জোগো বনিতোয় কাতার মাতাচ্ছেন নেইমাররা

ক্রীড়া প্রতিবেদক

ব্রাজিলের জোগো বনিতো ফুটবলের সৌরভ ছড়িয়েছে পারস্য উপসাগরের উপদ্বীপ কাতারের সর্বত্র। এর ঢেউ লেগেছে হাজার হাজার মাইল দূরবর্তী ব্রাসিলিয়া, রিও, সাও পাওলোয়। বাংলাদেশ, ভারতসহ এশিয়ার অধিকাংশ দেশ, ইউরোপ, আমেরিকার দেশে দেশেও এখন সাম্বার দেশের ফুটবল নিয়ে গল্প, তর্ক-বিতর্ক। ফুটবলবোদ্ধাদের প্রশংসা কুড়াচ্ছেন দলটির খেলোয়াড় নেইমার, প্যাকেতা আর রিচার্লিসনরা।

ব্রাজিল ফুটবলের সোনালি অতীতকে খানিকটা হলেও মনে করিয়ে দিতে পেরেছেন নেইমার তার সতীর্থরা। সোমবার রাতে স্টেডিয়াম ৯৭৪- ৯০ মিনিটের খেলায় দক্ষিণ কোরিয়াকে যেন সম্মোহিত করে রাখলেন সেলেসাওরা। ৩৬ মিনিটের মধ্যেই চার-চারটি গোল, আর প্রতিটি গোল উদযাপনকেই বাড়তি মাত্রা দিয়েছে ব্রাজিলিয়ানদের নাচ। জোগো বনিতোর ফেরাকে যেন পূর্ণতা দিয়েছে কবুতর নাচ।

গোল করেছেন ভিনিসিয়ুস, নেইমার, রিচার্লিসন প্যাকেতা। তবে ২৯ মিনিটের সময় রিচার্লিসনের করা তৃতীয় গোলটি নিয়েই আলোচনা। টটেনহাম স্ট্রাইকার সার্বিয়ার বিপক্ষে বাইসাইকেল কিক থেকে গোল করে মুগ্ধতা ছড়ান। দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে তার করা গোলটিও সেরার তালিকায় থাকবে ওপরের দিকে। সেন্টার ব্যাক মার্কিনোস আর থিয়াগো সিলভার অ্যাসিস্ট নিয়ে তিনি কাতার বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা গোলটি করেন।

রিচার্লিসনের গোলে মুগ্ধ হয়ে ব্রাজিল কোচ তিতেও শিষ্যদের সঙ্গে নাচে যোগ দিলেন। ৬১ বছর বয়সী তিতেও যখন নাচেন তখন প্রতিপক্ষরা সাবধান! প্রতিপক্ষ দলগুলোকে কি বিশেষ বার্তাই দিয়ে রাখলেন ব্রাজিল কোচ? তিনি বুঝিয়ে দিলেন, আনন্দিত ব্রাজিল, সুখী ব্রাজিল কতটা ভয়ংকর। আর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ব্রাজিল জিতে চললে তিনিও নেচে যাবেন। 

তিতে নিজের মুখেই বলেছেন, নাচের একটি ভাষা আছে। তার কথায়, তারা খুবই অল্পবয়সী এবং আমি সবসময়ই তাদের ভাষার সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করি। তাদের একটি ভাষা আছে, সেটি হলো নাচ।

ব্রাজিল খেলোয়াড়দের নাচ পূর্বপরিকল্পিত। খেলোয়াড়দের সঙ্গে যোগাযোগ মিথস্ক্রিয়তা বাড়াতে নাচের সঙ্গে তিনি যুক্ত হন বলে জানান কোচ। তিতে আগেই বলে রেখেছেন, তাকে শিখিয়ে দেয়া হলে তিনিও শিষ্যদের সঙ্গে নাচবেন। তিতের কথায়, নাচের মুভগুলো কীভাবে করতে হয়, সেটি আপনাকে শিখতে হবে। আর মুভগুলো সহজ নয়।

দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে ব্রাজিলের প্রথমার্ধের খেলা ছিল প্রতিপক্ষের জন্য ভয়ংকর, আর ব্রাজিল সমর্থকদের চোখ আর মনের জন্য স্বস্তি আরামদায়ক। যেন চুরানব্বইয়ের রোমারিও, বেবেতো কিংবা আটানব্বই ২০০২-এর রোনালদো, রোনালদিনহো কাকাদের ফিরে আসা। নেইমারকে ঘিরে যেন আক্রমণের পসরা সাজিয়ে রাখে সেলেসাওরা, তাতে প্রতিপক্ষ দলটি স্রেফ উড়ে যায়। নেইমার, রিচার্লিসন, রাফিনহা, লুকাস প্যাকেতা, ক্যাসেমিরোরা প্রতিপক্ষের রক্ষণকে ভেঙে চুরমার করে দেন। তাতে প্রথমার্ধেই - গোলের লিড নেয় লাতিন জায়ান্টরা। প্রথমার্ধে গোলের পাশাপাশি সমানতালে গোল মিসের মহড়াও চলছিল সেলেসাওদের। ৪৫ মিনিটের মধ্যে ব্যবধান - হলেও হতে পারত।

সবচেয়ে বড় তারকা নেইমারের ফেরা দলের মধ্যে উদ্দীপনা এনে দিয়েছে। ক্যামেরুনের কাছে হারের দুঃখ ভুলে ব্রাজিল ফিরেছে স্বরূপে। সার্বিয়ার বিপক্ষে নিজেদের প্রথম ম্যাচেই ডান গোড়ালির লিগামেন্ট মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় নেইমারের। সেই থেকে মাঠে ফিরতে তার ছিল রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা। ফিজিওথেরাপিস্টদের নিবিড় তত্ত্বাবধানে থেকে অনেকটা দ্রুতই সেরে উঠেছেন নেইমার।

দলে নেইমারের প্রভাব নিয়ে কোচ তিতে বললেন, নেইমার দলের মধ্যে টেকনিক্যাল লিডারশিপ নিয়ে এসেছে। ব্রাজিলের সহকারী কোচ সিজার সাম্পাইও বলছেন, নেইমার প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিবেশ তৈরি করে, সে মাঠে ব্যবধান গড়ে দেয়।

ম্যাচ শেষে নিজের ফেরা নিয়ে নেইমার বলছেন, আমি খুবই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ইনজুরিতে পড়ায় আমি সারা রাত কেঁদেছি। আমি কিসের মধ্য দিয়ে গিয়েছি তা আমার পরিবার জানে। কিন্তু পরিশেষে সবকিছু ভালোভাবে হয়েছে। থেরাপি নিয়ে নিয়ে আমি সেরে উঠেছি। সবকিছু নিয়ে আমি খুশি। তবে হ্যাঁ, আজকের পারফরম্যান্স নিয়ে আমি কখনই শতভাগ সন্তুষ্ট হব না। আমাদের একটি দল হিসেবে আরো উন্নতি করতে হবে।

নেইমারের অপেক্ষায় ছিল পুরো ব্রাজিল দল। তিনি এলেন, দেখলেন এবং জয় করলেন। মাত্র তৃতীয় ব্রাজিলিয়ান খেলোয়াড় হিসেবে তিনটি বিশ্বকাপেই গোল করার কৃতিত্ব দেখালেন ৩০ বছর বয়সী নেইমার। পেলে চারটি (১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৬৬ ১৯৭০) বিশ্বকাপে এবং রোনালদো নাজারিও তিনটি (১৯৯৮, ২০০২ ২০০৬) বিশ্বকাপে গোল করেছেন।

আর একটি গোল করলেই কিংবদন্তি ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার পেলের গোলের রেকর্ড ছুঁয়ে ফেলবেন নেইমার। ৯২ ম্যাচে ৭৭ গোল নিয়ে এতদিন রেকর্ডটা ধরে রেখেছেন তিনবারের বিশ্বকাপজয়ী খেলোয়াড় পেলে। শিগগিরই তার গোলের রেকর্ডটা নিজের করে নিতে পারেন নেইমার।

তবে গোলের রেকর্ডের জন্য নয়, নেইমার মরিয়া প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ শিরোপায় চুমু খেতে। ব্রাজিল ফুটবলে অমরত্ব পেতে সোনায় মোড়ানো ট্রফি জয়ের কোনো বিকল্পও নেই। সেটা জানেন বলেই ৩০ বছর বয়সী ফরোয়ার্ড নিজের সেরাটা নিংড়ে দিতে তৈরি আছেন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন