জাহাজ ভাড়া অর্ধেক কমলেও প্রভাব নেই ভোক্তা পর্যায়ে

রাশেদ এইচ চৌধুরী, চট্টগ্রাম ব্যুরো

নভেল করোনাভাইরাসজনিত মহামারী, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধসহ নানা কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়ছিল পণ্যের মূল্য। সেই সঙ্গে বেড়ে গিয়েছিল আমদানি পণ্য পরিবহনের খরচও। দেশের বাজারে বিভিন্ন পণ্যের দাম বৃদ্ধি ভোক্তা মূল্যস্ফীতির কারণ হিসেবে এতদিন এসব কথাই জানিয়ে আসছিলেন ব্যবসায়ীরা। তবে গত কিছুদিনের পরিসংখ্যান বলছে, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে পরিবর্তন এসেছে। ভোক্তা পর্যায়ে কমেছে ভোগের পরিমাণ। চাহিদা কমে যাওয়ায় আমদানিকারক দেশ থেকে পণ্য বুকিং কমতে শুরু করেছে। অবস্থায় সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনও দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই প্রতিযোগিতা মূল্যে ভাড়া প্রস্তাব করছেন জাহাজ মালিকরা। যার ফলে কমে এসেছে পণ্য পরিবহনের খরচ। যদিও এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ভোক্তারা এর সুফল পাননি।

খাতসংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা যায়, গত বছরের সঙ্গে তুলনা করলে বর্তমানে পণ্য পরিবহনের ভাড়া অর্ধেক কিংবা তারও নিচে নেমে এসেছে। সমুদ্রপথে রফতানির প্রধান দুই রুট চট্টগ্রাম থেকে ইউরোপ এবং চট্টগ্রাম থেকে যুক্তরাষ্ট্রদুই ক্ষেত্রেই জাহাজ ভাড়া কমেছে অর্ধেক। আর কনটেইনারে শিল্পপণ্য আমদানির ক্ষেত্রে প্রধান রফতানিকারক দেশ চীন থেকে চট্টগ্রাম রুটে জাহাজ ভাড়া কমেছে অর্ধেকেরও বেশি।

চট্টগ্রাম বন্দর শিপিং কোম্পানিগুলো থেকে পাওয়া তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গিয়েছে, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ইউরোপের দেশগুলোতে গত বছর ৪০ ফুটের একটি কনটেইনারের পণ্য পরিবহনের ভাড়া ছিল ১৪ থেকে ১৬ হাজার মার্কিন ডলার। বর্তমানে ভাড়া থেকে হাজারে নেমেছে। প্রায় একই চিত্র চট্টগ্রাম বন্দর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সমুদ্রপথের রুটেও। রফতানির গুরুত্বপূর্ণ পথে ১৫ হাজার মার্কিন ডলার থেকে কমে জাহাজ ভাড়া - হাজার ডলারে দাঁড়িয়েছে।

চীন থেকে কনটেইনার পরিবহনের খরচ কমেছে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হারে। গত বছর চীন থেকে কনটেইনারে পণ্য আনতে -১০ হাজার ডলার পরিশোধ করতে হতো দেশের আমদানিকারক শিল্পোদ্যোক্তাদের। সে খরচ কমে আড়াই থেকে তিন হাজার ডলারে নেমে এসেছে।

বর্তমানে ১৫০টিরও বেশি দেশ থেকে পণ্য সমুদ্রপথে বাংলাদেশে আমদানি করা হয়। পথে সবচেয়ে বেশি পণ্য আসে চীন থেকে। বাংলাদেশের জন্য বড় রফতানিকারক দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত চীন থেকে সমুদ্রপথে জাহাজে পণ্য আসে মূলত দক্ষিণ চীন সাগর, মালাক্কা প্রণালি আন্দামান সাগর হয়ে বঙ্গোপসাগর দিয়ে। দেশটি থেকে যেসব পণ্য আমদানি হয় তার বড় অংশ সাধারণ মানুষের ব্যবহারের পণ্য। এছাড়া সরকারের অনেক প্রকল্পের যন্ত্রপাতিসহ মূলধনি যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রেও দেশটির ওপর নির্ভরতা রয়েছে।

ভাড়া কমে যাওয়ার বিষয়ে সাইফ মেরিটাইম লিমিটেডের চিফ অপারেটিং অফিসার মো. আব্দুল্লাহ জহির বণিক বার্তাকে বলেন, বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থায় পণ্য পরিবহন চাপ কমতে শুরু করেছে। ফলে জাহাজ ভাড়া কমে আসছে। করোনা যখন শুরু হয় চীন সে সময়কালে কনটেইনার লিজ আর জাহাজের চার্টার রিনিউ করেনি। ফলে রফতানির চাপ যখন বাড়তে শুরু করে তখন চাহিদার বিপরীতে কনটেইনারের বড় সংকট তৈরি হয়ে জাহাজ ভাড়া অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। মহামারীর ১৮ মাস পর বৈশ্বিক পণ্য পরিবহন ব্যবস্থায় জট লেগে পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়। বিশ্বের বিভিন্ন বন্দরে জাহাজ জট এবং খালি কনটেইনারের ঘাটতির কারণে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহন ভাড়া (ফ্রেইট চার্জ) বেড়ে গিয়েছিল। বর্তমানে জাহাজ ভাড়া কমতে থাকার মূল কারণ বৈশ্বিক ভোগ কমে আসা। এতে আন্তর্জাতিক ক্রেতা দেশগুলো থেকে পণ্যের বুকিং কমে গিয়েছে।

একটা সময় চট্টগ্রাম বন্দরের নামের সঙ্গে কনটেইনার জাহাজ জট সমার্থক হয়ে উঠেছিল। দেশের শিল্পোদ্যোক্তা ব্যবসায়ীরা বলছেন, কিন্তু বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থায় ধীর হয়ে আসায় বন্দরে জাহাজের অবস্থান করার সময়ও কমে এসেছে। এখন কোনো রকম জট ছাড়াই কনটেইনার খালাসে গতি এসেছে। তবে জাহাজ ভাড়া কমে যাওয়ায় পণ্য আমদানিতে ব্যয় কমার যৌক্তিক কারণ থাকলেও ডলারের বিনিময় মূল্য হারের অস্থিরতার কারণে সে সুফল পাচ্ছেন না ভোক্তারা।

চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, খাদ্যপণ্যসহ দেশের উৎপাদনমুখী সব খাতের জন্যই কাঁচামাল আমদানি হয় বলে জাহাজে পণ্য পরিবহন ব্যয় মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির একটি বড় কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। আমদানি পণ্যের সিংহভাগই আসে বিদেশী জাহাজে, যেটা বৈদেশিক মুদ্রায় পরিশোধ হয় ফলে ভাড়া বাবদ ব্যয় যে হারে বাড়ে, ঠিক সে হারে পণ্যের দামের সঙ্গেও যুক্ত হয়। গত বছরের তুলনায় জাহাজ ভাড়া অনেক কমে আসায় রফতানিমুখী পণ্যের উৎপাদন ব্যয় কমার পাশাপাশি দেশে শিল্প ব্যবহার্য পণ্যের দামও কমে আসার কথা ছিল। কিন্তু টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বৃদ্ধিতে আমদানি খরচ আগের চেয়ে অনেক বেশি বেড়ে যাওয়ায় ভোক্তা পর্যায়ে আর সুফল আসছে না।

ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী বলেন, বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম যেমন কমেছে জাহাজ ভাড়াও কমেছে। কিন্তু দেশে ডলারের দাম ধারাবাহিকভাবে বাড়তে শুরু করেছে। প্রতি ডলারের বিপরীতে আমদানীকৃত পণ্যে আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিশোধ করতে হচ্ছে। ফলে আন্তর্জাতিক রুটে পণ্য পরিবহনে খরচ কমলেও সেই সুফল পাচ্ছেন না ভোক্তারা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন