প্রভাবশালী মহলের চাপে ভূমির শ্রেণী পরিবর্তন

আল ফাতাহ মামুন

দিয়াবাড়ী খাল দখল করে গড়ে উঠেছে বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ২০১৪ সালে ভূমির শ্রেণী পরিবর্তন করেছে ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

২০১৭ সালের ৩১ জুলাই গৃহায়ন গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা শাখা- থেকে একটি প্রজ্ঞাপন জারি হয়। মেরাদিয়া মৌজার আরএস দাগ ১৫৯৫- অবস্থিত ভূমির শ্রেণী পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ড্যাপে চিহ্নিত ভূমিটির ব্যবহার শ্রেণী জলাশয় থেকে আবাসিকে পরিবর্তনের অনুমোদন দেয়া হলো। একইভাবে ২০১৬ সালের ১৬ জুলাই প্রজ্ঞাপন জারি করে কেরানীগঞ্জের বাঘৈর, আবদুল্লাহপুর, কুমলির চকসহ বেশকিছু মৌজার জমি আরবান রেসিডেন্সিয়াল জোন হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এর আগে এসব এলাকা ব্যবহার হতো কৃষিজমি হিসেবে। প্রভাবশালীদের চাহিদা অনুযায়ী গত তিন দশকে দ্রুত শ্রেণী পরিবর্তন হয়েছে ঢাকার ভূমির। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধরনের শ্রেণী পরিবর্তনের সিংহভাগই হয়েছে অবৈজ্ঞানিক অপরিকল্পিত উপায়ে। ফলে ঢাকা ক্রমেই বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে।

জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনের সর্বশেষ প্রতিবেদনমতে, দিয়াবাড়ী খাল দখল করে বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি (বিইউএফটি) গড়ে উঠেছে। নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, ২০১৪ সালের ১৪ অক্টোবর জারি করা গৃহায়ন গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে তুরাগ থানার ভাটুলিয়া গ্রামের ২১৫, ২১৬১ ২১৭ ২৩৬ নং আরএস দাগের জমিকে খোলা জায়গার (ওপেন স্পেস) পরিবর্তে প্রাতিষ্ঠানিক প্লট হিসেবে শ্রেণী পরিবর্তনের ঘোষণা দেয়া হয়। বিজিএমইএ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জমির শ্রেণী পরিবর্তন করা হয়।

জলাভূমির শ্রেণী আবাসিকে পরিবর্তন করা হয়েছে ঢাকার কেন্দ্রে অবস্থিত গুলশান, মিরপুর মতিঝিলেরও অনেক এলাকা। গুলশান থানার ফায়দাবাদ মৌজার দশমিক ১৪ একরের ওয়াটারবডি, ক্যান্টনমেন্ট থানার কাফরুল মৌজার দশমিক কাঠা ওয়াটারবডি, মিরপুরের সেনপাড়া মৌজার ওয়াটারবডি খিলক্ষেত থানার বরুয়া মৌজার একটি খালসহ অন্যান্য এলাকার কৃষিজমি বিলুপ্ত করে আরবান রেসিডেন্সিয়াল জোন হিসেবে শ্রেণী পরিবর্তন করা হয়েছে। এছাড়া মতিঝিল থানার রাজারবাগ মৌজার ১৩টি দাগের ২০ কাঠা জলাভূমির (ওয়াটারবডি) শ্রেণী পরিবর্তন করে আরবান রেসিডেন্সিয়াল জোন করা হয়। শ্রেণী পরিবর্তনের কারণ হিসেবে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়, খালের সংযোগ না থাকায় এটিকে আবাসিক এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।

চলতি শতকের শুরুতেও ঢাকার অধিকাংশ এলাকায় যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ছিল নৌপথ। বছর দশেক আগেও পূর্বাচলে ধানসহ মৌসুমি ফসল চাষাবাদে ব্যস্ত সময় কাটাতেন স্থানীয়রা। এমন চিত্র এখন দেখা যাবে শুধু ঢাকার ডেমরা নাসিরাবাদ এলাকায়। নগরায়ণের চাপে বিলুপ্ত হয়েছে ঢাকার অধিকাংশ এলাকার কৃষিজমি জলাভূমি। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, প্রভাবশালীদের হাত ধরেই ঢাকার ভূমি প্রকৃতির দ্রুত পরিবর্তন ঘটেছে। আর অপরিকল্পিতভাবে শ্রেণী পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় অনেক ক্ষেত্রেই সহযোগিতা করেছে সরকারি সংস্থাগুলোও। সার্বিকভাবে অদূরদর্শী উন্নয়নের কারণে বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে ঢাকা।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ঢাকার ভূমির শ্রেণী পরিবর্তনের ইতিহাস বেশি দিনের নয়। নব্বইয়ের দশক থেকে দ্রুত শ্রেণী পরিবর্তন হতে থাকে নগরীর। আশির দশকে নগর উন্নয়নে গুরুত্ব দেয়া হলে সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় রাজধানী ঢাকা। মূলত তখন থেকেই ঢাকায় অপরিকল্পিত নগরায়ণ বাড়তে থাকে বলে মন্তব্য করেছেন রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ। তিনি বলেন, গত ৩০ বছরে ঢাকার ভূমি শ্রেণীর দ্রুত পরিবর্তন হয়েছে। সরকারিভাবে অনেক খাল-জলাশয় কৃষিজমিকে আবাসিক বাণিজ্যিক শ্রেণীতে রূপান্তর করা হয়। প্রভাবশালীরা বিভিন্ন উপায়ে ঢাকার জলাভূমি কৃষিজমি দখল করে আবাসন ব্যবসা গড়ে তুলেছে। এক্ষেত্রে নগরের প্রাণবৈচিত্র্য প্রকৃতি-পরিবেশ নিয়ে ভাবা হয়নি। এর পরিপ্রেক্ষিতেই ঢাকা পরিণত হয়েছে বিশ্বের অন্যতম বসবাস অনুপযোগী নগরে।

নগর গবেষকরা জানিয়েছেন, ঢাকায় মূলত চার শ্রেণীর ভূমিরূপ দেখা যায়নাল, বিল, বোরো ভিটা। এর মধ্যে ভিটা হলো বসতির জন্য ব্যবহূত জমি। তিন ফসলি জমি বোরো হিসেবে চিহ্নিত। আর এক ফসলি, দুই ফসলি জলাভূমি হিসেবে ব্যবহার হয় নাল বিল। ঢাকায় তিন ফসলি জমির মধ্যে খিলক্ষেত, প্রগতি সরণি এলাকা থেকে শুরু করে পূর্বাচল হয়ে রূপগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এছাড়া উত্তরখান দক্ষিণখানের পুরোটাই তিন ফসলি জমি ছিল। বিল ঝিল হিসেবে ব্যবহূত ভূমির মধ্যে কাচকুরা, গৌড়া, সুতিভোলা খাল, সাঁতারকুল, বাউনিয়া, মিরপুর ১২, পূর্বাচল থেকে ঢাকার বর্ধিতাংশ। এছাড়া এর আওতায় ছিল গাবতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে টেকনিক্যাল, মিরপুর আদাবর হয়ে বেড়িবাঁধ পর্যন্ত এলাকা। মতিঝিল, বাংলাদেশ ব্যাংকের পেছনের অংশ, গোড়ান, আহমদনগর ঝিলপাড়, মুগদা, মালিবাগ চৌধুরীপাড়া ঝিলপাড়, আফতাবনগরের পেছন থেকে বালুপাড় ডেমরা পুরো অংশ। নাল শ্রেণীর মধ্যে রয়েছে পীরেরবাগ, বনশ্রী, কায়েতপাড়া, শেখেরটেক, উত্তরা ১৮ ১৯ নম্বর সেক্টর, নতুন উত্তরা, দিয়াবাড়ী, বাউনিয়া, বৃন্দাবন গ্রাম, চাকুলি গ্রাম, ঢাকা উদ্যান, চন্দ্রিমা উদ্যান থেকে বেড়িবাঁধ হয়ে তুরাগ পর্যন্ত।

তারা বলছেন, জমিগুলো ১৮৮৮ সালের ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে (সিএস), ১৯৫৬ সালের স্টেট অ্যাকুইজিশন সার্ভে (এসএ) রিভিশনাল সার্ভে (আরএস) পর্চায় নাল, বিল বোরো প্রকৃতির ছিল। ১৯৯০ সালের বাংলাদেশ সার্ভেতে (বিএস) এসে শ্রেণী পরিবর্তন করা হয়েছে। ভূমির শ্রেণী পরিবর্তনের ক্ষেত্রে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা, অদূরদর্শী পরিকল্পনা সরকারের ঘনিষ্ঠ ভূমিদস্যুরা বড় দায়ী উল্লেখ করে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, প্রতিষ্ঠিত আবাসন ব্যবসায়ী তথা ভূমিদস্যুদের হাত ধরেই ঢাকার শ্রেণী পরিবর্তন হয়েছে। এক্ষেত্রে রাজউকের দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তারা প্রধানত দায়ী। রাজউকের নিজস্ব কোনো প্ল্যান ছিল না বলেই কাণ্ডজ্ঞানহীনের মতো যখন খুশি তখন ভূমির শ্রেণী পরিবর্তন করে ফেলেছে। রাজউকের উচিত ছিল শুধু ঢাকার জমির পরিমাণ না বাড়িয়ে ছোট ছোট কেন্দ্রীয় শহর গড়ে তোলা। তাহলে কৃষিভূমি জলাভূমি এভাবে গিলে ফেলা সম্ভব হতো না।

ভূমির শ্রেণী পরিবর্তনের ক্ষেত্রে রাজউক কোনো যাচাই-বাছাই করেনি। ফলে অপরিকল্পিত শ্রেণী পরিবর্তন ঢাকার নগরজীবনের বোঝা হয়ে উঠেছে বলে মন্তব্য করেছেন রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. নুরুল হুদা। পরিকল্পিত টেকনিক্যালি যাচাই-বাছাই করে ভূমির শ্রেণী পরিবর্তন করা উচিত ছিল বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।

নগরায়ণের স্বার্থে স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই একটি ভূমির শ্রেণী পরিবর্তন হয়। এক্ষেত্রে প্রাকৃতিক ভারসাম্য প্রাণবৈচিত্র্য বজায় রাখায়ও গুরুত্ব দিতে হবে। কিন্তু ঢাকার ক্ষেত্রে সেটি হয়নি বলে স্বীকার করেছেন রাজউকের নগর পরিকল্পনাবিদ সর্বশেষ ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যানের (ড্যাপ) প্রকল্প পরিচালক মো. আশরাফুল ইসলাম। তিনি বলেন, একটা সময় ঢাকার পরিধি ছিল ৩২০ একর। এখন এটা হয়েছে হাজার ৫২৮ একর। শহর বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই কৃষিজমি জলাশয় কমে আসবে। তবে অপরিকল্পিত ভূমি পরিবর্তনের ক্ষেত্রে প্রভাবশালীদের পাশাপাশি সরকারেরও চাহিদা ছিল। এখন আমরা যে বিশদ নগর পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছি সেখানে ওয়াটারবডি কৃষিজমি সংরক্ষণের প্রস্তাব করেছি। ঢাকাকে বাঁচাতে হলে, বাসযোগ্য করতে হলে ওয়াটার ডি কৃষিজমি সংরক্ষণের বিকল্প নেই।

ভূমির অপরিকল্পিত শ্রেণী পরিবর্তনের কারণে নগরবাসী সীমাহীন ভোগান্তি পোহাচ্ছে। জলজট তাপপ্রবাহ এমনকি ডেঙ্গুর মতো সমস্যাগুলোর পেছনেও ভূমির শ্রেণী পরিবর্তনই বড় কারণ বলে উল্লেখ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। ঢাকার ভূমির শ্রেণী পরিবর্তন অবৈজ্ঞানিক অপরিকল্পিতভাবে হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মাকসুদ হাসেম। তিনি বলেন, কৃষিভূমি বা জলাধারের শ্রেণী পরিবর্তন করে আবাসিক করা আসলে একটি অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। ঢাকার যেখানে কৃষিভূমিতে আবাসন করা হয়েছে সেখানেই দুর্যোগ স্থায়ী আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে জলাবদ্ধতা, তাপপ্রবাহ, ডেঙ্গুএগুলো ওয়াটারবডির শ্রেণী পরিবর্তনের কারণেই হচ্ছে।

ঢাকার ভূমির শ্রেণী পরিবর্তনে প্রভাবশালীদের বাধা দেয়ার ক্ষেত্রে ওয়াটার মডেলিং বড় ভূমিকা রাখত উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভূমির শ্রেণী পরিবর্তনের চাপ সবসময়ই থাকে। আমাদের যদি একটি ওয়াটার মডেলিং থাকত, তাহলে প্রেসার গ্রুপকে আমরা বোঝাতে পারতাম, কৃষিভূমি বা জলাশয়ে আবাসন করা আর দুর্যোগের সঙ্গে বসবাস করা একই কথা। কিন্তু আমাদের কাছে সে ধরনের কোনো মডেল বা হাউড্রোলজিক্যাল অ্যানালাইসিস প্রতিবেদন ছিল না। ফলে প্রেসার গ্রুপকে অন্তত ভবিষ্যতের সমস্যার কথা হাতেকলমে বোঝানো সম্ভব হয়নি।

ঢাকার অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে বলে মনে করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, আজ আমরা সময় অর্থ ব্যয় করে বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেলে অভিযান পরিচালনা করছি। কিন্তু এখানে যদি শুরুতেই খালি জায়গা পেতাম তাহলে আমরা সরাসরি উন্নয়নকাজ শুরু করতে পারতাম। দখল উচ্ছেদের জন্য বসে থাকতে হতো না।

অপরিকল্পিতভাবে শ্রেণী পরিবর্তন করে অবকাঠামো নির্মাণ পরবর্তী সময়ে তা ভেঙে ফেলার বিষয়টি দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন নগর গবেষণা কেন্দ্রের সভাপতি অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, শহরে একটা সময় ধান চাষ হতো, মাছ ধরা যেত, খাল ছিল, সুন্দর নদী ছিল, বাঁচার পরিবেশ ছিল। এসব হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শহরটির বাসযোগ্যতাও হারিয়ে গিয়েছে। এক্ষেত্রে আবাসন ব্যবসায়ীদের দায়ই সবচেয়ে বেশি। বিষয়টি সরকার নগরবিদদের গুরুত্ব দিয়ে ভাবা দরকার।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন