আদানির বিদ্যুতের দাম বাংলাদেশের বড় কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রের চেয়ে বেশি না

ছবি: এপিএল

এস বি খেয়ালিয়া আদানি পাওয়ার লিমিটেডের (এপিএল) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)। ৩২ বছর ধরে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ খাতে কাজ করছেন। পাওয়ার ট্রেডিং, লিগ্যাল রেগুলেটরি, কমার্শিয়াল রেগুলেটরি এবং অ্যাকাউন্টিং নিয়েও কাজের অভিজ্ঞতা দীর্ঘদিনের। বাংলাদেশে আদানির বিদ্যুৎ সরবরাহসহ নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আবু তাহের

বাংলাদেশের গ্রিড লাইনে আদানি পাওয়ার ঝাড়খণ্ডের বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে গত ৬ এপ্রিল থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিদ্যুৎ (সিওডি) সরবরাহ করছে। বিষয়টি আদানি পাওয়ার ভারতীয় স্টক এক্সচেঞ্জকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) সঙ্গে সিওডির বিষয়টি নিয়ে কোনো আনুষ্ঠানিকতা হয়েছে কিনা?

হ্যাঁ, ঝাড়খণ্ডে গড্ডা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিট কমিশনিংয়ের সময় বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) এবং পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সপ্তাহব্যাপী এ সফরে বিদ্যুৎ ক্রয়চুক্তি অনুযায়ী, তারা বিদ্যুৎ পাওয়ার প্লান্টের সক্ষমতা, লোড টেস্টের মতো গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাগুলো প্রত্যক্ষ করেছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারিগরি সুযোগ-সুবিধা, সফল পরীক্ষার তথ্য বিপিডিবির সঙ্গে শেয়ারও করা হয়েছে।

আদানির বিদ্যুৎ সরবরাহ বাবদ এপ্রিলে প্রথম একটি বিল বিপিডিবিতে জমা দিয়েছে। এ বিল পেয়েছেন কিনা? বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ কেমন হয়েছে? খরচের বিষয়টি নিয়ে বলুন।

বিদ্যুৎ সরবরাহ বাবদ প্রথম মাসের বিলের কপি আমরা বিপিডিবিকে পাঠিয়েছি। তবে চুক্তির শর্ত ও গোপনীয়তা রক্ষায় অর্থের পরিমাণটা প্রকাশ করা যাচ্ছে না। তবে আমরা সবসময় বলে আসছি, আদানির প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম বাংলাদেশের অন্যান্য বড় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চেয়ে বেশি নয়, বরং কাছাকাছি। বিশেষত পায়রা ও রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রতি ইউনিটের দাম যেমন পড়ছে, আদানির বিদ্যুতের দামও সে রকম হবে।

গড্ডা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দুটি ইউনিটের একটি উৎপাদনে রয়েছে। দ্বিতীয় ইউনিটের কমিশনিং কবে নাগাদ হবে? 

গড্ডা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিট তৈরির বিষয়ে আমরা নির্ধারিত সময়ের তুলনায় বেশ এগিয়ে রয়েছি। মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বাংলাদেশের গ্রিডের সঙ্গে দ্বিতীয় ইউনিটের সিনক্রোনাইজ করা হয়েছে এবং এরই মধ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। পিজিসিবির ডাটা দেখলেই সেটি বুঝতে পারবেন। বাংলাদেশে আমাদের দৈনিক বিদ্যুৎ সরবরাহের দিকে তাকালে দেখবেন, আমরা মাঝে মাঝেই ৭৪৮ মেগাওয়াট ছাড়াও কয়েকশ মেগাওয়াট বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহ করছি। এখানে আমাদের প্রথম ইউনিটের পাশাপাশি দ্বিতীয় ইউনিটও বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। আমরা দ্বিতীয় ইউনিটের বিষয়ে মে মাসের শেষের দিকে বিপিডিবি ও পিজিসিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের আমন্ত্রণ জানানোর পরিকল্পনা করেছি। যেন আমরা দ্বিতীয় ইউনিটের কমিশনিং ও টেস্টিং কার্যক্রম শুরু করতে পারি।

বাংলাদেশে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে আমরা বরাবরই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা বিশ্বাস করি আদানি গড্ডা কেন্দ্রের নির্ভরযোগ্য ও সাশ্রয়ী মূল্যের বিদ্যুৎ বাংলাদেশের সমগ্র উত্তরবঙ্গে বিদ্যুৎ সরবরাহে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

আদানি পাওয়ারের বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানি কয়লার দাম টনপ্রতি ৪০০ ডলার নির্ধারণ করা নিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন মহলে সমালোচনা উঠেছে। চুক্তির ধারায় জ্বালানির মূল্য নির্ধারণের প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে বলুন।

আমরা আপনাকে বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই, গণমাধ্যমের একটি অংশে প্রচারিত আদানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কয়লার দাম টনপ্রতি ৪০০ ডলার নির্ধারণ করা হয়েছে, এটি একটি ভুল তথ্য। এটি মিথ্যা ও বিভ্রান্তিমূলক সংবাদ প্রচারের অংশ। ইচ্ছাকৃতভাবে একটি স্বার্থান্বেষী মহল এ ধরনের বানোয়াট ও মিথ্যা তথ্য গণমাধ্যমে প্রচার করেছে। আমাদের কেন্দ্রের (গড্ডা বিদ্যুৎ কেন্দ্র) কয়লার দাম অস্ট্রেলিয়া ও ইন্দোনেশিয়ান কোল ইনডেক্সের ওপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা।

আপনি কোল ইনডেক্সের ডাটা নিয়ে দেখতে পারেন। বিপিডিবির সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী, আমাদের প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুতের দাম ১০-১১ সেন্ট পড়ছে। এটিই আমাদের জ্বালানি খরচ (যার মধ্যে কয়লার দাম, শিপমেন্ট, পরিবহন এবং সব ধরনের ট্যাক্স অন্তর্ভুক্ত)। তার পরও এ দাম প্রতি মাসে কমছে। 

অস্ট্রেলিয়ার নিউক্যাসল ইনডেক্স এবং ইন্দোনেশিয়ান ইনডেক্স অনুসরণ করে গড্ডা কেন্দ্রের জন্য কয়লা কেনা হচ্ছে। আগামীতে কয়লার দাম আরো কমলে সেক্ষেত্রে বিদ্যুতের দাম কীভাবে নির্ধারিত হবে?

আমরা আগেই বলেছি, আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম নিম্নমুখী। ফলে বিপিডিবির জ্বালানি খরচ স্বভাবতই কমে যাবে। তাতে করে বাংলাদেশ সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ পাবে। বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য যখন আমরা ঝাড়খণ্ডের গড্ডা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তুতি নিয়েছিলাম, তখন আমরা এ কেন্দ্রটিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলাম। আমাদের উদ্দেশ্যই ছিল, বিদ্যুৎ ঘাটতিতে থাকা বাংলাদেশকে কীভাবে নিরবচ্ছিন্ন ও নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যায়। এ বিষয়ে আদানির মতো বৃহৎ ও নানা বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী পারে তাদের বিদ্যুৎ খাত এবং জ্বালানি সরবরাহ, পরিবহন ইত্যাদি খাতের দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে। 

ডলার সংকটের প্রেক্ষাপটে আদানি পাওয়ারের বিল পেতে বিলম্ব হলে বা বকেয়ার পরিমাণ বাড়লে বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনায় কোনো সংকট তৈরি হবে কি? বিশেষ করে বিদ্যুৎ রফতানিতে এর কোনো প্রভাব পড়বে কি? 

এখানে দুটি বিষয়, প্রথমত আদানির ক্ষেত্রে, কয়লা আমদানির জন্য আলাদা এলসি (ঋণপত্র) ইস্যু করার কোনো প্রয়োজনীয়তা বিপিডিবির নেই। যেটি পায়রা ও রামপালের ক্ষেত্রে আছে। বিপিডিবিকে শুধু বিদ্যুতের দাম পরিশোধ করলেই হবে। এখানে কোনো ধরনের কাগজপত্রেরও বাড়তি জটিলতা নেই, এটি একটা ভালো খবর।

দ্বিতীয়ত, একটি বিষয় আপনাকে বুঝতে হবে, গড্ডা বিদ্যুৎ কেন্দ্র একটি বৃহৎ অবকাঠামো। এখানে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ জড়িত। যারা এ প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছেন তারা এ বিনিয়োগের রিটার্ন প্রত্যাশা করবেন এটাই স্বাভাবিক। আমরা নিশ্চিত বিপিডিবি বিষয়টি বুঝবে। ফলে কোনো কারণে বিদ্যুৎ বিল বকেয়া পড়লে তা চুক্তির শর্ত অনুযায়ী প্রদান করবে। 

নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে আদানি গ্রুপ ভারতে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করেছে, বাংলাদেশে এমন কোনো পরিকল্পনা রয়েছে কি?

আদানি গ্রুপ তার ব্যবসায়িক নীতি-কৌশল অনুযায়ী সর্বদা সঠিক বিনিয়োগের সুযোগ খুঁজছে। ব্যবসা সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশও এ প্রক্রিয়ার অংশ। নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে আদানি গ্রুপের বড় ধরনের দক্ষতা রয়েছে। এছাড়া এ খাতে বিনিয়োগে আদানি গ্রুপ বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ কোম্পানি। বাংলাদেশ সরকার এ খাতে যদি বিনিয়োগ বাড়াতে চায়, আদানি গ্রুপ সহায়তার হাত বাড়াতে সর্বদা প্রস্তুত। কিন্তু বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে আমরা সর্বদা অগ্রাধিকার দিই, যেন বিনিয়োগে মানুষের জীবন-জীবিকায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনা যায়।

বাংলাদেশে আদানি পাওয়ারের সঙ্গে চুক্তি বাতিল বা সংশোধনের দাবি উঠেছে। ক্রয়চুক্তিতে এ ধরনের কোনো সুযোগ আছে কিনা?

আমরা নিশ্চিত, যে বা যারা এ ধরনের কথা বলছে, তারা সঠিক তথ্য-উপাত্ত সম্পর্কে অবগত নন। ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্য দ্বারা প্রভাবিত। অপপ্রচারের মাধ্যমে প্রভাবিত হচ্ছেন তারা। এসব অপপ্রচার আমাদের বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করার এবং বিল জমা দেয়ার অনেক আগেই তৈরি করা হয়েছে। এখন আমরা বিদ্যুৎ সরবরাহ করছি, তাই প্রকৃত খরচ কত হচ্ছে, তা নিয়ে সবাই কথা বলছে। এখন আর কেউ বিভ্রান্তিকর দাবি তুলতে পারবে না। আদানি সুবিধাবঞ্চিত একটি অঞ্চলে সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে সেখানকার চাহিদা পূরণ করছে এবং দেশের কোটি মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করছে। তাহলে তো কারো এ চুক্তির বিরুদ্ধাচরণ করার প্রশ্নই আসে না। 

সামনের দিনগুলোয় আদানি গ্রুপের ব্যবসায়িক পরিস্থিতি যদি খারাপ হয়, ঝাড়খণ্ডের বিদ্যুৎ কেন্দ্রে এর প্রভাব পড়বে কি?

এটি সত্য, চলতি বছরের জানুয়ারিতে একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর অসৎ প্রচারণায় আদানি গ্রুপের শেয়ারের ওপর বেশ প্রভাব পড়ে। কিন্তু প্রকৃত সত্য একসময় উন্মোচিত হয়। সেটাই এখন আমাদের স্টকের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের আত্মবিশ্বাসের কারণে আমাদের স্টকের দাম আবার পুনরুদ্ধার হয়েছে। আমরা বরাবর বলে এসেছি, এসব অভিযোগ পুরোপুরি মিথ্যা। সম্প্রতি মরিশাস সরকারও কিছু মিথ্যা অভিযোগ খণ্ডন করেছে। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের অনুসন্ধান কমিটি তাদের রিপোর্টে বলেছে, দাম ম্যানিপুলেশনের বিষয়ে হিনডেনবার্গ রিপোর্টে যেমন বলা হয়েছিল, কমিটি তার সত্যতা খুঁজে পায়নি। ঝাড়খণ্ড পাওয়ার প্রজেক্ট চলছে। আমাদের বিদ্যুৎ সরবরাহ ও দাম পরিশোধের ক্ষেত্রে চুক্তি রয়েছে। সুতরাং এ প্রকল্প নিজেই অর্থনৈতিকভাবে টেকসই। কোনো প্রভাব পড়ার প্রশ্ন আসে না। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন