সাক্ষাৎকার

বসন রাঙানো শিক্ষার্থীদের চেয়ে মন রাঙানো শিক্ষার্থীরা চলচ্চিত্রাঙ্গনে সফল হবে

অধ্যাপক জুনায়েদ আহমদ হালিম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বিভাগের চেয়ারম্যান। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে তিনিই একমাত্র শিক্ষক, যিনি তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। পেয়েছেন ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও। সম্প্রতি চলচ্চিত্র অধ্যয়ন, দেশের চলচ্চিত্রাঙ্গনের হালচাল ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শফিকুল ইসলাম

বাংলাদেশে সিনেমার উন্নয়ন সম্প্রসারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারে?

খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষ করে সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। যদিও বাংলাদেশে সিনেমা, টেলিভিশন মাধ্যমটিকে কখনই শিক্ষার বিষয় হিসেব গণ্য করা হতো না। আনন্দের বিষয়, গত দেড় দশকে সে অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে এবং তিনটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদাভাবে বিভাগ চালু করা হয়েছে। বেসরকারিভাবেও বিষয়ে পড়াশোনার সুযোগ রয়েছে। সিনেমা এডুকেশনের এখন যে পরিস্থিতি এটি গত এক দশকের উন্নয়ন। সিনেমা যে লেখাপড়ার বিষয় বা জ্ঞানচর্চার বিষয় বা ক্ষেত্র হতে পারেএটি অনেকে ভাবেনি। আমরা সে অবস্থান থেকে অনেকটা বেরিয়ে এসেছি। এখন সিনেমা এডুকেশনের ব্যাপারে প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়েছে। পরিস্থিতিই আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভূমিকা রাখতে পারবে। তবে খুব বেশি পারছে বল না। সময় লাগবে। এটি এমন একটি শিক্ষার জায়গা যেখানে প্রচুর বিনিয়োগ লাগবে। অবকাঠামো কারিগরি কাঠামো লাগবে। প্রতিভাসম্পন্ন শিক্ষক দরকার।

দুই দশক হলো একাডেমিকভাবে চলচ্চিত্র অধ্যয়ন বিষয়ে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করছে। সেক্টরে তাদের অবস্থান কেমন?

কিছু শিক্ষার্থী ভালো অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে। পাস করে হুট করে মহা নাম কামিয়ে ফেলবে বিষয়টা এমন না। দুনিয়া খুবই চ্যালেঞ্জিং জায়গা। এটি যে একটি সিরিয়াস সেক্টর, সিরিয়াসলি পড়াশোনা করলে যে কর্মের সুযোগ আছে এবং অনেকভাবে নিজের ক্যারিয়ার গড়া যায় তার জন্য কোয়ালিটি শিক্ষার্থী আসতে হবে। অধিকাংশ শিক্ষার্থী আসছে বসন রাঙাতে, মন রাঙাতে না। তারা শুধু ডিগ্রি নিতে আসছে। মন রাঙানোর শিক্ষার্থীরা যখন বেশি আসবে তখন সংখ্যাটা বাড়বে এবং এখন এটি বাড়ছে।

মূল ধারার চলচ্চিত্র শিল্পে কী একাডেমিক শিক্ষার্থীরা ভূমিকা রাখতে পারছে?

পারছে, ওভার নাইট ইউ ক্যাননট এক্সপেক্ট। জাককানইবি জবিতে একসঙ্গে বিভাগটি শুরু হয়েছিল। ঢাবি আমাদের দুই বছর আগে শুরু করেছিল। দু-তিনটি ব্যাচ বের হয়েছে। শিক্ষার্থীরা কর্মক্ষেত্রে আছে। আসলে কিছু সময় কাজ করার পর তাদের অবদান চোখে আসবে বা নজরে আসবে তবে সময় লাগে। রাতারাতি হবে না। বসন রাঙানো শিক্ষার্থীদের চেয়ে মন রাঙানো শিক্ষার্থীরা যত বেশি আসবে ফল তত ভালো আসবে। তাদের সফলতাও তত দ্রুত আসবে।

বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের বাইরে এখন ওটিটি প্লাটফর্ম বেশি জনপ্রিয়। এখানে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের বেশির ভাগেরই বিষয়ে একাডেমিক ডিগ্রি নেই। কিন্তু যারা চলচ্চিত্র অধ্যয়ন বিষয়ে ডিগ্রি নিয়ে বের হচ্ছে তাদের দ্বারা কি কোনো পরিবর্তন আসবে সেক্টরে? কী মনে করেন?

একাডেমিকভাবে যারা সিনেমা নিয়ে পড়াশোনা করে তারা শুধু বাণিজ্যিক সিনেমাকেই সিনেমা মনে করে না। মুম্বাই, চেন্নাই বা কলকাতায় একাডেমিকভাবে পড়াশোনা করা ছেলেমেয়েরা কাজ করে। তাদের অধিকাংশই হয়তো মানসিকভাবে সিনেমাগুলোয় বিলং করে না। আমাদের দেশেও যারা সিনেমা নিয়ে পড়ছে তাদেরও সিনেমার চিন্তা কাঠামো যেভাবে তৈরি হচ্ছে, সেটা আমাদের তথাকথিত ঢাকাই বাণিজ্যিক ছবির যে ধরন আমরা সে ধরনের ছেলেমেয়ে তৈরি করছি না। একটা মিনিমাম টেস্ট থাকবে। তারা পপুলার সিনেমা বানালে সেটার মধ্যে নান্দনিকতা থাকবে, কারিগরি উৎকর্ষ থাকবে। এটি একাডেমিক শিক্ষার প্রত্যক্ষ ফল।

ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির উৎকর্ষের জন্য আরো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিষয় চালু করার প্রয়োজন রয়েছে কি?

আমাদের দেশে আরেকটি সমস্যা আছে। কোনো কিছু শুরু হলে একেবারে ব্যাঙের ছাতার মতো হয়ে সেটির কোনো গুণগত মান থাকে না। আমার সিনেমা শিল্পের জন্য কী পরিমাণ ওয়ার্ক ফোর্স দরকার, সেই পরিমাণ তৈরির জন্য এডুকেশনাল ফ্যাসিলিটি এনরোলমেন্ট ক্যাপাসিটি তৈরি করতে হবে। এটি খুবই স্পেশালাইজড এডুকেশন। সেক্টরে খুব বেশি লোকের দরকার নেই। এটি এমন একটি ক্ষেত্র সবার একাডেমিক শিক্ষার প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন হয়ও না। ঋতুপর্ণ ঘোষ কোনো ইনস্টিটিউটে পড়েনি কিন্তু বড় ফিল্ম মেকার। তার সমসাময়িক যারা ইনস্টিটিউটে পড়েছেন তারা কিন্তু তার মতো হতে পারেননি। 

বাংলাদেশের সিনেমাজগতে চার দশকের পথচলা আপনার। বর্তমান সিনেমা শিল্পে কী ধরনের পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছেন?

পাঁচ বছর ধরে আমরা দ্রুতই পরিবর্তনের দিকে যাচ্ছি। আমি খুব আশাবাদী। ইতিবাচক পরিবর্তনের দিকে যাচ্ছে। আমাদের প্রচুর ইনডিপেনডেন্ট ফিল্ম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে যাচ্ছে এবং সেগুলা পুরস্কার জিতেছে। তরুণ ফিল্ম নির্মাতারা এসব উৎসবে যাচ্ছেন সেসব বাজারের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন। নানাভাবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রিলিজ হচ্ছে। পরিসরটা হয়তো ছোট কিন্তু শুরুতো হয়েছে। বাংলা ভাষাভাষী মানুষও জাতীয় সিনেমায় আগ্রহী হচ্ছে। শর্টফিল্মও নানা জায়গায় পুরস্কার পাচ্ছে। এগুলো এক ধরনের অনুপ্রেরণা। বাংলাদেশর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হচ্ছে। খাতে সম্ভাবনা আছে। ইতিবাচক বিষয় নিয়ে ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে তুলে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা সৃষ্টি করার প্রক্রিয়ার মধ্যে আমরা আছি। আমরা পিছিয়ে নেই।

একজন শিক্ষার্থী কেন বিষয়ে পড়বে?

এটি একটি জ্ঞান দক্ষতার ক্ষেত্র। সিনেমা টেলিভিশনে কারিগরি সৃজনশীল কাজ করতে হলে প্রচুর জ্ঞানের দরকার। এটি ভীষণ পড়াশোনার জায়গা। শুধু টেকনোলজি পড়া না, টেকনোলজি ব্যবহার করে তুমি কী করবে সেটাই মুখ্য। এজন্য ইতিহাস, সংস্কৃতি মানব সভ্যতা, আর্ট, কলা, হিউম্যান সাইকোলজি সম্পর্কে জানতে হবে। সংগীত, চিত্রকলা, নৃত্য, অভিনয়, স্থাপত্য, অঙ্গসজ্জা কলাসহ সব বিষয়ে কমবেশি পড়াশোনা থাকতে হবে। ধারণা থাকতে হবে। পাশাপাশি কারিগরি দক্ষতাও। সর্বোপরি লিটারারি দক্ষতা থাকতে হবে। দক্ষতা তৈরি হলে একজন মানুষ ওয়ান স্টান্ডার্ডের মানুষ হয়। সেটি যে না হতে পারবে সে ভালো পেশাদার হতে পারবে না। খ্যাতি সম্মানও কুড়াতে পারবে না।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন