সঞ্চয়ের জন্য দেশে ব্যাংকের চেয়ে নিরাপদ কোনো জায়গা নেই

মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা

অর্ধশতাব্দী ধরে বিশ্বব্যাপী ইসলামী ধারার ব্যাংকিংয়ের জয়গান চলছে। প্রচলিত ধারার ব্যাংকিংয়ের তুলনায় সময়ে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের প্রবৃদ্ধি বিস্তৃতি হয়েছে অনেক বেশি। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইসলামী ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে শুরু করে। ১৯৬৩ সালে মিসরে প্রতিষ্ঠিত হয় মিটগামার ব্যাংক। ইসলামী ধারার ব্যাংকিংয়ের পথপ্রদর্শক হিসেবে ব্যাংকটি ভূমিকা রেখেছে। ১৯৭৪ সালে ওআইসি সব মুসলিম দেশের আর্থিক ব্যবস্থা ইসলামিক পদ্ধতিতে ঢেলে সাজানোর সুপারিশ করে। ১৯৭৫ সালে দুবাই ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮৩ সালে দক্ষিণ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশেই প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। বর্তমানে বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনা করছে ১০টি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ধারার ব্যাংক, যা দেশের ব্যাংক খাতের প্রায় ৩০ শতাংশ বাজার অংশীদারত্ব ধারণ করছে।

বিশ্বে বর্তমানে ৫২০টির মতো ইসলামী ব্যাংক কার্যরত রয়েছে। মুসলিম দেশগুলো ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিম ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, হংকং, আর্জেন্টিনা শ্রীলংকার মতো দেশেও ইসলামী ব্যাংকিং জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। বিশ্বে বর্তমানে ইসলামী ব্যাংকিং অ্যাসেটের পরিমাণ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে, যা ২০১২ সালেও ছিল দশমিক ট্রিলিয়ন ডলার। বিশ্বব্যাপী মন্দাচক্রের মধ্যেও ইসলামী ব্যাংকিং দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে।

ইসলামী ব্যাংকিংয়ের প্রধান লক্ষ্য হলো মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্য গ্রহণযোগ্য একটি সুদবিহীন ব্যাংকিং ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা। একই সঙ্গে এটি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য উন্মুক্ত কল্যাণকর। ইসলামী শরিয়াহর যে বৃহত্তর লক্ষ্য অর্থাৎ জাগতিক শোষণ থেকে মানবজাতিকে মুক্ত করা, আর্থিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংকিং সেটাই বাস্তবায়ন করে। সর্বোচ্চ মুনাফাকরণ নীতির বিপরীতে ইসলামী ব্যাংকিং সর্বাধিক মানুষকে সেবা প্রদান, সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় খাতে বিনিয়োগ উৎসাহিতকরণ, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তকরণে কাজ করে। তিন দশক আগে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড তৃণমূল পর্যায়ে শরিয়াহভিত্তিক মাইক্রোফাইন্যান্স কার্যক্রম শুরু করেছিল, বর্তমানে যা দেশের চতুর্থ বৃহৎ মাইক্রোফাইন্যান্স প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। সর্বোপরি ইসলামী ব্যাংকিংয়ের লক্ষ্য হলো আর্থিক সেবার মাধ্যেম জনকল্যাণ প্রসারিত করা।

সমাজে এখনো ভুল ধারণা আছে যে প্রচলিত ধারার ব্যাংকের সঙ্গে ইসলামী ব্যাংকের কোনো পার্থক্য নেই। আসলে দুটির মধ্যে কার্যপদ্ধতি উদ্দেশ্যগতভাবে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। ইসলামী ব্যাংক প্রফিট-লস শেয়ারিং পদ্ধতিতে আমানত গ্রহণ করে বিধায় গ্রাহকদের পূর্বনির্ধারিত হারে মুনাফা দেয় না। সাময়িক হারে মুনাফা দেয়া হয়, যা চূড়ান্ত বার্ষিক হিসাব শেষে সমন্বয় করা হয়। ইসলামী ব্যাংক সুদের ভিত্তিতে ঋণ দেয় না, বরং প্রয়োজনীয় পণ্য বা সম্পদ কিনে দেয়, ভাড়া দেয় বা অগ্রিম কিনে নেয়। অ্যাসেট-ব্যাকড লেনদেনের কারণে ইসলামী ব্যাংক অর্থনীতিতে ঋণের বুদ্বুদ তৈরি করে না। বিনিয়োগ পরিশোধে দেরি হলে ইসলামী ব্যাংক প্রচলিত ব্যাংকের মতো অতিরিক্ত সুদ আদায় করে না। তবে ইচ্ছাকৃত খেলাপি নিরুৎসাহিত করার জন্য জরিমানা ধার্য করে তা সমাজকল্যাণে ব্যয় করে। যতই মুনাফাজনক হোক, ইসলামী ব্যাংক মদ, জুয়া, তামাক বা কোনো ক্ষতিকর প্রকল্পে বিনিয়োগ করে না।

ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে যাচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান দুই খাত পোশাক শিল্পের বিকাশ প্রবাসী রেমিট্যান্স ব্যাংকিং চ্যানেলে আহরণে ইসলামী ব্যাংক যেমন পথিকৃৎ, তেমনি সর্বাধিক ভূমিকা পালনকারী। দেশে ছয় হাজারের বেশি শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে ব্যাংকের অর্থায়নে। ব্যাংকের বিনিয়োগে কর্মসংস্থান হয়েছে ৮৫ লাখ মানুষের। দেশের সিএসএমই খাতে সর্বাধিক বিনিয়োগ করেছে ব্যাংক। জাহাজ নির্মাণসহ পরিবহন আবাসন খাতে রয়েছে সর্বাধিক বিনিয়োগ। ব্যাংক দেশের সর্বোচ্চ আমদানি-রফতানি বাণিজ্য পরিচালনাকারী। বেসরকারি খাতে দেশের সর্বাধিক সার আমদানি হয় ব্যাংকের মাধ্যমে। পাশাপাশি দেশের মোট বৈদেশিক রেমিট্যান্সের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এককভাবে আহরণ করছে ইসলামী ব্যাংক। দেশের ৩১ হাজার গ্রামের ১৬ লাখ প্রান্তিক পরিবারকে ক্ষুদ্র ঋণ দিয়ে স্বাবলম্বী করেছে ব্যাংক।

সাফল্য যতই থাকুক, অনেক সময় ভুল তথ্যের কারণে ব্যাংক সম্পর্কে সাধারণ মানুষের আস্থার সংকট তৈরি হয়। ব্যাংক খাত খুবই স্পর্শকাতর। তাই খাত সম্পর্কে সংবাদ প্রকাশে গণমাধ্যমকে আরো সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। সংবাদকর্মীরা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। পৃথিবীর কোনো দেশেই ব্যাংকের বিকল্প হয় না। বাংলাদেশের মতো আর্থিক পরিকাঠামোয় ব্যাংকই হলো অর্থনীতি মানুষের প্রধান ভরসাস্থল। সঞ্চয়ের জন্য দেশে ব্যাংকের চেয়ে নিরাপদ কোনো জায়গা নেই। আতঙ্কিত হয়ে যারা ব্যাংক থেকে টাকা তুলে ঘরে নিয়েছিলেন, তারা আবারো টাকা নিয়ে ব্যাংকে ফিরছেন। পুঁজিবাজারসহ বিকল্প উৎসগুলো শক্তিশালী হয়ে উঠলেও ব্যাংকিং সেবা দেশের আর্থিক খাতের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে থাকবে।

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড দেশে কল্যাণমুখী ব্যাংকিং ধারার প্রবর্তক। সব শ্রেণীর মানুষকে সঞ্চয়ে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে আমরা শুরু থেকেই বিশেষ সঞ্চয় প্রকল্প চালু করেছি। নিয়মিত চলতি সঞ্চয়ী হিসাবের পাশাপাশি ব্যাংকের বিশেষ হিসাবের মধ্যে রয়েছে মুদারাবা বিশেষ (পেনশন) সঞ্চয় প্রকল্প, মুদারাবা সেভিংস বন্ড, মুদারাবা ওয়াকফ ক্যাশ ডিপোজিট হিসাব, মুদারাবা হজ সঞ্চয় হিসাব, মুদারাবা মোহর সঞ্চয় হিসাব, সিনিয়র সিটিজেনদের মাসিক মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয় স্কিম, মুদারাবা এনআরবি সেভিংস বন্ড, প্রবাসী গৃহায়ণ সঞ্চয় স্কিম, মুদারাবা মাসিক মুনাফা হিসাব, স্টুডেন্টস মুদারাবা সঞ্চয় হিসাব মুদারাবা কৃষক সঞ্চয় হিসাব, ইন্ডাস্ট্রিয়াল এমপ্লয়িজ সেভিংস স্কিম, উপহার ডিপোজিট চেকসহ বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয় প্রকল্প। দেশের মানুষ এসব সঞ্চয় প্রকল্পকে নিজেদের কল্যাণে গ্রহণ করছে। কারণে ইসলামী ব্যাংক হয়ে উঠেছে দেশবাসীর আশা-ভরসার আশ্রয়স্থল। আমানত-বিনিয়োগসহ অন্যান্য সূচকে দেশের সর্ববৃহৎ ব্যাংক হওয়ার পাশাপাশি ইসলামী ব্যাংক এখন প্রায় দুই কোটি মানুষের পরিবার।

 

মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা: ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন