ফুটবল যেভাবে ইরানি ঐতিহ্যের অংশ হলো

আহমেদ দীন রুমি

১৯৯১ সালে ইরানের আজাদি স্টেডিয়াম

১৮৯৮ সালের কথা। ইসফাহানে বসবাসকারী ব্রিটিশ দলের সাথে আর্মেনিয় দলের ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হল। ইরানের জানা ইতিহাসে সেটিই প্রথম ফুটবল ম্যাচ। ক্রমে সেখানকার ব্রিটিশ অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে ছড়িয়ে পড়তে থাকে ফুটবলের চর্চা। ১৯০৭ সালে তেহরানে প্রথমবারের মতো আয়োজন করা হয় টুর্নামেন্ট। অংশগ্রহণ করে মাত্র তিনটি দল-অ্যাম্বাসি অব গ্রেট ব্রিটেন, ইমপেরিয়াল ব্যাংক অব পারসিয়া এবং ইন্দো-ইউরোপিয়ান টেলিগ্রাফ কোম্পানি। সে বছরই প্রতিষ্ঠিত হয় তেহরান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন ক্লাব। ব্রিটিশ খেলোয়ার পাওয়া না গেলে স্থানীয় ইরানিয়দের অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হতো সেখানে। ফলে জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে ফুটবলের। ১৯১০ সালে স্যামুয়েল মার্টিন জর্ডান মিশনারি স্কুলে শরীর চর্চার অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেন ফুটবল। স্থানীয় জনগণ ফুটবলের ঘনিষ্ঠতা লাভ করে অ্যাংলো-পারসিয়ান অয়েল কোম্পানির ব্রিটিশ কর্মচারিদের খেলা দেখে। যুক্ত হয় উঠতি তরুণেরা। তখনকারই একজন ইরানিয় ফুটবলার কারিম জান্দি।

  

১৯১৪ সালে বেজে ওঠে বিশ্বযুদ্ধের দামামা। ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত সাউথ পারসিয়া রাইফেলস্-এর ইরানি সৈন্যদের মধ্যে চলতে থাকে ফুটবল ম্যাচ। যুদ্ধে শেষ হলে ১৯২০ সালে কতিপয় ইরানিয় ও ব্রিটিশ ফুটবলপ্রেমী একত্রিত হয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ‌'মাজমা-ই ফুটবল-ই ইরান' বা ইরানিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন। প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ইমপরিয়াল ব্যাংক অব ইরানের পরিচালক জেমস ম্যাক মুরে। সে বছরই প্রতিষ্ঠিত হয় প্রথম ফুটবল দল ইরান ক্লাব। কারিম জান্দি, আলি শুকুহ, হাসান মেফতাহ সে দলের সদস্য। প্রতিষ্ঠিত হয় তেহরান ক্লাব, আমেরিকান স্পোর্টস ক্লাব এবং তুফান ক্লাবের মতো বেশ কিছু ফুটবল দল। সে সময় হোসেইন সাদাগিয়ানির মতো কয়েকজন খেলোয়ার ইউরোপের বিভিন্ন ক্লাবে খেলতেন। তাদের মাধ্যমেই ইরানে ফুটবল লাভ করে নতুন রূপ। সেই সাথে বিনোদনের ফ্রেম থেকে বের হয়ে সেখানকার রাজনীতির সাথে মিশে যায় ফুটবলের গল্প।

 

১৯২৫ সালে ইরানের মসনদে বসেন রেজা শাহ। তার প্রতিষ্ঠিত সাংবিধানিক রাজতন্ত্র স্থায়ী ছিল ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যাপক সংস্কার সাধিত হয় সে সময়ে। স্থাপিত হয় আধুনিক ইরানের ভিত্তি। সেই আধুনিকতার অন্যতম প্রতীক ফুটবল। রেজা শাহ নিজেও ফুটবল নিয়ে আগ্রহী ছিলেন। ব্রিটিশ ও ইরানিয়দের মধ্যে অনুষ্ঠিত ম্যাচে উপস্থিত ছিলেন তিনি। প্রথমবারের মতো তখনই ব্রিটিশদের পরাজিত করে ইরান। অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য পনেরো জন ফুটবলারকে বাকুতে আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্টে পাঠানো হয়। ফুটবলের পোশাকের সাথে ধর্মীয় সীমালঙ্ঘনের বিষয় থাকে। ফলে সমাজে ফুটবলের জনপ্রিয়তা অর্জন বেশ কঠিন। তারপরও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৩৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর ফিজিক্যাল এডুকেশন। ফুটবল সেখানে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবেই যুক্ত থাকে।

 

১৯৪৫ সালে ন্যাশনাল ফুটবল ফেডারেশন প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ফিফার সদস্য পদ লাভ করে। ষাটের দশকে ফুটবল পরিণত হয় দেশের প্রধান দর্শকপ্রিয় খেলায়। টেলিভিশন ও রেডিওর প্রসার, নতুন স্টেডিয়াম প্রতিষ্ঠা, জনজীবনে আধুনিকতার হাওয়া ফুটবলের অগ্রযাত্রাকে ত্বরান্বিত করে। ১৯৬৮ সালের একটা ঘটনা এই ক্ষেত্রে অন্যতম। ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরায়েল আরব দেশগুলোকে পরাজিত করেছিল। তার ঠিক পর পরই এশিয়ান ন্যাশনস কাপে ইসরায়েলকে পরাজিত করে ইরান। স্বাভাবিকভাবেই খেলার ফলাফল ইরানিয়দের মধ্যে ধর্মীয় ও জাতীগত গৌরবের নিয়ামক হয়ে দাঁড়ায়। যদিও শাহ শাসনের বিরুদ্ধে অন্যতম বড় অভিযোগ ছিল, তিনি তার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যর্থতা ঢাকার জন্য ফুটবলের জনপ্রিয়তাকে ব্যবহার করছেন। ১৯৭৮ সালে পারভিজ কিলিচখানি ক্যালিফোর্নিয়ায় দেয়া সংবাদ সম্মেলনে বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করা ইরানি দল থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়ার ঘোষণা দেন। তার ভাষায় এই ঘোষণা ছিল ইরান শাসকের নির্যাতনের প্রতিবাদ।

 

ইসলামি বিপ্লবের পর ইরানে ফুটবল জনপ্রিয়তা হ্রাস পেতে থাকে। পশ্চিমা ভোগবাদী সমাজের খেলা হিসেবে পরিগণিত হয় ফুটবল। উত্তেজনা ও নারীর উপস্থিতির জন্যও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও সভা-সমাবেশে ফুটবলবিরোধী বক্তব্য দিতে থাকেন। আশির দশকের কোন বিশ্বকাপেই ইরান অংশগ্রহণ করতে পারেনি ইরাক-ইরান যুদ্ধ (১৯৮০-৮৮)-এর কারণে। এমনকি ঘরোয়া খেলাও ক্ষতিগ্রস্ত হয় ব্যাপকভাবে। তবে দ্রুতই ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতারা বুঝতে পারেন ফুটবলের জনপ্রিয়তা। শিথিল হতে থাকে অবস্থান। ১৯৯০ সালে বেইজিং-এ অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হয় রাষ্ট্রীয় ভাবে। ইরান গোল্ড মেডেল লাভ করলে ফুটবলপ্রীতি অন্য মাত্রা পায়। ১৯৯৮ সালে বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করার সুযোগ পেয়ে সারা দেশ ফেটে পড়ে উল্লাসে।

 

১৯৯৮ সালে বিশ্বকাপের আসরে প্রথম মুখোমুখি হয় ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র। ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর যুক্তরাষ্ট্রের ইরান নীতি ও ইরানের যুক্তরাষ্ট্র নীতি ছিল প্রকাশ্য। ফলে এই খেলা ছিল বাড়তি উন্মাদনা। খেলার আগে প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন যোগাযোগ করেন। ফিফা বিশেষ নজর রাখে। খেলা শেষ হয় ২-১ ব্যবধানে ইরানের জয় দিয়ে। মধ্যপ্রাচ্য জুড়েই উদযাপন করা হয় ঐতিহাসিক বিজয়। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আরো একবার খেলা হয় ইরানের। ২০০০ সালে অনুষ্ঠিত সেই প্রীতি ম্যাচ শেষ হয় ড্র দিয়ে। ২০০৬, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে ইরান বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করলেও গ্রুপ পর্ব অতিক্রম করতে পারেনি। ক্রমে নারীরাও অংশগ্রহণ করতে থাকে ফুটবলে। ২০০৮ সালে ফিফার প্রতিবেদনে ইরানের ভেতরে ৫৮টি নারী দলের উপস্থিতি উল্লেখ করা হয়েছে।

 

ইরানিয় ফুটবলের কথা আসলেই আলি দাইয়ির নাম না আসাটা অন্যায়। ইরানের ম্যারাডোনা নামে পরিচিত এই ফুটবলার ১৪৯ টি ম্যাচে খেলে দেশের হয়ে ১০৯টি গোল করেছে। ২০২১ সালে এসে শুধু ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোই সেই রেকর্ড স্পর্শ করেন।

 

আজ বাংলাদেশ সময় রাত ১টায় কাতারে মুখোমুখি হতে যাচ্ছে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র। যথারীতি রাজনৈতিক টানাপোড়েনের বারুদ প্রভাবিত করবে ফুটবলকে। ইরান হয়তো ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনার মতো না, কিন্তু এশিয় দেশ হিসেবে ইতিহাসের অধিকাংশ সময় প্রথম সারিতেই থেকেছে।  

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন