এনবিএফআইয়ের জন্য বিশেষ তহবিলের সুযোগ রাখা হোক

দেশের ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর (এনবিএফআই) সংগঠন বিএলএফসিএর চেয়ারম্যান হিসেবে বছর দায়িত্ব নিয়েছেন মো. গোলাম সারওয়ার ভূঁইয়া তিনি ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স কোম্পানি (আইআইডিএফসি) লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রধান নির্বাহীর দায়িত্বে রয়েছেন দীর্ঘদিন ধরে। সম্প্রতি তিনি এনবিএফআই খাতের সার্বিক অবস্থা আগামী অর্থবছরের বাজেটে খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রত্যাশার নানা দিক নিয়ে বণিক বার্তা সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মেহেদী হাসান রাহাত

আগামী অর্থবছরের বাজেটকে ঘিরে এনবিএফআইগুলোর প্রত্যাশা কী?

আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বর্তমানে যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে, সেক্ষেত্রে আমরা বাজেটে কিছু ইতিবাচক নীতি সহায়তা চাইব সরকারের কাছে। বর্তমানে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান মার্চেন্ট ব্যাংকের করপোরেট করের হার অনেক বেশি। তালিকাভুক্ত হলে সাড়ে ৩৭ শতাংশ আর অতালিকাভুক্ত হলে ৪০ শতাংশ। ঋণের সুদহারের সীমা নির্ধারণ করে দেয়ার ফলে আমাদের মার্জিন অনেক কমে গেছে। এদিকে মূল্যস্ফীতি প্রায় দুই সংখ্যার ঘরে অবস্থান করছে। অবস্থায় আমাদের তহবিল সংগ্রহের ব্যয় বেড়ে গেছে। তাই আমরা চাইছি এনবিএফআইগুলো করপোরেট করের হার তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে সাড়ে ৩৩ শতাংশ এবং অতালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের জন্য ৩৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হোক। ডিপিএসের ক্ষেত্রে ৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত করছাড় সুবিধা পাওয়া যায়। ফলে আমানতকারীরা এর বেশি অর্থ আমানত রাখতে উৎসাহী হন না। কারণে এটি বাড়িয়ে লাখ ২০ হাজার টাকা নির্ধারণের দাবি করছি। লাখ টাকা পর্যন্ত আমানতের ক্ষেত্রে আবগারি শুল্কের পরিমাণ শূন্য। - লাখ টাকা পর্যন্ত এটি ১৫০ টাকা এবং -১০ লাখ হলে এর পরিমাণ ৫০০ টাকা। কিন্তু ১০ লাখ থেকে কোটি টাকার আমানতের ক্ষেত্রে আবগারি শুল্ক ধরা হয় হাজার টাকা। আমাদের বেশির ভাগ মেয়াদি আমানত ১০ লাখ থেকে কোটি টাকার। এক্ষেত্রে এক লাফে ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে হাজার না করে এটি আরেকটু কমানোর প্রস্তাব করছি। সঞ্চয়পত্রের ক্ষেত্রে বিভিন্ন স্ল্যাবে কর নির্ধারণ করা আছে। আমাদের আমানতের ক্ষেত্রে কিন্তু ধরনের কিছু নেই। এক্ষেত্রে আমানতের উৎসে কর নির্ধারণের ক্ষেত্রে স্ল্যাব করা যেতে পারে।

গত বছর আমানতকারীদের ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। রিটার্ন দাখিল করা না হলে বেশি হারে কর ধার্য করা হবে। এমনো ব্যক্তি আছেন যাদের করযোগ্য আয় নেই, কিন্তু - লাখ টাকা আমানত রেখেছেন। এক্ষেত্রে যদি বিষয়টি স্পষ্টীকরণ করা হয় কিংবা কিছুটা ছাড় দেয়া হয় যে লাখ টাকা পর্যন্ত রিটার্ন জমা দেয়ার বাধ্যবাধকতা থাকবে না, তাহলে আমানতকারীরা উৎসাহিত হবেন এবং সঞ্চয় প্রবণতা বাড়বে।

ব্যাংকগুলোকে বেইলআউটের ক্ষেত্রে যে সহায়তা দেয়া হয়, আমরাও এবারের বাজেটে ধরনের কিছু নীতি সহায়তা চাইছি। এনবিএফআইগুলোর জন্য যদি ১০ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল বা তারল্য সহায়তা রাখা হয়, তাহলে প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে সহজেই ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হবে।

আপনারা যে বিশেষ তহবিল চাইছেন সেটি কীভাবে কাজ করবে?

আমরা চাইছি বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে তহবিলটি বিতরণ করা হোক। এটি আদায়ের দায়িত্বও তাদের কাছেই থাকবে। প্রয়োজনে কোনো বিশেষ অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে তহবিল থেকে পাওয়া অর্থ ঋণ হিসেবে বিতরণ করা যেতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক এক্ষেত্রে কঠোর নজরদারি করতে পারে। তহবিলের অর্থ ব্যবহার ফেরতের পদ্ধতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করা যেতে পারে। কিন্তু আমরা চাইছি অন্তত তহবিলটি হোক।

বর্তমানে এনবিএফআই খাতে তারল্য পরিস্থিতি কেমন?

এনবিএফআই খাতে তারল্যের ক্ষেত্রে যে চ্যালেঞ্জ, সেটি শুরু হয়েছে ২০১৯ সালে যখন সরকার পিপলস লিজিংকে অবসায়নের সিদ্ধান্ত নেয়। সময়ে আরো একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা হয়। এরপর আরো বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের বিষয় সামনে চলে এল। তখন পুরো এনবিএফআই খাত সম্পর্কেই মানুষের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা চলে আসে। এর মধ্যেই আমরা চেষ্টা করলাম পরিস্থিতি মোকাবেলা করার। কভিড-১৯ চলে আসার পর মানুষের মধ্যে টাকা-পয়সা হাতে রাখার প্রবণতা দেখা গেল। পরবর্তী সময়ে মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়ে গেল। এর মধ্যে গত বছরের জুলাইয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আমানতের সুদহার সর্বোচ্চ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয়া হলো। যদিও সে সময় কিন্তু মূল্যস্ফীতি এর চেয়ে বেশি ছিল। এটি আমাদের জন্য সমস্যা তৈরি করল। ব্যাংক খাতের কিছু নেতিবাচক খবরের কারণেও আমাদের ওপর প্রভাব পড়েছে। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে আমাদের বেশকিছু করপোরেট তহবিল প্রত্যাহার হয়ে গেল। সব মিলিয়ে তারল্য পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের ওপর বেশ ধাক্কা এসেছে। তবে আমরা সেটি সামলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি।

উদ্ভাবনী নতুন পণ্য প্রচলনের মাধ্যমে অবস্থা পরিবর্তনে এনবিএফআইগুলো উদ্যোগ নেবে কি?

এনবিএফআইগুলো প্রথমে লিজ ফাইন্যান্সিং শুরু করে। পরবর্তী সময়ে দেখা যায় ব্যাংকগুলোও ব্যবসা শুরু করে। চ্যানেল ফাইন্যান্সিং, সাশ্রয়ী আবাসনের মতো উদ্ভাবনী পণ্য নিয়ে এনবিএফআই কাজ করছে। পুঁজিবাজারেও প্রতিষ্ঠানগুলোর বিচরণ রয়েছে। দেশের প্রথম জিরো কুপন বন্ডের কাজ আইআইডিএফসি করেছে। সিন্ডিকেশন ফাইন্যান্স, স্ট্রাকচারড ফাইন্যান্স আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো করছে। তবে ইমেজ সংকটের কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোর ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে গেছে। তাই প্রথমে খাতের ভিত শক্তিশালী করতে হবে। ভিত শক্ত হলে তখন নতুন নতুন পণ্য নিয়ে কাজ করা যাবে।

পরিবেশ টেকসই অর্থায়ন নিয়ে এনবিএফআইগুলোর কাজ করার সুযোগ রয়েছে?

সুযোগ রয়েছে এবং আমরা কাজ করছিও। কার্বন নিঃসরণ কমাতে আমরা কাজ করছি। প্রতি বছর আমরা ৩৩ হাজার টন কার্বন নিঃসরণ কমাচ্ছি। এটি কিনে নিচ্ছে বিশ্বব্যাংক এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) সম্প্রতি এজন্য আমরা অ্যাসোসিয়েশন অব ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্সিং ইনস্টিটিউশন্স ইন এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিকের (এডফিয়াপ) কাছ থেকে পুরস্কারও পেয়েছি।

এনবিএফআইয়ের জন্য বছরটা কেমন যাবে বলে মনে করছেন?

বছরের শুরুতেই বিভিন্ন কারণে আমরা কিছুটা ধাক্কা খেয়েছি। এর মধ্যে অর্থনৈতিক কারণ, বৈশ্বিক মন্দা, ইমেজ সংকট বা ব্যাংক খাতের কিছু অনিয়ম উদ্ঘাটনের মতো বিষয় ছিল। তবে আমি মনে করি, অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান সেটি সামলে নেবে। বিএলএফসিএর পক্ষ থেকে কিছু স্কিম নেয়া হয়েছে। এনবিএফআইগুলোর মধ্যে ঝুঁকি মূল্যায়নের দক্ষতার ক্ষেত্রে কিছু ঘাটতি রয়েছে বলে আমরা দেখতে পেয়েছি। তাই আমাদের কর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি। করপোরেট সুশাসন উন্নত করতে আমরা কাজ করছি। দীর্ঘমেয়াদি আমানত সংগ্রহে আমরা নতুন কিছু স্কিম চালুর উদ্যোগ নিয়েছি। বন্ড নিয়ে আমরা কাজ করছি। ভারত শ্রীলংকায় রয়েছে। কিছু গাইডলাইন থাকবে, যেগুলো পরিপালন করে আমরা প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে বন্ড ইস্যু করতে পারব। পরবর্তী সময়ে বন্ডটি যখন তালিকাভুক্ত হবে, তখন আমরা নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছ থেকে অনুমোদন নেব। এতে আমাদের দীর্ঘমেয়াদি তহবিল জোগানে সহায়ক হবে। এগুলো নিয়ে যদি আমরা এগোতে পারি, তাহলে বছরটি আমাদের ভালো যাবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন