ফসেট শিল্পে ভ্যাট ৫ শতাংশ হলে ভালো হয়

মো. নজরুল ইসলাম রাজা , ব্যবস্থাপনা পরিচালক, রাজা মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ

শিল্পের সুষ্ঠু বিকাশে সামগ্রিকভাবে কেমন বাজেট চাচ্ছেন?

যেকোনো ইন্ডাস্ট্রির উন্নতির জন্য সরকারের পলিসি সাপোর্ট জরুরি। সরকারি প্রণোদনা, শুল্ক সুবিধা, সহনীয় ভ্যাটহার ইত্যাদি শিল্পের উন্নতির জন্য অপরিহার্য। আমরা দেখেছি, পোশাক শিল্প দীর্ঘ সময়ে বিভিন্ন সরকার সরকারি পলিসির সাপোর্ট নিয়েই আজ বিশ্বদরবারে নাম করেছে। উদাহরণস্বরূপ করোনাকালে শিল্প মাত্র শতাংশ সুদেও ঋণ সুবিধা পেয়েছে, যা করোনা অতিমারীতে শিল্পকে রক্ষায় ভূমিকা রেখেছে। ফসেট শিল্প মাঝারি শিল্প হিসেবে এসএমইর অন্তর্ভুক্ত। এসএমই শিল্পকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে মান উন্নয়ন করেই চীন আজ পৃথিবীতে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। প্রধানমন্ত্রী এসএমইকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু ফসেট শিল্পে পলিসির বাস্তব সুফল আমরা সেভাবে পাচ্ছি না। ১৯৭৮ সালে শুরু হওয়া রাজা মেটাল দেশের ঐতিহ্যবাহী স্যানিটারি ফসেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। দীর্ঘ ৪৫ বছর আমরা ফসেট উৎপাদন করে সারা দেশে অসংখ্য পণ্য পৌঁছে দিয়েছি। স্যানিটারি পণ্য উৎপাদন বিক্রির সঙ্গে দেশের কয়েক লাখ মানুষের কর্মসংস্থান জড়িত। গত ১৫ বছরে ব্যাপক অবকাঠামো উন্নয়ন, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে আমাদের পণ্যের চাহিদা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অন্তত ১০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে ক্রমবর্ধমান নির্মাণকাজ পণ্যের চাহিদাকে নিয়ে এসেছে সময়ের সেরা পর্যায়ে। সামনের দিনগুলোয় ব্যক্তিগত প্রাতিষ্ঠানিক উভয় পর্যায়েই ফসেটের চাহিদা বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। তাই বাজেটে সেক্টরের জন্য সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছি।

এবারের বাজেটে আপনাদের শিল্পের জন্য সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবগুলো কী?

ফসেট উৎপাদনের জন্য কেমিক্যাল অপরিহার্য, যা গত দুই বছরে কখনো কখনো প্রায় ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। সব মিলিয়ে উৎপাদন খরচ বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। এছাড়া ফসেট ক্রেতারা ঐতিহ্যগতভাবে ভ্যাট দিয়ে অভ্যস্ত নয়। তাই শিল্পের জন্য বৃহদায়তন শিল্পের তুলনায় ভ্যাট কমিয়ে বাস্তবমুখী ভ্যাটের হার নির্ধারণ জরুরি। এটা শতাংশ হলে ভালো হয়। ইকোনমিক জোন তথা শিল্প পার্কগুলোর পলিসি বৃহদায়তন শিল্পের জন্য উপযোগী। ফসেট প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ইকোনমিক জোনগুলো স্বল্প খরচে প্লট সুবিধা পেলে উৎপাদন খরচ প্রায় ২০-৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে আনা সম্ভব, যা শিল্পকে একটি রফতানিমুখী শিল্পে পরিণত করবে। বাংলাদেশের ফসেট মার্কেট প্রায় ৫০ শতাংশ আমদানিকারকদের দখলে। বিদেশ থেকে স্বল্পমূল্যে নিম্নমানের আমদানি করা পণ্যে বাজার সয়লাব হয়ে গেছে, যা দেশীয় উৎপাদনকে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত করছে। অবস্থায় দেশের ঐতিহ্যবাহী শিল্পকে রক্ষা করতে এসব পণ্যের আমদানি শুল্ক ৫০-১০০ শতাংশ বাড়ানো প্রয়োজন।

আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশী ফসেট পণ্যের সম্ভাবনা সম্পর্কে বলুন।

বিশ্ববাজারে ফসেট মার্কেটের আকার বার্ষিক ৫০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। বাংলাদেশ থেকে ভারত, নেপাল, আফ্রিকা মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশে বিচ্ছিন্নভাবে দেশে উৎপাদিত পণ্য রফতানি হয়েছে। রাজা মেটালের পণ্য নেপাল ভারতে বিক্রির জন্য গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে। চীনে পণ্যের উৎপাদন খরচ কম হওয়ায় আমাদের পণ্য রফতানি করা কিছুটা চ্যালেঞ্জিং। রফতানি শুল্ক কমিয়ে এনে এসব দেশে পোশাক শিল্পের মতো মেইড ইন বাংলাদেশ ব্র্যান্ডের ফসেট রফতানি করার দারুণ সুযোগ রয়েছে।

দেশে উৎপাদিত ফসেট আমদানি করা ফসেটের সঙ্গে কতটা প্রতিযোগিতা করতে পারছে?

স্বাধীনতার পর পরই বাংলাদেশের ফসেট শিল্পের যাত্রা ভালোভাবে শুরু হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের সব জেলা-উপজেলায় রাজা মেটালসহ অন্যান্য দেশীয় ব্র্যান্ডের ফসেট সুলভ মূল্যে পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু চায়না থেকে আমদানি করা অত্যন্ত আকর্ষণীয় সস্তা কিন্তু নিম্নমানের ফসেট বাজারে প্রতিযোগিতার সৃষ্টি করেছে। এসব ফসেট অল্পদিন ব্যবহার করে ফেলে দিতে হয় বলে পরিবেশেরও ক্ষতি করছে।

ভবন নির্মাণের সঙ্গে সম্পৃক্ত ফসেট পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। দেশীয় পণ্য দাম মান বিবেচনায় স্থানীয় ভোক্তাদের কতটা আস্থা পূরণ করতে পারছে?

দেশীয় ফসেট রিসাইকেল করা যায় বলে অর্থনৈতিক গতি বাড়ানোর পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। রাজা মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ এরই মধ্যে ক্রেতার চাহিদা পূরণে নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রাজা মেটাল সেরা মানের ফসেট উৎপাদনের জন্য জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানে তৈরি মেশিন প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। ফলে নতুন নতুন আধুনিক ডিজাইনের ফসেট রাজা মেটাল সহজেই উৎপাদন করতে পারছে। এছাড়া কোয়ালিটি কন্ট্রোল নিশ্চিত করতে জাইকার পরামর্শে রাজা মেটালের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় কাইজান মেথড অনুসরণ করছে। তাই জাইকা রাজা মেটালকে সেক্টরের মডেল ফ্যাক্টরি হিসেবে ঘোষণা দেয়। ফসেট ইন্ডাস্ট্রি একাডেমিয়ার মিলন ঘটাতে এরই মধ্যে বুয়েটের একদল তরুণ শিক্ষার্থী রাজা মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজের ফ্যাক্টরি ভিজিট করেছে। আমরা আশা করছি দেশীয় মেধা, মননশীলতা অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে ক্রেতার জন্য আরো নতুন ডিজাইনের ফসেট শিগগিরই নিয়ে আসতে পারব, যা আমাদের জন্য হবে গেম চেঞ্জার।

শিল্পের উন্নয়নে সরকারের নতুন কী ধরনের নীতিসহায়তা আশা করেন?

ফাউন্ড্রি শিল্পে স্থায়ীভাবে সংগৃহীত স্ক্র্যাপ ব্যবহার করলে ভিডিএস বা উৎসে কর অব্যাহতি দেয়া হয়। আমাদের ফসেট ইন্ডাস্ট্রি ফাউন্ড্রি শিল্প হওয়া সত্ত্বেও আমরা কর অব্যাহতি পাচ্ছি না। একটি ফসেট উৎপাদনে অনেক যন্ত্রাংশের প্রয়োজন হয়। এর প্রতিটি পার্ট উৎপাদনে ইন্ডাস্ট্রিতে ছোট-বড় এক হাজারেরও বেশি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠানে মেধাবী পরিশ্রমী কর্মী থাকলেও মূলধনের তীব্র সংকট রয়েছে। দেশের প্রচলিত ব্যাংক ব্যবস্থায় লোন সংগ্রহ করা অত্যন্ত জটিল। শক্তিশালী ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তুলতে এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য আলাদা মূলধন নীতিমালা প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করতে ইন্ডাস্ট্রিতে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন অত্যাবশ্যক। সরকারি সহায়তায় দক্ষতা উন্নয়নে পর্যাপ্ত কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলে দেশীয় শিল্প হিসেবে ফসেট ইন্ডাস্ট্রি মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে।

ডলার সংকটের কারণে কাঁচামাল আমদানিতে জটিলতার মধ্যে পড়তে হচ্ছে কি?

ফসেট উৎপাদনে পিতলের পাশাপাশি কেমিক্যাল অপরিহার্য। ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ায় আমদানি ব্যয় ৫০-২০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। বৃহৎ শিল্প না হওয়ায় শিল্পের জন্য কেমিক্যাল আমদানিতে এলসি ওপেন করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। সব মিলিয়ে শিল্পে একটি অস্থির পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।

মূল্যস্ফীতির কারণে ভোক্তা চাহিদায় কোনো প্রভাব দেখা যাচ্ছে?

ফসেট ক্রেতারা খরচ কমাতে অন্যান্য সময়ের চেয়ে কম মূল্যের জিংকের তৈরি পণ্যের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্নমান জেনেও চীনে তৈরি এসব সস্তা পণ্য ব্যবহার করছে। এটি ফসেট শিল্পের জন্য ভালো নয়। তবে যারা মানের সঙ্গে আপস করছেন না, তাদের কাছে রাজার পণ্যের চাহিদা বেড়েছে।

বাংলাদেশে ফসেটের বাজারের আকার কত টাকার? অভ্যন্তরীণ চাহিদার বিপরীতে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতাই বা কতটুকু?

বাংলাদেশের স্যানিটারি জগতে দেশী বিদেশী মিলিয়ে হাজার কোটি টাকার বেশি পণ্য কেনাবেচা হয়। এর মধ্যে ৫০ শতাংশ বিদেশী পণ্য রয়েছে। স্বল্প মূল্যে আধুনিক ডিজাইনের পণ্য তৈরিতে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর আরো দক্ষতা অর্জন জরুরি। নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে আমাদের কর্মীদের পরিচয় অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। তবে মধ্যবিত্তের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ফসেট উৎপাদন বিপণনে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি মনোযোগী।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন