বাংলাদেশের রফতানি পরিসংখ্যান সন্দেহপূর্ণ?

বদরুল আলম

বাংলাদেশে অর্থনীতির অন্যতম প্রধান স্তম্ভ হলো রফতানি আয়। যদিও সরকারি পরিসংখ্যানের নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো দিচ্ছে রফতানির ভিন্ন ভিন্ন তথ্য। বাংলাদেশ ব্যাংক, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সর্বশেষ অর্থবছরের (২০২১-২২) রফতানি পরিসংখ্যানে কোনো মিল পাওয়া যাচ্ছে না। ইপিবি জানিয়েছে, সময় বাংলাদেশ থেকে রফতানি হয়েছে ৫২ বিলিয়ন ডলারের। এনবিআরের নিজস্ব প্রতিবেদনে মোট রফতানির অর্থমূল্য দেখানো হয়েছে ৪০ বিলিয়ন ডলার। আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে বলা হয়েছে, গত অর্থবছরে রফতানি হয়েছে ৪৯ বিলিয়ন ডলারের।

এর মধ্যে ইপিবির তথ্যটিকেই উপস্থাপন করা হয় রফতানি-সংক্রান্ত জাতীয় পরিসংখ্যান হিসেবে। সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, গত অর্থবছরে প্রথম দেশের পণ্য রফতানির অর্থমূল্য ৫০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছে। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টরা বিভিন্ন সময়ে উচ্ছ্বাসও প্রকাশ করেছেন। কিন্তু অন্য দুই সংস্থার তথ্যে রফতানির পরিমাণ দেখানো আছে ৫০ বিলিয়নের নিচে। 

বরাবরই পরিসংখ্যানের ভিত্তি হিসেবে এনবিআরের তথ্যের কথা উল্লেখ করে ইপিবি। কিন্তু এনবিআরের হিসাব রক্ষণাবেক্ষণের স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা অ্যাসাইকুডার তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর, বেনাপোল স্থলবন্দর ঢাকা বিমানবন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশ থেকে রফতানি হওয়া মোট পণ্যের অর্থমূল্য ছিল হাজার ৮০ কোটি বা ৪০ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। এখানে মোংলা থেকে পণ্য রফতানির তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

তবে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মোংলা বন্দর দিয়ে কিছু পণ্য রফতানি হলেও তা একেবারেই যৎসামান্য। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে হাজার ৭৬০ কোটি বা ৩৭ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি পরিমাণ পণ্য রফতানি হয়েছে। বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে রফতানি হয়েছে ৭৯ কোটি ৭৮ লাখ ডলারের। এছাড়া ঢাকা বিমানবন্দর দিয়ে ২৪০ কোটি ৩০ লাখ বা দশমিক বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে।

পরিসংখ্যানগত ভিন্নতার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান এএইচএম আহসান বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা নিজেরা কোনো ডাটা তৈরি করি না। এনবিআর থেকে অ্যাসাইকুডার ডাটা মাস শেষে আমাদের দেয়া হয়। আমরা শুধু আমাদের ফরম্যাট অনুযায়ী সাজাই। ভিন্ন ভিন্ন পরিসংখ্যান কেন হচ্ছে সেটা বলা সম্ভব না। এসব তথ্যকে রিকনসাইল করা দরকার।

একেবারে ভিন্ন তথ্য পাওয়া যায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যালান্স অব পেমেন্টের পরিসংখ্যানেও। শিপমেন্ট বা পণ্য জাহাজীকরণের উপাত্তের বরাত দিয়ে এতে জানানো হয়, ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে রফতানি হয়েছে হাজার ৯২৪ কোটি ডলার বা ৪৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বার্ষিক রফতানি আদায় (অ্যানুয়াল এক্সপোর্ট রিসিপ্টস) পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সময় তফসিলি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে পণ্য রফতানি করে দেশে প্রাপ্য অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় হাজার ৩০৬ কোটি বা ৪৩ বিলিয়ন ডলারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচক রফতানির তথ্য নিয়ে ধরনের বিভ্রান্তি কাম্য নয়। বিষয়টি এখন জাতীয় অর্থনীতির লক্ষ্য নির্ধারণ, নীতি প্রণয়ন থেকে শুরু করে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে কুহেলিকা তৈরি করছে। সামগ্রিকভাবে সরকারি তিনটি উৎসের তিন ধরনের তথ্য গোটা বিষয়টিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে।

বিষয়ে জানতে চাইলে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে এনবিআরের আওতাধীন একটি কাস্টম হাউজের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, আমদানি-রফতানির সব তথ্য রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা বা অ্যাসাইকুডার মাধ্যমে। এক্ষেত্রে আমদানি তথ্যের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তাব্যক্তিরা অনেক বেশি সচেতন। আমদানি পরিসংখ্যানগুলোর হিসাবও করা হয় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে। অন্যদিকে রফতানির তথ্য বেশির ভাগ সময়ই স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় প্রবেশ করে যাচাই-বাছাই ছাড়াই। রফতানিকারকরা নথিতে যা উল্লেখ করেন, সেটি নিয়ে তেমন একটা প্রশ্নও তোলা হয় না। রফতানির বিশ্বাসযোগ্য আস্থাভাজন তথ্য হিসেবে তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানকেই বিবেচনায় নেয়া উচিত। ব্যাংকিং চ্যানেলে রফতানির বিপরীতে প্রাপ্য অর্থকেই প্রকৃত রফতানি আয় হিসেবে আমলে নেয়া উচিত। তবে এটা ঠিক যে রফতানির সরকারি পরিসংখ্যানে এত ভিন্নতা থাকা ঠিক নয়। কারণ তা রফতানি পরিসংখ্যানের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বণিক বার্তাকে বলেন, আমদানি-রফতানি যা হচ্ছে সেগুলোর পরিমাণ সংকলন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অর্থের প্রকৃত হিসাব করলে অনেক বিষয়ই পরিষ্কার হওয়া যেত, কিন্তু দুঃখজনক হলো সেটা করা হয় না। যারা বাণিজ্য করছে, তারা ওভার-আন্ডার ইনভয়েসের মাধ্যমে অর্থ দেশের বাইরেই রাখছে। এগুলো শনাক্ত করার যথেষ্ট পথ বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে রয়েছে, কিন্তু তারা তা করে না। এখানে বলা হলো রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে। কিন্তু তা আসলে অর্থমূল্যে। যদিও এখানে দেখার প্রয়োজন হলো কী পরিমাণ পণ্য রফতানি হয়েছে। ভিন্নতার কারণে হিসাবের গ্রহণযোগ্যতা বা আস্থা এবং এর সঠিকতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। ভিন্ন ভিন্ন পরিসংখ্যানে নীতি প্রণয়নেও সমস্যা হয়। যেমন ভুল পরিসংখ্যানের ওপর ভিত্তি করে শুল্ক আরোপ করা হলে তার কার্যকারিতা থাকে না। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি ভুল পরিসংখ্যানের ওপর ভিত্তি করে প্রণোদনা দেয়, সেখানেও জটিলতা সৃষ্টি হয়। আসল কথা হচ্ছে সব তথ্য পরিসংখ্যান সমন্বয় হওয়া উচিত।

রফতানির পরিসংখ্যানে ভিন্নতার জন্য অসাধু বাণিজ্যিক চর্চা দায়ী বলে সন্দেহ করছেন খোদ ব্যবসায়ীরাও। তাদের বক্তব্য হলো বিশ্বের অন্য অনেক স্থানের মতো বাংলাদেশেও অর্থ পাচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র আন্তর্জাতিক বাণিজ্য। পণ্য রফতানি করে অর্থ দেশে না আনার অভিযোগ রয়েছে অনেক। ধরনের ঘটনা বাংলাদেশ ব্যাংকের নজর এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ কম। এর পরও নানা ফাঁকফোকর গলে এমন কাজ হওয়ার সুযোগ রয়েছে। এজন্য ব্যাংকের নজরদারি ব্যবস্থা আরো শক্ত হওয়া প্রয়োজন। যে কারণই থাকুক না কেন, পরিসংখ্যানগত ভিন্নতা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।

চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, রফতানির পরিসংখ্যানে এত ভিন্নতা থাকার কথা না। এতে তথ্যের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে অবশ্যই প্রশ্ন উঠছে। সরকারের সংস্থাগুলোর পরিসংখ্যানে বা বিলিয়ন ডলারের ভিন্নতা থাকতে পারে। কোনোভাবেই বড় ধরনের ভিন্নতা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তথ্যের ঘাটতি থাকলে তা দূর করা প্রয়োজন। 

দেশের রফতানি খাতের সবচেয়ে বড় অংশই তৈরি পোশাক। খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, রফতানির পরিসংখ্যানে কিছু পার্থক্য থাকতে পারে। রিসিপ্ট অনেক সময় কম হয় যৌক্তিক কারণেই। সরকারি একাধিক সংস্থা হিসাব রাখে রফতানি পরিসংখ্যানের। তবে পরিসংখ্যানে বড় ধরনের তারতম্য হওয়ার কোনো কারণ নেই।

পোশাক প্রস্তুত রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বণিক বার্তাকে বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে প্রাপ্ত পরিসংখ্যান নিয়ে আমাদের অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন। আমরা চ্যালেঞ্জ করতে পারছি না। কারণ আমাদের কাছে নিজস্ব কোনো পরিসংখ্যান নেই। রফতানির প্রকৃত পরিমাণ যাচাইয়ে নিজস্ব কোনো ব্যবস্থাও নেই। আমি মনে করি কাস্টমস, কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট সবাই যথাযথ নজরদারির মাধ্যমে পরিসংখ্যানগুলোর যথার্থতা নিশ্চিত করতে পারে। আর রফতানিকারকরা অর্থ নিয়ে আসার বিষয়ে সবসময়ই সচেষ্ট থাকেন।


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন