সময়ের ভাবনা

অর্থনীতির কঠিন সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উদযাপন

ড. এস এম এমদাদ হোসাইন

বিভিন্ন সমীক্ষায় প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে আমাদের দারিদ্র্যের হার ২৫ শতাংশের কাছাকাছি। অক্টোবর ২০২২- প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের একটি বিবরণীতে দেখা যায়, ২০১৬-১৭ সালে আমাদের দারিদ্র্যের হার ২৪ দশমিক শতাংশ। জানিয়ে রাখা ভালো, আমি অর্থনীতিবিদ নই এবং অর্থনীতি নিয়ে আমার খুব বেশি পড়াশোনাও নেই। তবে গ্লোবাল ভিলেজে বসবাসকারী একজন নাগরিক হিসেবে অর্থনীতির মৌলিক বিষয়গুলো জানার চেষ্টা করি। বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতি যেকোনো দেশ, জাতি, পরিবার বা ব্যক্তি; যার যার অবস্থান থেকে প্রয়োজন মেটানো বা টিকে থাকার প্রত্যয়ে লড়ছে। করোনা-পরবর্তী বিশ্ব অর্থনীতি এমন হতে পারে, যার পূর্বাভাস দিয়ে রেখেছিলেন বিশ্বের অনেক বড় বড় অর্থনীতিবিদ। ওই পূর্বাভাসকে গ্রাহ্য করে যে যত বেশি সতর্কতা অবলম্বন করেছে, সে অন্তত অন্যের তুলনায় কিছুটা হলেও সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। পরিস্থিতিতে সর্বোপরি ব্যয় সংকোচন চোখে পড়ার মতো। ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে সামষ্টিক অর্থনীতি সব জায়গায় ব্যয় সংকোচন লক্ষণীয়। ব্যয় সংকোচন করেও সাধারণ মানুষের মাঝে স্বস্তি ফিরে আসছে না। নিত্যদিনের আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বিভিন্ন বিকল্প পণ্যের দিকে ঝুঁকছে মানুষ। কম খাওয়ার অভ্যাস করছে, গাড়ি বা বাহন ব্যতিরেকে হেঁটে অফিসে যাওয়াও ইদানীং বেশ দেখা যাচ্ছে। অনেক পরিবার শহর ছেড়ে গ্রামে বসবাস করছে। আবার একটা বাসা একাধিক পরিবার মিলে শেয়ার করছে। মোটকথা ব্যয় সংকোচনের সম্ভব সব পথে আজ সাধারণ মানুষ হাঁটছে। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের দেশের কিছু প্রতিষ্ঠান উল্টো পথে না হাঁটলেও ব্যয় সংকোচনের চেষ্টায় আন্তরিকতার যথেষ্ট ঘাটতি লক্ষণীয়। যেমন ধরা যাক, কিছু কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাদের স্বাভাবিক পাঠদানের পাশাপাশি অতিরিক্ত ব্যয়সংবলিত সব কার্যক্রম চালু রেখেছে। এক্ষেত্রে অভিভাবকদের ব্যয় করতে হচ্ছে মোটা অংকের অর্থ। প্রয়োজনে ধারদেনা করে অভিভাবকরা এসব অতিরিক্ত চাহিদা মেটাচ্ছেন। সম্প্রতি তেমনই এক অভিভাবক আমাকে জানিয়েছেন, ক্লাস পার্টি নামক অদূরদর্শী চিন্তার এক খড়গের কথা। তিন ছেলেমেয়ের পড়াশোনার কথা বলতে গিয়ে অতিরিক্ত খরচের বিড়ম্বনার কথা শুনালেন। চলছে বার্ষিক পরীক্ষা, পরিশোধ করতে হবে বেতন, দিতে হবে পরীক্ষার ফি, সেই সঙ্গে ক্লাস পার্টির নির্ধারিত চাঁদা। করোনা মহামারী-পরবর্তী অর্থনৈতিক ধকলের মধ্যে ক্লাস পার্টির মতো এমন সব স্বল্প গুরুত্বপূর্ণ আয়োজন মধ্যবিত্ত নিম্নমধ্যবিত্তের জন্য এক কথায় নিপীড়ন। বনভোজন, ক্লাস পার্টি, বছর শেষের পার্টি, বিভিন্ন সামাজিক উপলক্ষ হরহামেশা লেগেই থাকে। এসব করতে মানা নেই, কিন্তু বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি, আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থা, মানুষের জীবন-জীবিকার আপত্কালীন সংকট বিবেচনায় এসব আয়োজন অদূরদর্শী চিন্তার তিক্ত ফসল বলাই শ্রেয়। ছোট ছোট কোমলমতি শিশু-কিশোর জানে না অর্থনৈতিক সংকট, বোঝেনা বিশ্ব পরিস্থিতি। সুতরাং তারা চাইবে যে ভাবেই হোক এমন আয়োজনে উপস্থিত হওয়া। অন্যথায় না পাওয়ার ব্যথা মানসিক পীড়া তাদের তাড়া করবেই। এসব সাধারণ বোধ শিক্ষকের মতো সুশিক্ষিত মানুষকে যদি নতুন করে বোঝাতে হয়, এটা হবে অনেক কষ্টের। শুরুর দিকে উল্লিখিত পরিসংখ্যান থেকে সহজে অনুমেয়, দারিদ্র্য এখনো দেশ ছেড়ে যায়নি। সেই সঙ্গে চলছে অর্থনৈতিক মন্দা। এত কিছুর পরও অনেকের টনক নড়ছে না, এটা ভাবতে অবাক লাগছে।

করোনার বৈরী পরিস্থিতিতে পাঠদানে যথেষ্ট ব্যত্যয় ঘটলেও অভিভাবককে শিক্ষার খরচ কিন্তু যথাযথ পরিশোধ করতে হয়েছে। অনলাইনে পাঠদান করেও নির্ধারিত হারে মাসিক বেতন দিতে হয়েছে। একই স্কুলে থেকেও প্রতি বছর ভর্তি ফি বাবদ হাজার হাজার টাকা দিতে হচ্ছে। বলা বাহুল্য, বিশ্বের যে কয়েকটা দেশে আমার যাওয়া হয়েছে, আমি নিয়ম কোথাও দেখিনি বা শুনিনি। করোনা মহামারীর সময় বেতন কমানোর প্রশ্ন সামনে এল শিক্ষা কার্যক্রম সচল রাখার নির্দিষ্ট খরচের কথা। সেটা না হয় মেনে নিলাম। কিন্তু প্রতি বছর একই স্কুলে, এক শ্রেণী থেকে আরেক শ্রেণীতে পুনরায় ভর্তির নামে হাজার হাজার টাকা ভর্তি ফি গ্রহণ যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ। যা হোক এসব নিয়ে অনেক বিজ্ঞ-কলামিস্ট হয়তো অনেক লিখেছেন। এটা নিয়ে লেখা আমার আজকের লেখার উদ্দেশ্য নয়। আমার খারাপ লাগার বিষয়টি হলো স্কুলগুলো নিজেদের চাহিদামতো সব ফি আদায় করেও বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটের ঘন কালো আবহের মধ্যে ক্লাস পার্টির মতো এমন কিছু অনুষ্ঠানের নামে টাকা বা চাঁদা আদায় করা কতটুকু গ্রহণযোগ্য কাজ, এটা দেশের শিক্ষাসংশ্লিষ্ট সব দায়িত্বশীল অবশ্যই অবেক্ষণ করবেন। আমি বলছি না, এসব টাকা স্কুল কর্তৃপক্ষ আত্মসাৎ করছে। এও বলছি না, তারা টাকা দিতে বাধ্য করছে। আমার প্রশ্ন বর্তমান পরিস্থিতির বিচারে এমন আয়োজনের যৌক্তিকতা নিয়ে। এবার একটু দেখা যাক বহির্বিশ্বের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা বা সহপাঠ্যক্রমিক অতিরিক্ত পাঠ্যক্রম নিয়ে তাদের কর্মপদ্ধতি। শিক্ষার্থীদের জন্য সব আয়োজনের খরচ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বহন করে এমন উদাহরণ বিশ্বের স্বল্পোন্নত থেকে উন্নত দেশে মেলা ভার। আমি অস্ট্রেলিয়ায় পিএইচডিরত অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়াজনে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থায়নে শিক্ষা সফরে অংশগ্রহণ করেছি। ছাত্র হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত কোনো অনুষ্ঠানে কোনোদিন কোনো অর্থ বা চাঁদা দিয়েছি বলে আমার মনে পড়ে না। বর্তমানে আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করছি, সে বিশ্ববিদ্যালয়ে গত সপ্তাহে একটা সাধারণ শিক্ষা সফরে কিছু স্নাতক শ্রেণীর শিক্ষার্থী পাঠিয়েছি। ওই সফরের সম্পূর্ণ খরচ আমার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বহন করেছে। এমন কার্যক্রম শুধু একটা নয়। ছাত্রছাত্রীদের জন্য আয়োজিত সব আয়োজনের অর্থায়ন আমার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ করে। উচ্চতর ডিগ্রি থেকে স্নাতকের উদাহরণ টানলাম, এবার আসি ছোটদের স্কুলে। আমার ছেলে এখানকার একটা স্কুলে পড়াশোনা করে। ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে স্কুলের কোনো আয়োজনে স্কুল কর্তৃপক্ষ কখনো একটা টাকা চেয়েছে বলে মনে পড়ে না। বরং বিভিন্ন পুরস্কার, নানা রকম খাবার স্কুলের অর্থায়নে প্রতিনিয়ত খুদে শিক্ষার্থীরা উপভোগ করে। মৌলিকভাবে এটাই এখানকার প্রথা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান নয়। এখানকার স্কুলগুলোর সার্বিক কার্যক্রম দেখে স্পষ্টত এটাই প্রতীয়মান। হয়তোবা বহির্বিশ্বের সঙ্গে আমাদের দেশের তুলনা পরম যৌক্তিক নাও হতে পারে। বিভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন কর্মপদ্ধতি বা পরিকল্পনা থাকতে পারে এবং থাকাটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। দেশের নাগরিক সমাজও এটা মেনেই চলছে। কিন্তু অর্থনীতির ক্রান্তিকালে আমাদের যার যার অবস্থান থেকে অনেক বেশি দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। সম্পদ ব্যবস্থাপনা-সম্পর্কিত জ্ঞানের প্রয়োগ দেখাতে হবে। ভালো স্কুলের তকমা দিয়ে দায়িত্বহীন কর্মকাণ্ড অথবা দায়িত্ব এড়িয়ে চলা কাম্য নয় এবং কোনোভাবে এটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সময়োপযোগী নয় এমন অযাচিত আয়োজন শুধু শিক্ষার্থী বা তার পরিবারের ওপর চাপিয়ে দেয়া বোঝা নয়, এটা সুষম বণ্টনের সংজ্ঞার সঙ্গে সংগতিপূর্ণও নয়। যেখানে একটা দেশের ২০-২৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যের কশাঘাতে পিষ্ট, সেখানে এমন বিলাসী আয়োজন বন্ধ করা সময়ের দাবি। সহপাঠ্যক্রমিক অতিরিক্ত পাঠ্যক্রম অবশ্যই প্রয়োজন, কিন্তু এটা হতে হবে সাধ সাধ্যের সমন্বয়ে। এটা হতে হবে সামাজিক দায়বদ্ধতার গণ্ডির মধ্যে, এটা হতে হবে রাষ্ট্রের সামষ্টিক অর্থনৈতিক অবস্থার আলোকে। অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় যথাযথ কর্তৃপক্ষ ব্যাপারে সময়োপযোগী উদ্যোগ নেবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, অর্থনীতিতে অর্থ সঞ্চালন যেমন প্রয়োজন, তেমনি সময়োপযোগী সুষম বণ্টনও অনেক বেশি প্রয়োজন।

 

. এস এম এমদাদ হোসাইন: বিভাগীয় প্রধান সহকারী অধ্যাপক, তথ্য পদ্ধতি বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব নিজওয়া, ওমান

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন