গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা

পরিবেশ ও ক্যাম্পাসের ভালোবাসায় সজীবের ‘‌প্রজেক্ট ১৭৫’

অনিল মো. মোমিন

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী আনোয়ার হোসেন সজীব

আচ্ছা যে ক্যাম্পাসে পড়ছেন‌ তার কাছে আপনি নিশ্চয়ই ঋণী। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের সবকিছুই আপনাকে নবোদ্দীপনা দেয় এগিয়ে যাওয়ার, সফল হওয়ার। এসবের ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে আপনি কী ভেবেছেন? কিংবা প্রকৃতির অবারিত দানের কাছে আমরা কী করেছি বিনিময়ে? পরিবেশ ও ক্যাম্পাসের ঋণ পরিশোধে ব্যতিক্রমী এক উদ্যোগ নিয়েছেন মো. আনোয়ার হোসেন সজীব। সাতক্ষীরার এ যুবক পড়ছেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে। বর্তমানে মাস্টার্সে অধ্যয়নরত। ক্রিকেট-ফুটবলে পারদর্শী সজীব নানান বিরূপ মন্তব্য পাশ কাটিয়ে চার বছরের পরিশ্রমে সফলভাবে বাস্তবায়ন করছেন ‘‌প্রজেক্ট ১৭৫’। ‘‌প্রজেক্ট ১৭৫’ হলো ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭৫ একর আয়তনের ক্যাম্পাসে ১৭৫টি উন্নত জাতের এবং দ্রুততম সময়ে দেয়া ফলগাছ রোপণের উদ্যোগ। যার বেশকিছু গাছ এরই মধ্যে লাগানো হয়েছে। আর বাকিগুলোও লাগানোর জন্য প্রস্তুত; বাদল দিনের অপেক্ষায় আছে। 

খেলাধুলায় পটু সজীবের মাথায় গাছ লাগানোর আইডিয়া আসার ঘটনাটাও উল্লেখ করার মতো। ক্যাম্পাসে অবকাঠামোগত নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চালাতে গিয়ে প্রচুর গাছ কাটা পড়ে। সজীব থাকেন‌ শেখ রাসেল হলে। এ হল নির্মাণেও প্রচুর‌ গাছ কাটা হয়। ছাত্র-ছাত্রীসহ বিভিন্ন মহল থেকে ‘‌সবুজ ক্যাম্পাস’ রব ওঠে। সজীব খেয়াল করেন সবাই সবুজ ক্যাম্পাস চাইলেও কারোই সবুজায়ন নিয়ে তেমন উদ্যোগ নেই। বিষয়টি মর্মাহত করে তাকে। পরিবেশ সুরক্ষা ও ইবি ক্যাম্পাসের প্রতি কৃতজ্ঞতার দায়বদ্ধতা থেকে সজীব ভাবেন সবুজ ক্যাম্পাস সৃষ্টিতে নিজেই কাজ করবেন। সে ভাবনা থেকে প্রথম বর্ষের শেষের দিকে শুরু করেন প্রজেক্ট ১৭৫।

পরিবেশ সুরক্ষার পাশাপাশি যেন সবাই ভালো জাতের ফল খেতে পারে তাই সজীব ফল গাছ লাগানোর সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু সজীব যেসব গাছ লাগাতে চান সেগুলোর খরচ অনেক; আবার সহজলভ্যও নয়। সাধ থাকলেও এত খরচের সাধ্য নেই তার। তাই বেছে নেন বিকল্প উপায়- গ্রাফটিং। যেটায় রয়েছে তার বিশেষ দক্ষতা। বিভিন্ন ফলের বাছাইকৃত জাত থেকে গ্রাফটিংয়ের মাধ্যমে সৃষ্টি করেন উন্নত ও দ্রুত ফলনশীল চারা। সজীবের ভাষায়— ‘‌ছাত্র অবস্থায় এত টাকার গাছ কিনে প্রজেক্ট সম্পন্ন করা অসম্ভব ব্যাপার আমার জন্য। তাই আমি গ্রাফটিং করে গাছ তৈরির কথা ভাবি। এতে কম খরচে ভালো জাতের গাছ রোপণ সম্ভব। আমার লক্ষ্য ছিল পরিশ্রম বাদে গাছপ্রতি ১০ টাকার বেশি খরচ করব না। তাই বিভিন্ন জায়গা থেকে আম, কাঁঠালের বীজ সংগ্রহ করে সেগুলো থেকে চারা তৈরি করি এবং এক বছর পর সেই গাছে গ্রাফটিংয়ের মাধ্যমে ভালো ভালো জাতের গাছে রূপান্তর করি।’ সাধারণত গ্রাফটিংয়ে সফলতার হার কম। কঠোর প্রচেষ্টা ও ধৈর্য সফলতা এনে দেয়। সজীব এখানে সফল হন মূলত তার গৃহিণী মায়ের জন্য। তার ভাষায়,”নার্সারি থেকে গাছ কেনার পর কাঙ্ক্ষিত জাত না হলে মা আফসোস করত। প্রতিবেশীর গাছ দেখিয়ে বলত এমন জাতের গাছ তার পছন্দ। যখন জানতে পারেন গ্রাফটিংয়ের মাধ্যমে সে রকম গাছ রূপান্তর সম্ভব তখন থেকেই গ্রাফটিং শিখি। একসময় সফল হই।”এ সফলতা সজীবকে ‘‌প্রজেক্ট ১৭৫’-এ আত্মবিশ্বাস দিয়েছে।

এর জন্য সুদূর সাতক্ষীরার বাড়িতেও বীজ থেকে চারা করতেন। চারা গ্রাফটিংয়ের উপযুক্ত হলে ক্যাম্পাসে এনে গ্রাফটিং করতেন। নানা জায়গা থেকে সায়ন সংগ্রহ করে তার ওপর কাজ করতেন। এভাবে সজীবের প্রজেক্ট ‘‌১৭৫’-এ যুক্ত হয়েছে ভালো জাতের হিমসাগর, ল্যাংড়া, আম্রপালি, ব্রুনাই কিং, ব্যানানা ম্যাংগো, গৌড়মতি, ব্লাক স্টোন, চিয়াংমাই, কিং অব চাকাপাত, কিউজাই, বারি-৪, বারি-১১, পেসোরি ও মল্লিকাসহ নানা জাতের আমগাছ। দেশী-বিদেশী ভালো জাতের সিজনাল, লেট ভ্যারাইটি এবং বারোমাসি সব জাতের আম রয়েছে এ তালিকায়। আবার মাল্টি গ্রাফটিং করে এক গাছেই দুই-তিন জাতের আমগাছেও রূপান্তর করা আছে। অন্যান্য গাছের মধ্যে কদবেল, বেদানা, একটি বেলের ওজন ৭-১০ কেজি হবে এমন বেলও রয়েছে। আছে সাতক্ষীরার ভালো জাতের কাঁঠালও। যার গ্রাফটিং সফলতার হার খুবই কম। তবে এ প্রজেক্টে সবচেয়ে আকর্ষণীয় যে গাছটি সেটি হলো লাল তেঁতুল। এটি একটি দুষ্প্রাপ্য গাছ। সজীবের ধারণা এটি সম্ভবত কোনো ক্যাম্পাসেই খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই ক্যাম্পাসে লাল তেঁতুল গাছটি লাগিয়ে জাতটি সংরক্ষণে তার‌ বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। এভাবে সব মিলিয়ে সজীবের ‘‌প্রজেক্ট ১৭৫’-এর জন্য ২২৫-এর অধিক গ্রাফটিং চারা তৈরি করেছেন যার মধ্যে ১৭৫টি‌ সফলভাবে ক্যাম্পাসে লাগাচ্ছেন‌ আর বাকি কিছু বন্ধুদের দেবেন। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন