অভিমত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অতীত ও বর্তমান

মাহমুদ রেজা চৌধুরী

শিক্ষা গ্রহণের সর্বোচ্চ স্তরকে বলা হয় বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার সর্বোচ্চ শেখর, যেখান থেকে বের হলে আমরা সমাজে এবং রাষ্ট্রে একটা বিশেষ সম্মান অর্জন করি। এটাও সত্য, ‘স্বশিক্ষিতহতে গেলেও নিজের অন্তরের মাঝে যে বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থান করে তার গুরুত্ব কম না। কিন্তু দুর্ভাগ্য, কারো কারো দুটোর কোনোটাই থাকেই না।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা সমাপনীর পর একটা আনুষ্ঠানিকপ্রত্যয়নপত্রমেলে যার মূল্য একেবারেই কম না। আর সেটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলে একটু বাড়তি মূল্য হয়তো পাওয়া যায়। প্রচলিত সমাজে তারাশিক্ষিতশ্রেণী বলে পরিচিতি লাভ করে। অনেকেই বড় চাকরিও পান। অনেকে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক হতে পারেন। আরো অনেক কিছু কপালে জুটে যায় বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবেও। একটা আত্ম অহংকার আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে।

কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীত গর্ব এবং অর্জন আজকের বাস্তবতায় কতটা অম্লান আছে? আমাদের সময়, (১৯৭৬-৮১) এবং আমাদের আগেও যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন, সেই সময়টা কেমন ছিল, আর এখন সেটা কেমন আছে, সেটি দেখার প্রয়াস থেকে নিবন্ধের অবতারণা।

প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ডক্টর রমেশচন্দ্র মজুমদারের (১৯৩৭-৪২) ঢাকা  বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে ১৯৭৮ সালে লেখাজীবনের স্মৃতি দ্বীপেউল্লেখিত কথা দিয়ে শুরু করছি। তিনি লিখেছেন, ‘১৯১১ সালের ডিসেম্বর মাসে বঙ্গভঙ্গ রহিত হয় বটে, কিন্তু পূর্ব বাংলার বিক্ষুব্ধ মুসলমানের মধ্যে একটা আন্দোলন চলতে থাকে। সেই আন্দোলন বন্ধ করার উদ্দেশ্যে ইংরেজ সরকার এই বলে তাদের আশ্বাস দিলেন, পূর্ববঙ্গের ঢাকা শহরে একটা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হবে। মুসলমানরা এতে খুবই খুশি হলেন বটে, কিন্তু হিন্দুদের মনে অসন্তোষ দেখা দেয়। তারা এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করলেন। রাজনৈতিক আন্দোলন থেকে সাধারণত যারা দূরে থাকতেন, তারাও এবার এই প্রতিবাদ আন্দোলনে যোগ দিলেন। এদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হলেন, রাশবিহারী ঘোষ এবং গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। তাদের প্রধান যুক্তি হলো, প্রশাসনিক ক্ষেত্রে বঙ্গভঙ্গ রহিত হয়েছে বটে, কিন্তু তার বদলে এখন সাংস্কৃতিক বিভাগ করা হচ্ছে। ফলে এতে আরো গুরুতর বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে। ক্রমেই আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করলে, বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ হিন্দুদের বলে আশ্বাস দিলেন, তাদের এমন আশঙ্কার কোনো কারণ নেই। কারণ ঢাকায় যে বিশ্ববিদ্যালয় হবে তার ক্ষমতা এবং অধিকার ঢাকা শহরের ১০ মাইল পরিধির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। এই সংকীর্ণ পরিধির বাইরে সমগ্র পূর্ব বাংলা পূর্বের মতোই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকবে।

কথা স্মরণের কারণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা থেকেই একটা রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক হামলার সম্মুখীন হয়েছিল। এটি সবসময়ই তার অস্তিত্ব এবং জ্ঞান বিকাশে বিশ্বের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আলাদা ছিল। উল্লেখ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব, বাস্তব রূপ লাভ করতে অনেক দিন লেগেছিল। ১৯২১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ শুরু হয়েছিল। এর কয়েক মাস আগে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক রেজিস্ট্রার ফিলিপ হার্টগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর নিযুক্ত হন (১৯২০-২৫)

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক কয়েকজন উপাচার্যের কথাও বলি। স্যার পি জে হার্টগ প্রথম উপাচার্যের দায়িত্ব পালনের পর দ্বিতীয় উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক জিএইচ লেঙলি (১৯২৬-৩৪), এরপর ছিলেন স্যার এএফ রহমান (১৯৩৪-৩৬), ডক্টর রমেশচন্দ্র মজুমদার (১৯৩৭-৪২), ডক্টর মাহমুদ হাসান (১৯৪২-৪৮), ডক্টর সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন (১৯৪৮-৫৩), ডক্টর ডব্লিউ জেনকিনস (১৯৫৩-৫৬), বিচারপতি মো. ইব্রাহিম (১৯৫৬-৫৮), বিচারপতি হামুদুর রহমান (১৯৫৮-৬০), ডক্টর মাহমুদ হোসেন (১৯৬০-৬৩), ডক্টর ওসমান গনি (১৯৬৩-৬৯), বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী (১৯৬৯-৭২), ডক্টর সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন (১৯৭১), ডক্টর মুজাফফর আহমেদ চৌধুরী (১৯৭২-৭৩), ডক্টর আব্দুল মতিন চৌধুরী (১৯৭৩-৭৫), অধ্যাপক মো. শামসুল হক (১৯৭৫-৭৬), ডক্টর ফজলুল হালিম চৌধুরী (১৯৭৬-৮৩)

প্রফুল্ল কুমার গুহ ১৯২১-৪৪ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক এবং শেক্সপিয়র গবেষক ছিলেন। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপকদের একটি পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে প্রকাশিত একটি ম্যাগাজিনেআমাদের সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নামে একটা সুন্দর রচনা লিখেছিলেন তিনি। সে রচনায় প্রফুল্ল কুমার লেখেন, ‘১৯৪৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে তার সূচনা হতে তেইশ বছরব্যাপী সেবা অন্তে যখন কলকাতার শিক্ষা জগতে প্রবেশ করলাম, তখন আমার একমাত্র পাথেয় হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিচিত্র অমূল্য অভিজ্ঞতা। কলকাতায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বভার গ্রহণ করবার সৌভাগ্য আমার ঘটেছে। কিন্তু কোন ক্ষেত্রেই আমি বিভ্রান্ত বা পথভ্রষ্ট হই নাই শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষণ প্রশাসনের যে শিক্ষা-দীক্ষা পেয়েছিলাম তার জন্য।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে একসময় হয়তোবা যথার্থ অর্থেই প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলা যেত, এটা এখন অপ্রিয় সত্য হলেও সঠিক, আজ আর তা বলার কোনো অবকাশ নেই। একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক সচেতনতা থাকলেও সেটা কখনো এখনকার মতো সাংঘর্ষিক ছিল না। ষাটের দশক থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক চরিত্র অনেক ক্ষেত্রেই বদলেছে নানাভাবে কিন্তু বহু ক্ষেত্রে আমরা অনেকেই বদলাইনি। একসময় যেটা আদর্শ নৈতিকতায় চলত সেটা বদলে গেছে অনেকটাই সামাজিক এবং রাজনৈতিক শ্রেণী স্বার্থের বিভেদে মধ্য সত্তর দশক থেকেই। তখন থেকেই শুরু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে রাজনৈতিক একটা রণক্ষেত্রে তৈরি করার অশুভ প্রক্রিয়া। অধিকাংশ বর্তমান ছাত্র-ছাত্রী এবং শিক্ষক প্রক্রিয়ার শিকার

আমরা অনেকেই এটা জানি, শিক্ষকতা পেশার দুটি মূল্য আছে। একটা তার আর্থিক মূল্য, অন্যটা তার সামাজিক মূল্য। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় দুদিকেই আমাদের শিক্ষকরা অনেক ক্ষেত্রে অসহায় এবং সীমাবদ্ধ আবার অনেক ক্ষেত্রে অনেকেই রাজনৈতিক লক্ষ্য কিংবা স্বার্থ দ্বারা উদ্বুদ্ধ হন। যে কারণে আমাদের সব পর্যায়ে শিক্ষার পরিবেশ ইতিবাচক লক্ষ্যে পৌঁছতে পারছে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ এবং শিক্ষক এর থেকে বাইরে নয় এখন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম ছাত্র এবং শিক্ষক সিরাজুল হক, বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে তার স্মৃতিচারণায় বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাথমিক যুগে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক ছিল অতিমধুর। ছাত্ররা শিক্ষকদের ভক্তি এবং শ্রদ্ধা করত, শিক্ষকরা ছাত্রদের অত্যন্ত স্নেহ করতেন। ওই সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছেলে-মেয়েদের অবাধ মেলামেশা করতে দেয়া হতো না। উল্লেখ্য, সিরাজুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন চার বছর, আর এখানে শিক্ষকতা করেছেন ৪২ বছর।

আমাদের স্বাধীনতার প্রায় পাঁচ দশক অতিক্রান্ত হয়েছে। আমাদের সার্বিক শিক্ষা অবস্থা এবং এর গুণগতমান কতটা আমরা উন্নত করতে পেরেছিপ্রশ্নটা বারবারই সামনে আসে, বিশেষ করে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আজকের সংকট এবং সীমাবদ্ধতা দেখেও।

জাতীয় অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক তার এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘আমাদের সময়নোটসম্বন্ধে কোনো ধারণাই ছিল না। সে যে কোন ধরনের ছাত্র ছিল আমাদের ধারণা ছিল না। আমাদের সময় টেক্সটবুক পড়া এবং লাইব্রেরি ইউজ করার হ্যাবিট ছিল।উল্লেখ্য, অভ্যাসটা অনেক আগেই উঠে গেছেই বলা যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের অনুশীলন থেকেও। সাম্প্রতিককালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা কতটুকু পাঠ্যবই পড়েন অথবা সেটা সম্পর্কে জানেন, বলতে পারব না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে এককথায় বলা যেতে পারে বাঙালি মুসলিম সমাজ এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকাশে বিশাল ভূমিকা রাখে, সেটা সংক্ষিপ্ত পরিসরে ব্যাখ্যা করাও কঠিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়েছেন এবং অধ্যাপনা করেছেনএমন জন গুণী ব্যক্তিদের কথা বলি। খুব সহজেই বুঝতে পারবেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্ব কেমন ছিল এবং অতীতে অনেক জ্ঞানীগুণী মানুষ আমাদের জ্ঞানের জগতে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন তখন এবং এখনো তারা আছেন। পাশাপাশি তাদের তেমন কোনো বিকল্পের সম্ভাবনা এখন প্রায় নিভুনিভু।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা শিক্ষকতা করেছেন এবং ছাত্র-ছাত্রী ছিলেন, তাদের মধ্যে কয়েকজনের নাম মনে আসছে, যেমন শ্রদ্ধেয় কবীর চৌধুরী, রমেশচন্দ্র মজুমদার, আবুল ফজল, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, আব্দুল্লাহ আল মুতী, বদরুদ্দীন উমর, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আবুল মাল আবদুল মুহিত, রফিকুল ইসলাম, মোজাফ্ফর আহমদ, জাহানারা হক, মেহের কবীর, সেলিনা বাহার জামান, ইকবাল বাহার চৌধুরী, মিজানুর রহমান শেলী, মোকাম্মেল হক, রাশেদ খান মেনন, মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন, মালেকা বেগম, বেগম শামসুয জাহান নূর, লায়লা হাসানসহ আরো অনেকে। এরা প্রত্যেকেই জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শিক্ষিত স্বজন এবংআলোকিত মানুষহিসেবে এখনো ইতিহাসে নিজেদের জায়গা করে আছেন। [চলবে]

 

মাহমুদ রেজা চৌধুরী: সমাজ রাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র (১৯৭৬-৮১)

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন