শিগগিরই গ্রাহকদের শরিয়াহভিত্তিক সেবা দেয়া হবে

নাসিমুল বাতেন

আর্থিক খাতে বর্তমানে কিছুটা তারল্য সমস্যা আছে, ফলে সুদের হার ঊর্ধ্বমুখী। কিছু অনিয়মের কারণে সম্প্রতি মানুষের মধ্যে খাতের প্রতি আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি ডলারের সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক প্রচুর ডলার বিক্রি করেছে। সে ডলার কিনেছে ব্যাংকগুলো। ফলে ব্যাংক থেকে প্রচুর পরিমাণ টাকা চলে গেছে। এতেও বাজারে তারল্যে কিছুটা টান পড়েছে। ব্যাংক ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো (এনবিএফআই) পরস্পর সম্পর্কিত। ব্যাংকে তারল্য সংকট হলে এর প্রভাব এনবিএফআইয়ের ওপরও পড়ে। কারণ অনেক এনবিএফআই পুরোপুরি ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল। ডিবিএইচ মূলত গ্রাহকের আমানতের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার কারণে ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীলতা নেই। তবে বাজারের সুদহারের ওঠানামার প্রভাব তো রয়েছেই। ব্যাংক খাতে সুদ বাড়লে এনবিএফআই খাতেও বাড়ে। কারণ গ্রাহকরা তো প্রায় একই। কেউ কেউ সঞ্চয়ের কিছু অংশ ব্যাংকে রাখেন, কিছু অংশ এনবিএফআইতে রাখেন। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক পুনঃঅর্থায়ন তহবিলের মাধ্যমে বাজারে তারল্য সরবরাহ করতে শুরু করেছে। তবে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অর্থনীতিতে টাকার জোগান আসতে কিছুটা সময় লাগবে। ফলে তারল্য সংকট খুব দ্রুত কাটবে না। কারণে কিন্তু সুদের হার বাড়ছে। বর্তমানে ব্যাংক খাতে ঋণের সুদহারের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করে দেয়া আছে। কারণে আমানতকারীদের খুব বেশি সুদ দিতে পারছে না ব্যাংকগুলো। এনবিএফআইয়ের জন্য একইভাবে সুদহারের সীমা বেঁধে দেয়া আছে। দেশের ব্যাংক এনবিএফআইগুলো একই ধরনের পণ্য নিয়ে কাজ করে। ফলে ঋণের ক্ষেত্রে ব্যাংকের সুদের হারের চেয়ে এনবিআইয়ের সুদের পার্থক্য খুব বেশি হলে গ্রাহককে আকৃষ্ট করা সম্ভব হয় না। যেমন ব্যাংকগুলো যদি আবাসন খাতে শতাংশ সুদে ঋণ দেয় তাহলে ডিবিএইচকেও এর কাছাকাছি সুদে ঋণ দিতে হবে। ফলে আপনি উচ্চ সুদে আমানত নিতে পারবেন না। কারণ আপনাকে যদি শতাংশের কাছাকাছি হারে ঋণ দিতে হয় তাহলে আমানতের ক্ষেত্রে শতাংশের বেশি সুদ দেয়ার সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে স্প্রেড থাকে মাত্র শতাংশ, যা পর্যাপ্ত নয়। বর্তমানে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার কারণে যে হারে আমানতের সুদ দেয়া হচ্ছে তা গ্রাহকদের আকৃষ্ট করতে পারছে না। আমানতের পাশাপাশি ঋণের সুদহার নিয়েও চিন্তা করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি মুদ্রানীতির বিবৃতিতে বলেছে, কনজিউমার ঋণের ক্ষেত্রে সুদহারের সীমা প্রযোজ্য হবে না, অন্যান্য ঋণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। ধাপে ধাপে যদি সীমা উঠিয়ে দেয়া হয় তাহলে আমানতের সুদহার আরো বাড়ানো সম্ভব হবে। সুদহার বাড়ানোর মাধ্যমে আমানত রাখার প্রতি গ্রাহকদের আকৃষ্ট করা সম্ভব। যখন কোনো গ্রাহক টাকা রাখবেন, তিনি দেখবেন দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তিনি যথেষ্ট রিটার্ন পাচ্ছেন কিনা। যদি যথেষ্ট রিটার্ন পান, তাহলেই টাকা রাখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন। কনজিউমার ঋণের ক্ষেত্রে কোন ধরনের ঋণগুলো এর আওতায় পড়বে সেটি পুরোপুরি খোলাসা করা হয়নি। এক্ষেত্রে যদি ব্যক্তিগত ঋণ গাড়ির ঋণ যোগ করা হয় তাহলে এর পরিমাণও মোট ঋণের তুলনায় খুব নগণ্য। এতে খুব বেশি প্রভাব পড়বে না। সেক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকদের আরো চিন্তা করতে হবে। কীভাবে এতে সামঞ্জস্য স্থাপন করা যায়। কারণ আমানতকারীকে যদি সামঞ্জস্য রেখে রিটার্ন দিতে না পারা যায়, তাহলে অবশ্যই তাদের আকর্ষণ করা কঠিন হয়ে যাবে। পুনঃঅর্থায়ন তহবিল একটা সাময়িক সমাধান হতে পারে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে যেকোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য আমানত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমানতের প্রবাহ বজায় রাখা প্রয়োজন। এজন্য দীর্ঘমেয়াদে আমানতকারীর ব্যাপারে চিন্তা করতে হবে। এমনভাবে আমানতের সুদহার অফার করতে হবে যেন আমানত না কমে। ডিবিএইচের কথাই যদি বলি। পঁচিশ বছর ধরে আমরা ব্যবসা করছি। আমরা সবসময় চেয়েছি, যেন আমানতকারীর আস্থায় কোনো অবস্থাতেই চিড় না ধরে। পরপর সতেরো বছর ট্রিপল রেটিং অর্জন করেছি আমরা। যত বেশি পরিমাণই হোক না কেন আমরা  কোনো আমানতকারীকে টাকা ফেরত দেয়ার ক্ষেত্রে কখনোই দেরি করিনি। এটার জন্য আমাদের সবসময় উদ্বৃত্ত তারল্য বজায় রাখতে হয়। এতে যদিও প্রতিষ্ঠানের মুনাফার ওপর প্রভাব পড়ে। তার পরও সবসময় আমরা বিশ্বাস করি, আমানতকারীর আস্থা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সবসময় যে বেশি সুদ দিয়ে আমরা আমানত সংগ্রহ করেছি তা নয়। গ্রাহকের আস্থাকে পুঁজি করেই আমরা সেটি করেছি। করপোরেট সুশাসনের জন্য এনবিএফআই খাতে আমরা পর পর চার বছর গোল্ড অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছি। আমাদের ঋণগুলো দীর্ঘমেয়াদে ১৫ কিংবা ২০ বছরের জন্য। অন্যদিকে আমানত নিচ্ছি স্বল্পমেয়াদে ছয় বারো মাসের জন্য। এটাকে অসামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হতে পারে। কিন্তু কেউ তো আসলে ১৫-২০ বছরের জন্য আমানত রাখবে না। বাংলাদেশে অনেক সময় সুদের হারে খুব দ্রুত ওঠানামা হয়। কখনো দ্রুত বেড়ে যায়, কখনো দ্রুত কমে যায়। ফলে ১৫-২০ বছরের জন্য আমানত পাওয়া যায় না। কারণে আমাদের স্বল্পমেয়াদে আমানত নিয়ে দীর্ঘমেয়াদে ঋণ দিতে হচ্ছে। তবে গ্রাহকদের আস্থার কারণেই স্বল্পমেয়াদের আমানতগুলো বারবার নবায়ন হয়ে দীর্ঘমেয়াদি তহবিলে পরিণত হচ্ছে। আমরা রিটেইল করপোরেট দুই ক্যাটাগরির গ্রাহকের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করে থাকি। দুই ধরনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনের ওপর ভিত্তি করে আমাদের প্রডাক্টগুলো ডিজাইন করা। প্রচলিত আমানত স্কিম আছে তিন মাস, ছয় মাস বারো মাস মেয়াদে। এক্ষেত্রে মেয়াদ শেষে মুনাফা পাবেন। আরেক ধরনের আমানত স্কিম রয়েছে ১২ মাস বা তিন বছরের জন্য আপনি আমানত রাখবেন। এক্ষেত্রে প্রতি মাসেই আপনি মুনাফা পাবেন। কেউ কেউ তিন মাস পর পর মুনাফা নিয়ে থাকেন। এছাড়া আমাদের ডিপিএস প্রডাক্ট রয়েছে সঞ্চয়কারীদের জন্য। কেউ যদি মনে করেন, বাড়ি বানানোর জন্য দীর্ঘমেয়াদে সঞ্চয় করা প্রয়োজন, তার সুযোগ রয়েছে। অনেকটা ডিপিএসের মতোই, তবে দীর্ঘমেয়াদে। স্কিমকে আমরা বলছি ইজি ডিপোজিট। ইজি ডিপোজিটে প্রতি মাসে একবার বা একাধিকবার টাকা জমা রাখা যায়। কোনো মাসে কম বা বেশি দেয়া যায়। কোনো মাসে টাকা না দিলেও সমস্যা নেই। এর বাইরে শরিয়াহভিত্তিক মুদারাবা ডিপোজিট উইন্ডোটা ইনশা আল্লাহ আগামী এক মাসের মধ্যেই আমরা শুরু করব। এরই মধ্যে -সংক্রান্ত সব ধরনের বাধ্যবাধকতা আমরা পরিপালন করেছি। এটি বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। ইনকাম শেয়ারিং রেশিও (আইএসআর) পদ্ধতি অনুসারে এখানে মুনাফার ভাগ দেয়া হবে। আমাদের শরিয়াহভিত্তিক উইন্ডো মোট যে আয় করবে, তার নির্দিষ্ট একটি অংশ গ্রাহক মুনাফা হিসেবে পাবেন। এখানে মুনাফার অংশ নির্ধারিত থাকলেও ব্যবসা থেকে কত আয় হবে সেটি নির্দিষ্ট নয়। আয় কম-বেশি হতে পারে। ব্যবসা থেকে আয় বেশি হলে গ্রাহক মুনাফা বেশি পাবেন আর আয় কম হলে মুনাফাও কম পাবেনযা সম্পূর্ণ শরীয়াহসম্মত। এরই মধ্যে দেশের স্বনামধন্য শরীয়াহ বিশেষজ্ঞদের নিয়ে আমরা একটি শরিয়াহ কমিটি করেছি। তাদের দায়িত্ব হচ্ছে শরিয়াহর বিধান অনুসরণ করে সবকিছু করা হচ্ছে কিনা সেটি নিশ্চিত করা। আমাদের প্রচলিত অন্যান্য স্কিমের মতো শরিয়াহ পণ্যের ক্ষেত্রেও মাসিক বা ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে মুনাফার অর্থ তুলে নেয়ার সুবিধা থাকবে। আমরা গ্রাহকের চাহিদার দিকটি মাথায় রেখেই প্রডাক্ট ডিজাইন করেছি। বর্তমানে শরিয়াহভিত্তিক পণ্যের চাহিদা ক্রমাগত বাড়ছে। তাদের জন্যই আমরা শরিয়াহ উইন্ডো চালু করেছি। আশা করছি বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন সাপেক্ষে সামনের মাসে দেশব্যাপী আমাদের সব শাখা থেকেই গ্রাহকদের শরিয়াহভিত্তিক সেবা দিতে পারব।

 

নাসিমুল বাতেন: ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)

ডিবিএইচ ফাইন্যান্স পিএলসি

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন