিত্য, সংগীত ও শিল্পকলায় উপস্থিত থেকেছে। সাধারণত আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে আমাদের অঞ্চলে নাটকীয় মেঘের বিচরণ, তীব্র বৃষ্টিপাত নিয়ে বর্ষা নেমে আসে। শিল্পীদের ক্যানভাসে এ বর্ষা ও বৃষ্টির নানাবিধ চিত্রমালা আমাদের সামনে হাজির হয়। বর্ষা হলো অধীর প্রত্যাশিত ঋতু, কারণ গ্রীষ্মের তাপপ্রবাহ পেরিয়ে জীবন টিকিয়ে রাখে বর্ষা, আমাদের ল্যান্ডস্কেপে পরিবর্তন নিয়ে আসে এবং মানুষের আত্মার নতুন উদ্‌গিরণ ঘটে সেখানে। আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা, কাদামাটির মেঠোপথ, পালতোলা নৌকা—এসব দৃশ্য আমাদের বর্ষা ঋতুর দৃশ্যকল্পের অতিপরিচিত উপাদান। শিল্পীরা এই চিত্রগুলো নির্মাণ করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত, আর দর্শক হিসেবে আমাদের সেই বর্ষারূপের আস্বাদন দিচ্ছেন।

এ অঞ্চলের জীবন-জীবিকার একটি অবিচ্ছেদ্য বৈশিষ্ট্য হিসেবে বৃষ্টি বহুকাল ধরে বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনী, আচার-অনুষ্ঠান আর কাব্যিক অভিব্যক্তির মধ্য দিয়ে উদযাপিত হয়ে আসছে। বর্ষা সামাজিক-সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিফলিত ও প্রসারিত করেছে। বাংলাদেশের চিত্রশিল্পীরা বর্ষাযাপনের অভিজ্ঞতাগুলোকে প্রকাশ করেছেন তাদের চিত্রপটে। বিশেষত জলরঙে আঁকা বর্ষার ছবি আমাদের আলোড়িত করে। 

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন থেকে শুরু করে আমাদের প্রথিতযশা শিল্পীদের অধিকাংশই নানা মাত্রায় বর্ষাকে উদযাপন করেছেন তাদের চিত্রতলে। শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার, অলকেশ ঘোষ, মনিরুল ইসলাম, কাজী গিয়াসউদ্দিন, রফিকুন নবী, বীরেন সোম, হামিদুজ্জামান খান, আবুল বারক আলভী, ফরিদা জামান প্রমুখ প্রথিতযশা শিল্পীর চিত্রকর্মে আমরা নানা কম্পোজিশন, রঙ, রেখা, বিষয়-বৈচিত্র্যে বর্ষার আবাহন দেখতে পাই। স্যাপ গ্রিন, ভিরিডিয়ান গ্রিন, কারমাইন রেড, স্কারলেট রেড, লেমন ইয়েলো, ইয়েলো অকার, বার্ন্ট সিয়েনা, কোবাল্ট ব্লু, আইভরি ব্ল্যাক ইত্যাদি রঙের আধিক্য চিত্রকর্মগুলোয় বিশেষ মাত্রা তৈরি করে। তাছাড়া মাধ্যম হিসেবে জলরঙের রয়েছে নিজস্ব অনন্যতা। স্বতঃস্ফূর্ত, বিশদ ও বাস্তবিক অভিব্যক্তির পুঙ্খানুপুঙ্খ উপস্থাপন আর নান্দনিকতা তৈরির ক্ষমতা চিত্রকলার অন্যান্য মাধ্যম থেকে বেশি। যেহেতু এ মাধ্যম একটি স্বচ্ছ মাধ্যম তাই আলোকে যে রঙ্গকগুলোর মধ্য দিয়ে যেতে দেয়, তার একটি আকর্ষণীয় উজ্জ্বলতা ও গভীরতা দেখা যায় জলরঙে। 

গড়িয়ে পড়া পানি আর রঙে মিলেমিশে এক আবেশ তৈরি করে। কখনো স্ফটিক স্বচ্ছতা আবার কখনো অস্বচ্ছ রঙের গভীরতা এ চিত্রকর্মের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করে।

চিত্রশিল্পীদের প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ, অন্তর্নিহিত জীবনোপলব্ধি, অভিব্যক্তি, প্রাণের স্পন্দন সঞ্চারিত হয় গভীরতর দৃশ্যমানতা থেকে। ‘বিস্তীর্ণ চরাচরে শস্যক্ষেত, মেঘ ঘন হয়ে প্রকৃতিতে আঁধার নামছে, অতঃপর ঝুম বৃষ্টি। অবিরত এই বারিধারায় শিল্পীদের হৃদয়ও ভেসে যায়, তাদের চেতনাতেও যেন অবিরাম বর্ষণ। শিল্পীরা রঙ-তুলি হাতে নেন, রঙের পর রঙের প্রলেপ দিয়ে বৃষ্টিকে উদযাপন করেন।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন