ক্যানভাস যার শরীরের অনুবাদ

ওয়াহিদ সুজন

মি অ্যান্ড মাই প্যারোট, ফ্রিদা কাহলো সৌজন্যে: ফ্রিদা কাহলো.ওআরজি

জান্তব শরীর দিয়ে দুনিয়া চিনতে শেখান ফ্রিদা কাহলো। বুঝিয়ে দেন, ব্যথা-বেদনার এ জগতে শরীর-মন জুদা নয়। খোদ দুনিয়াও এর অন্তর্গত। ফ্রিদার চিত্রকলা প্রসঙ্গে তার ব্যক্তিজীবন এড়ানো যায় না। জীবনের রঙিন, অন্ধকার ও ধূসর দিকগুলো এতটাই অর্থপূর্ণভাবে তুলে ধরেছেন! তার আঁকা চিত্রকর্মের বড় অংশ আত্মপ্রতিকৃতি ঘরানার। ১৪৩টি পেইন্টিংয়ের মধ্যে ৫৫টিই আত্মপ্রতিকৃতি। ক্যানভাস তার শরীরের অনুবাদ। আরো বিশদ করে বললে এক্সটেনশনও বটে।

ছয় বছর বয়সে পোলিও আক্রান্ত হন ফ্রিদা, শুকিয়ে যায় এক পা। তারুণ্যে বাস দুর্ঘটনায় অচল হয়ে পড়ে শরীর। দৈহিক সমস্যার কারণে ছিলেন মাতৃত্ববঞ্চিত। সারা জীবন বয়ে বেড়িয়েছেন ব্যথা। তার হৃদয়ও কম কিসে; ব্যথাতুর, চির উন্মূল। চিত্রশিল্পী দিয়েগো রিভেরার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল উথাল-পাথাল। তারা পরস্পরকে মালা পরিয়েছেন দু-দুবার। জড়িয়েছেন একাধিক সম্পর্কে।

আপনি যদি ব্যথা-বেদনার মধ্যে বসবাস করেন তবে হয়তো ফ্রিদার চিত্রকর্ম বুঝতে পারবেন। আরো স্পষ্ট করার ঝুঁকি নিয়ে বলছি, একাত্ম অনুভব করবেন। দৃষ্টি, শ্রবণ, গন্ধ, স্বাদ বা স্পর্শানুভূতি এতটা আত্মগত যে ভাগাভাগি অসম্ভবই মনে হয়। কিন্তু এ যৌথ জগতে ভাগাভাগি ছাড়া মানুষের আর কীইবা থাকে। 

আমাদের শৈল্পিক অন্বেষণ নিরন্তর ভাগাভাগির। অন্তর্দর্শন ছাড়িয়ে ইন্টারসাবজেক্টিভিটির ধারণা এ বিষয়ে কিছুটা সাহায্য করতে পারে। যেমন দার্শনিক মার্লো-পন্তি দেহকে অভিব্যক্তি হিসেবে বুঝেছেন। চৈতন্যকে জ্ঞানের উৎস হিসেবে দেখার যে দার্শনিক ঐতিহ্য রয়েছে, তার বদলে বিশ্বকে জানার প্রাথমিক উৎস হিসেবে শরীরের ওপর জোর দিয়েছেন তিনি। যে শরীর এ দুনিয়াকে দেখছে এবং তার সঙ্গে দেখার জগৎকে আলাদা করা যায় না বলেই তার অনুমান। বাংলার ভাব পরিমণ্ডলেও এর ভিন্ন ধরনের চর্চা রয়েছে।

বিজ্ঞানশাসিত আধুনিক দর্শনে শরীরকে যন্ত্র আকারে দেখার যে দৃষ্টিভঙ্গি, তার থেকে আলাদাভাবে বুঝতেন মার্লো-পন্তি। শরীর দুনিয়ার সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার উপায়। মূর্ত ও অভিব্যক্তিপূর্ণ, যার মাধ্যমে ফ্রিদার আত্মপ্রতিকৃতির তাৎপর্য কিছুটা ধরা যেতে পারে। শরীর ও মন বিনুনির মতো করে গেঁথেছেন তিনি। সব দ্বৈততার সুরাহা করতে চেয়েছেন। মেক্সিকান নারী হিসেবে মেয়ে, মা, প্রেমিকা ও স্ত্রীর ভূমিকার পাশাপাশি দেহ ও মন, আপন ও পর, প্রকাশ্য ও ব্যক্তিগত, শক্তিমান ও নাজুকের দ্বৈততা তিনি দেখেছেন। 

রিভেরা তো বলেই দিয়েছেন, ‘সত্য, বাস্তবতা, নিষ্ঠুরতা ও অব্যক্ত যন্ত্রণার এক অবিচল সহ্যক্ষমতা (ফ্রিদা)। এর আগে কখনো কোনো নারী ক্যানভাসে ধারণ করতে পারেনি এমন যন্ত্রণাময় কাতরতার কাব্য।’ ফ্রিদার চিত্রকর্ম দেখলেই যে কেউ বুঝতে পারেন অসুস্থতার সঙ্গে তার আত্মীয়তা। মৃত্যু ও শারীরিক দুর্বলতা নিয়ে কত উদ্বেগ। তার কাজ মূলত জীবন-মৃত্যু, বেদনা ও অক্ষমতার সৃজনশীল অনুসন্ধান ও রূপান্তর। যে জগতে আমরা বিষয় ও বিষয়ী হয়ে থাকি তার সঙ্গে মধ্যস্থতায় বেছে নিয়েছেন ক্যানভাস। তুলি নিজ আকারের চেয়ে বিবর্ধিত। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির যেমন থাকে হাঁটার লাঠি, ফ্রিদার ছিল তুলি।

দিয়েগো রিভেরার সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের অল্প সময়ের পর ১৯৩৯ সালে ‘দ্য টু ফ্রিদাস’ নামের বিখ্যাত ছবিটি আঁকেন। নিজের ভিন্ন দুটি প্রকাশ তুলে ধরেন। ডান পাশে তিনি রিভেরার প্রিয়তম স্ত্রী, যার পরনে মেক্সিকান ঐতিহ্যবাহী পোশাক। তার হাতে ধরা তাবিজে রিভেরার শৈশবের প্রতিকৃতি। বাম পাশে লেইসবহুল ভিক্টোরিয়ান পোশাকে ফ্রিদা কাহলো। বিয়ের পোশাক হলেও ডিভোর্সের ছাপ লক্ষণীয়। দুই ফ্রিদার হাতে হৃৎপিণ্ড, যাকে প্রায়ই ব্যথার প্রকাশ হিসেবে ব্যবহার করেছেন তিনি। তালাকপ্রাপ্তার হৃৎপিণ্ডটি কাটাছেঁড়া করা, বিবাহিতটির নিটোল। তাবিজ থেকে একটি শিরা উভয় হৃৎপিণ্ডকে জোড়া দিয়েছে। তালাকপ্রাপ্ত ফ্রিদার কোলে অস্ত্রোপচারের চিমটি। শিরা কেটে দেয়া হয়েছে। ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরছে, এ রক্তপাত যে সাক্ষাৎ মৃত্যু। দুটি হৃৎপিণ্ড জীবন ও মৃত্যুর প্রতীক। আর দুই ফ্রিদা ধরে আছে হাত। অর্থাৎ নিজেই নিজের সঙ্গী। 

দুটি অধ্যায় পুনরুৎপাদনের মাধ্যমে জীবনের সম্ভাবনাও তুলে ধরেন কাহলো। যেখানে বিবাহ বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে দর্শকের চোখে বিষয় ও আবার যে ফ্রিদা আঁকছে তাকেও উপস্থাপন করা হয়েছে। অতীত ও বর্তমানকে ঘড়ির কাঁটার দিকে স্থাপন করেছেন। যেখানে ফ্রিদা কাহলো দুটি পক্ষ দেখেন—বিবাহিত ও তালাকপ্রাপ্ত। বাইনারি আছে কিন্তু তিনি একজনই। সে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে, আবার চিত্রিত করতে পারে। উভয় ইমেজেই পরস্পরকে দেখছে ও দেখা বস্তু বিষয় হয়ে উঠেছে। এ কারণে ফ্রিদা কাহলোর শিল্পকর্ম এক ধরনের আত্মজীবনী। যেখানে নিজেকে প্রকাশ করেন, প্রশ্ন তোলেন ও নারী হিসেবে বেঁচে থাকার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন।

আরেকটি বিখ্যাত কাজ ১৯৩২ সালে আঁকা ‘হেনরি ফোর্ড হসপিটাল’। হাসপাতাল বেডে রক্তক্ষরণের সময় নগ্ন অবস্থায় শুয়ে ফ্রিদা কাহলো। কাটাছেঁড়া করা শরীরে অসহায়ত্ব ও দুঃখের রেশ। সন্তান হারানোর সময়ে কী অনুভব করেছিলেন তার প্রতিফলন এ ছবি। তার চারপাশে ছয়টি বস্তু—একটি ভ্রূণ, নারীর প্রজনন অঙ্গ, জরায়ুর মতো দেখতে অর্কিড, পেলভিস, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও সময়ের প্রতীক হিসেবে একটি শামুক। এখানে অভিজ্ঞতা সপ্রাণভাবে উপস্থিত এবং সেই অনুভূতির বিষয়বস্তু উপলব্ধির মতো সাজানো। কোনো সংবেদন লুকানো নেই, শনাক্তযোগ্য বৈশিষ্ট্য নিয়ে মূর্ত। কারণ ব্যথা মানে কোনো কিছুর ব্যথা ও শনাক্তযোগ্য। তা সত্ত্বেও ব্যথার অবস্থান শেষ পর্যন্ত উপলব্ধির বাইরে। তাই গর্ভপাতের ব্যথা, সন্তান হারানো ও তার ইঙ্গিত না দিয়ে মনে করানো অসম্ভব। বস্তুজগৎ কীভাবে আমাদের উপস্থিতিতে পরিবর্তিত হয় এবং আমরা তার অর্থদান করি; ব্যথা সেই বর্ণনাও দেয়। তখন মানুষ ও দুনিয়া আলাদা থাকে না। চিন্তাও শরীরী বিষয় হয়ে ওঠে, বস্তুও চিন্তা হয়ে ওঠে। ফ্রিদা চিন্তা, উপলব্ধি ও চিত্রকলার মধ্যে সংযোগ তৈরি করেছেন। 

ফ্রিদা শিল্পমাধ্যমকে পরিত্রাণের উপায়ও ভেবেছিলেন। তারুণ্যে জীবন বদলে দেয়া বাস দুর্ঘটনার পর চিত্রাঙ্কন শুরু করেন। হাসপাতাল ছাড়লেও যন্ত্রণা কখনো ছাড়েনি। পেইন্টিং ছিল আত্মপ্রকাশ ও স্বাধীনতার উপায়। ফ্রিদা নিজেই বলেছিলেন, আমার চিত্রকর্মগুলো তাদের সঙ্গে বেদনার বার্তা বহন করে।

‘সেলফ পোর্ট্রেট উইথ থর্ন নেকলেস অ্যান্ড হামিংবার্ড’ (১৯৪০) চিত্রকর্মের কথাই বিবেচনা করা যাক।

ফ্রিদার গলায় ঝুলে আছে মেক্সিকান সংস্কৃতিতে সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হামিংবার্ড। পেছনে দুর্ভাগ্যকে প্রতীকায়িত করে বানর। বানরটি উপহার দিয়েছিলেন রিভেরা। বানরটি কাঁটাযুক্ত নেকলেস ধরে টানছে, যার ফলে রক্তাক্ত হচ্ছেন ফ্রিদা। এ যেন রিভেরার কাছ থেকে পাওয়া কষ্ট। নেকলেস ক্রুশবিদ্ধ যিশুর কথা মনে করিয়ে দেয়, যিনি কিনা শুধু জগতে খোদার প্রতিনিধিত্ব করেন না, মানুষকে খোদার সঙ্গে সম্পর্কিত করেন। 

সে হিসেবে দেখা-অদেখা জগতের যোগসূত্র শরীর। যে নিজেকে বর্ণনা করে প্রতিরোধ, পরিবর্তন ও রূপান্তর ঘটায়। এর একটা কারণ বলা যায় এভাবে, মৌখিক ভাষার চেয়ে আরো দ্বিধাবিভক্ত ও আদিম শারীরিক অভিব্যক্তি। অভিজ্ঞতার বয়ান নির্মাণে সরাসরি নিজেকে মূর্ত করেই না শুধু, নিজেকে বিষয় হিসেবে ভাবার মধ্য দিয়ে নতুন কিছুতে বদল করেন ফ্রিদা কাহলো।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন