ব্যাংক খাতকে আরো বেশি সুশৃঙ্খল করতে হবে

হেলাল আহমেদ চৌধুরী

ব্যাংক ব্যবস্থা হচ্ছে একটি দেশের অর্থনীতির ধারক-বাহক। ইট ইজ দ্য ভেহিকল অব ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট। দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা যত সুষ্ঠু সুশৃঙ্খল, যত বেশি গাইডলাইন মেনে চলে, তত বেশি ব্যবস্থা ভালোভাবে চলতে পারে। স্টেকহোল্ডারদের কাছ থেকে কোনো অনৈতিক হস্তক্ষেপ না থাকাটি এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। তাতে ব্যাংকেরও ভালো হয়, দেশেরও ভালো হয় এবং সরকারের অগ্রাধিকার খাতে তা অবদান রাখতে পারে। এতে দেশের উন্নয়ন ঘটে। প্রধানমন্ত্রী প্রায় বলেন, আমরা দেশের নিচুস্তরে উন্নয়ন ঘটাব, সে উন্নয়নে ব্যাংক ব্যবস্থার অনেক বেশি সম্পৃক্ততা দরকার।

ব্যাংক গ্রাহকদের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করে। সেটা লগ্নি করে ব্যাংকের প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হয়। এভাবেই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যাংক সংশ্লিষ্ট হয়। এটিকে বলা হয় ইন্টারমিডিয়েশন। প্রাথমিকভাবে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত নিয়মে ব্যাংক নিজস্ব একটি পুঁজি নিয়ে যাত্রা করে। তারপর আমানত আসতে থাকে। সে আমানত থেকে ব্যাংক কর্মকর্তারা লগ্নি করেন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রদত্ত নীতিমালা অনুসরণ করা হয়। আইন নিয়ম-নীতির মধ্যে থেকে আমাদের সুষ্ঠুভাবে ঋণ বিতরণ করতে হয়। তা আদায়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হয়। ঋণ সঠিক জায়গায় যাচ্ছে কিনা তা যাচাই করতে হয়। এক্ষেত্রে সমাজ, রাষ্ট্র জনগণের উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট খাতে যেন ঋণ যায়, সেদিকে আমাদের মনোযোগ থাকে বেশি। আবার ব্যাংকে যারা আমানত রেখেছেন, যারা স্টেকহোল্ডার, তাদেরকে লভ্যাংশ দেয়ারও একটি ব্যাপার থাকে। কারণে লাভ করাটা ব্যাংকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মুনাফার ধারা বজায় রাখতে গিয়ে ব্যাংকের এমন কোনো কাজে জড়িত হওয়া উচিত নয়, যা পরবর্তী সময়ে ব্যাংকের জন্য ক্ষতির কারণ হবে। আপনি বিবেচনা না করে ঋণ দিলেন, পরবর্তী সময়ে সে ঋণখেলাপি হলে ব্যাংকেরই তা হয়তো মাফ করতে হবে কিংবা আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তা আদায়ের ব্যবস্থা নিতে হবে। ব্যাংকের ব্যবসাই তো হচ্ছে লগ্নি করা। আমানতের জিম্মা নেয়া। পুনরায় সুষ্ঠুভাবে আমানত ফেরত দেয়া।

১৯৭৭ সাল থেকে আমার ব্যাংকিং ক্যারিয়ার শুরু। ৪০ বছর ব্যাংক কর্মকর্তা হিসেবে আমি কাজ করেছি। এখনো সংশ্লিষ্ট আছি খাতের সঙ্গে। বাংলাদেশে ব্যাংকিংয়ের গোড়াপত্তন, রূপান্তর, বিকাশ আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। সে অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, বর্তমানে অনেক উন্নয়ন ঘটেছে। বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ থেকেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। এখান থেকে পাট রফতানি হতো। অথচ টাকা যেত পশ্চিম পাকিস্তানে। উন্নয়ন হতো পশ্চিম পাকিস্তানের। আমরা উন্নয়নের ভাগ পেতাম না। তখন পরিবারতন্ত্র ছিল। ব্যাংকগুলো বিভিন্ন পরিবারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরিবারতন্ত্রের কবল থেকে মুক্ত করার জন্য বঙ্গবন্ধু ছয়টি ব্যাংক জাতীয়করণ করেছিলেন। নামগুলোও তারই দেয়া। পূবালী, সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী উত্তরা। পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে সেগুলো বিকাশ লাভ করে। প্রথম দিকে বাংলাদেশের কৃষি খাতে ব্যাংকগুলোর বিরাট অবদান ছিল। যুদ্ধবিদ্ধস্ত একটি দেশে বঙ্গবন্ধুকে সবকিছু অনেক কষ্ট করে করতে হয়েছে। আমাদের প্রাথমিক বাজেট ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। এরপর ধীরে ধীরে বাজেট বড় হয়েঠে। রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট সব ভাঙাচোরা ছিল। বঙ্গবন্ধুকে একটি বিদ্ধস্ত অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করতে হয়েছে। তখন অর্থনীতিতে কৃষি খাতের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। সাতাত্তরে আমরা যখন ব্যাংক খাতে যোগদান করি, তখন লিড ব্যাংক স্কিম করে কৃষিতে ১০০ কোটি টাকার প্রকল্প শুরু হয়েছিল। প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষককে কীভাবে সহায়তা দেয়া যায়, কৃষিকে আরো কীভাবে বিস্তৃত করা যায়, তা ছিল স্কিমের উদ্দেশ্য। এরপর আশির দশক থেকে শিল্পায়নের যাত্রা হয়। নব্বইয়ের দশকে এতে ভালো একটি উত্তরণ ঘটেছে। আশির দশকে কিছু ব্যাংক বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া হয়। এর মধ্যে পূবালী উত্তরা ছিল।

প্রায়শই অনেকে বলেন, ব্যাংক খাত পাকিস্তান আমালের মতো পরিবার তন্ত্রে জিম্মি হয়ে গেছে। এক্ষেত্রে আমার পর্যবেক্ষণ ভিন্ন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ব্যাংক পরিবারতন্ত্রে ফিরে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এখনকার রুলস রেগুলেশন্সে সে সুযোগ নেই। পর্ষদে একই পরিবারের সদস্য সংখ্যা বাড়ানোর বিষয়ে অনেকে প্রশ্ন তোলেন। এক্ষেত্রে যে বিষয়টি খেয়াল করতে হবে, বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক, সরকার এবং আমাদের দেশে যারা আমাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠান আছেএসবের সমন্বিত তদারকির কারণে ব্যাংক ব্যবস্থা পরিবারতন্ত্রের দিকে যাওয়াটা সম্ভব হবে না। খেয়াল রাখতে হবে, দু-চারটি ব্যাংকের জন্য পুরো খাতের বদনাম যেন না হয়। কারণ, দেশের ব্যাংক খাত অনেক বড়। বাংলাদেশ যে উন্নয়নের ধারাবাহিক অগ্রযাত্রায় আছে, এতে ব্যাংক খাতের অবদান সবচেয়ে বেশি। যদি ডিজিটাল বাংলাদেশ না হতো, তাহলে কভিডের সময় আমরা অনেক পিছিয়ে যেতাম। এটা কোনো নির্দিষ্ট মতের পক্ষের কথা না। এটা ফ্যাক্ট। কভিডের সময় আমাদের কোনো কর্মকাণ্ড কিন্তু স্থবির হয়নি। ভার্চুয়ালি আমরা সব মিটিং করতে পেরেছি। সব বোর্ড মিটিং করতে পেরেছি। সব ধরনের ইনস্ট্রাকশন দিতে পেরেছি। একেবারে অল্প কয়েকদিনের জন্য, যখন কভিডের প্রকোপ খুব বেশি ছিল, তখন বন্ধ ছিল। এরপর সব আবার স্বাভাবিক হয়ে গেছে। কর্মচারীরা হোম অফিস করেছে। এই যে উন্নয়ন ঘটেছে এবং ঘটছে, তা সঠিকভাবে মূল্যায়ন হওয়া প্রয়োজন।

কিছু ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এটি যেকোনো মূল্যে প্রতিরোধ করতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান পরিষ্কার করা দরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর মহোদয়ের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে আমি বলতে চাই, আমরা নিয়ম-নীতি বজায় রেখে সব ধরনের সহায়তার মধ্যে আছি, কিন্তু অনিয়মের সঙ্গে নেই। তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটায় প্রত্যন্ত অঞ্চলের খবরও মুহূর্তের মধ্যে সাংবাদিকদের নজরে চলে আসছে। কারণে যে যেই দায়িত্ব পালন করছে, তাকে খুব সচেতন থাকতে হচ্ছে। দায়িত্ব পালনে অবহেলার জন্য জবাবদিহিতাও আছে। দেশের উন্নয়নে ব্যাংকিং ব্যবস্থার অবদান অনেক বেশি। এজন্য ব্যাংক খাতকে আরা বেশি সুশৃঙ্খল করা দরকার। বর্তমানে আমরা যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছি, যেমন ডলার সংকট, খেলাপি ঋণ, তারল্য সংকট ইত্যাদি ব্যাংক ব্যবস্থার অঙ্গই।

বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু ক্যামেল রেটিং করে। তা কনফিডেন্সিয়াল। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের বরাতে গণমাধ্যমে অনেক তথ্য আসে। কিছু কিছু নেতিবাচক খবরও আসে। তখন ব্যাংকারদের দেখতে হবে, আমরা কতটুকু গাইডলাইন মেনে চলছি। একদম কেতাবি নিয়মে তো ব্যবসা করা যাবে না। ব্যবসা করতে হলে ব্যবসার মতোই করতে হবে। সেখানকার মানসিকতার সঙ্গেও অনেক সময় অ্যাডজাস্টমেন্ট করতে হচ্ছে। কিন্তু দেখতে হবে, প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষতি হচ্ছে কিনা। প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি হলে, যারা স্পন্সর, তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ব্যাংক যদি ভালো নিয়ম-নীতির মধ্যে চলে, তাহলে স্টেকহোল্ডাররাই ভালো ডিভিডেন্ড পাবে। যে ব্যাংকের কমপ্লায়েন্স লেভেল ভালো, যে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা ভালো, যারা গাইডলাইনের মধ্যে থাকে, যারা নিয়ম-নীতির মধ্যে চলার চেষ্টা করে, সেটি গ্রাহকদের কাছেও ভালো ব্যাংক হিসাবে স্বীকৃতি পাবে। তবে যতক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো ব্যাংকের লাইসেন্স বাতিল করেনি, আমরা সেটিকে ভালো বলব। তার মধ্যেও কিন্তু গ্রেডেশনে ভিন্নতা আছে, কমপ্লায়েন্স লেভেলে তারতম্য থাকতে পারে। আবার কোনো ব্যাংকের যদি পরিবারতন্ত্রে প্রবেশের ইনটেনশন থাকে, তাহলে সে ব্যাংকের ম্যানেজমেন্ট ভালো হবে না। সেক্ষেত্রে ব্যাংকটি ভালোভাবে চলতে পারবে না।

আমানতকারীদের জন্য আমার পরামর্শ হবে, অনেক সময় দেখা যায়, কিছু ব্যাংক বেশি সুদ প্রলোভিত করে, এদিকে সচেতন দৃষ্টি রাখতে হবে। সেখানে চিন্তাভাবনা করে যেতে হবে। কোনো প্রলোভনে পা দেয়া যাবে না। দ্বিতীয়ত, অনেক সময় দেখা যায়, ট্রানজেকশনে টাকা ওঠাতে পারছেন না, এদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে, কেন টাকা ওঠানো গেল না। সেজন্য এখানে গ্রাহককে সচেতন থাকতে হবে। ক্যামেল রেটিংগুলো লক্ষ্য করতে হবে। এছাড়া মার্কেট পারসেপশন বলে একটি কথা আছে। ব্যাংকটির মানুষের কাছে কী অবস্থান আছে, পত্রিকান্তরে কোনো ধরনের নেতিবাচক খবর বেরোচ্ছে কিনা, আমানত কোনভাবে হ্যাম্পার করছে কিনা তা খেয়াল রাখতে হবে। আবার কোনো অপপ্রচার হচ্ছে কিনা, সেটিও খেয়াল রাখতে হবে। ব্যাংকিং হলো আস্থার জায়গা। ছোট একটি অপপ্রচার আস্থার জায়গাটা নষ্ট করে দিতে পারে। আস্থা তৈরি করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়, কিন্তু নষ্ট হয়ে যায় সহজে। সেজন্য ব্যাংকিং খাত যেন কোনো মেলপ্রোপাগান্ডার শিকার না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তবে সঠিক তথ্য উঠে আসা দরকার বলে আমি মনে করি। সার্বভৌম স্বাধীন বাংলাদেশী হিসেবে জাতিসংঘসহ সারা বিশ্বে আমাদের সুনাম বাড়ছে, সেটি আমরা নষ্ট হতে দিতে পারি না। আমরা আজকে ২৫তম অর্থনীতির দেশ হয়েছি। ২০৩১, ২০৪১ ২১০০ সালের যে রূপকল্পগুলো আছে, সেগুলো কিন্তু ভেরি মাচ ইন লাইন উইথ দ্য ডেভেলপমেন্ট। এটি অর্জন করতে হলে ব্যাংক ব্যবস্থাকে আরো দৃঢ় করতে হবে। আরো সুশৃঙ্খল করতে হবে। আরো কমপ্লায়েন্ট হতে হবে। ব্যাংকের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি আরো বাড়াতে হবে।

অদ্যাবধি বাংলাদেশ সরকার কোনো ব্যাংক ব্যর্থ হতে দেয়নি। যদিও বিদেশে ধরনের কাঠামোতে ধরনের ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইসিস হলে ব্যাংক বন্ধ হয়ে যেত। আমি মনে করি, যে দু-চারটি ব্যাংক নিয়ে কথা হচ্ছে, তারা অবশ্যই উন্নতি করবে। আমাদের সদাশয় সরকার মানুষের আমানতের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে ব্যাংকগুলোকে বিভিন্ন ফর্মে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে বাঁচিয়ে রেখেছে। আমার মনে হয়, যাদেরকে বাঁচিয়ে রেখেছে, তাদেরও প্রচেষ্টা নেয়া উচিত, যেন তারা এসব সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। পূবালী ব্যাংক যখন বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া হয়, তখন খেলাপি ঋণের হার ছিলো ৪০ শতাংশেরও বেশি। ব্যাংকটি লোকসানি ছিলো। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দৃষ্টিতে এটি ছিলো একটি প্রবলেম ব্যাংক। ১৯৯০ সালের দিকে আমরা প্রবলেম ব্যাংক ক্যাটাগরিতে পড়ি। ২০০৫ সালেরে দিকে থেকে আমাদের উত্তরণ ঘটে। পরবর্তী বছরগুলোতে পূবালী ব্যাংক ধারাবাহিকভাবে উন্নতি করেছে। ধারাবাহিকতায় ২০০৯ সালে পূবালী ব্যাংক বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ ব্যাংক হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ডিএইচএল এবং ডেইলি স্টার যৌথভাবে স্বীকৃতি দেয়। সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোর জন্য পূবালীর উন্নতি দৃষ্টান্ত হতে পারে। নতুন প্রজন্মের ব্যাংকারদের জন্য আমার বার্তা হলো, আপনাদের না বলা শিখতে হবে।

 

হেলাল আহমেদ চৌধুরী, সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, পূবালী ব্যাংক লিমিটেড

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন